দুই নেত্রী, জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয় সংসদ by শাহ আহমদ রেজা

‘দারিদ্র্য বিমোচন দিবস-২০০৯’ পালন উপলক্ষে অন্তরালের আয়োজন চমত্কারই ছিল। রাজধানীর আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে উত্সবের আয়োজনেও তেমন ঘাটতি ছিল না। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া যোগ না দেয়ায় সবই মাঠে মারা গেছে। ফলে শুরু হয়েছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেয়ার চেষ্টা। এতে অবশ্য কাজ হচ্ছে না। জনগণের মধ্যে বরং বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্যই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

১৬ অক্টোবরের সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া ‘আন্তর্জাতিক’ নামের ওই সম্মেলনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি চারটি দাবির উল্লেখ করেছেন—১. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা; ২. বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ বন্ব্দ করা; ৩. রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন ও বিরোধী দল দমন বন্ব্দ করা; এবং ৪. দলীয়করণ বন্ব্দ করা। খালেদা জিয়া বলেছেন, হাইকোর্টে বস্তি বসানোর এবং বিচারপতিদের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিল করার ঐতিহ্যধারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ন্যায়বিচারের সব পথ বন্ব্দ করে দিচ্ছে। জরুরি সরকারের মতো রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক দৈহিক নির্যাতন চালাচ্ছে। রিমান্ডে নির্যাতন বন্ব্দ করার জন্য হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনার প্রতি চরম অবজ্ঞা দেখাচ্ছে। সব মিলিয়েই পরিস্থিতিকে এমন বিপজ্জনক করে তোলা হয়েছে, যখন দারিদ্র্য বিমোচন সংক্রান্ত সম্মেলনে যোগ দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। খালেদা জিয়া না বললেও পর্যবেক্ষকরা কিন্তু অন্য কিছু কারণও লক্ষ্য করেছেন। যেমন প্রধানমন্ত্রী এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়ার এবং ভারতকে করিডোর দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেননি। নাম ও পোশাকসহ বিডিআর পুনর্গঠন করার মতো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি গুরুতর বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ব্দুত্বের স্থলে শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কও প্রধানমন্ত্রী একাই তৈরি করেছেন। এদিকে উদ্ঘাটিত বিভিন্ন তথ্যে জানা গেছে, ১৭ অক্টোবরের সম্মেলনটি আদৌ কোনো ‘আন্তর্জাতিক’ সম্মেলন ছিল না। জাতিসংঘের নাম ব্যবহার করে বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিয়ে নোংরা রাজনীতি করা এবং বিশেষ একটি এনজিও’র জন্য ফান্ড যোগাড় করাই ছিল সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য। সম্মেলনের আয়োজক ছিল ‘দারিদ্র্যবিরোধী ক্যাম্পেইন জাতীয় কমিটি’। জনৈক শিশির শীল এর সেক্রেটারি জেনারেল। সংসদ সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও এই শিশির শীল ‘সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপ’-এরও সদস্য সচিব হিসেবে সম্মেলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। খালেদা জিয়াকে তিনি জানিয়েছিলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, ভারতের কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ব্দী, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন এই সম্মেলেনে যোগ দেবেন। কথাটা চরম মিথ্যা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এদিকে সম্মেলন আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ছিল পিপলস এমপাওয়ারমেন্ট ট্রাস্ট (পিইটি), ব্রিটিশ সরকারের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি) এবং বাংলাদেশে তত্পর কয়েকটি দেশি-বিদেশি এনজিও। অর্থাত্ এটা ছিল সর্বতোভাবেই এনজিওদের একটি সম্মেলন। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ‘হাঁড়ি-পাতিল্যা চোর’ হিসেবে নিন্দিত এনজিওদের নেতৃত্বে দারিদ্র্য মোচন করা সম্ভব—এমন কথা কেবল ‘চোরের সাক্ষী বাটপাররাই’ বলতে ও বোঝাতে চাইতে পারে।
কথা শুধু এটুকুই নয়। আলোচ্য সম্মেলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠার অন্য একটি কারণও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক জেনারেল (অব.) স্লসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টির কোনো নেতা বা এমপিকেই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। দেশের বৃহত্তম ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও এমপিরাও আমন্ত্রণ পাননি। অন্য কোনো রাজনৈতিক দলকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এনজিওদের নেতৃত্বে সরকার তাহলে কাদের নিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে ‘জাতীয় ঐক্য’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল? শুধু দুই নেত্রীকে নিয়ে? একে রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। আলোচ্য সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী যে ভাষণ দিয়েছেন তার মূল কথা থেকেও তার নিজের এবং সরকার ও আয়োজকদের উদ্দেশ্য উন্মোচিত হয়েছে। ভাষণে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে যথেচ্ছভাবে ধোলাই করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, ‘রুখব দারিদ্র্য’-এর বদলে ‘লুটব সম্পদ, হবো ধনী’—এই স্লোগান দিলে হয়তো তিনি (খালেদা জিয়া) আসতেন। স্লোগানটি পছন্দ না হওয়ায় হয়তো তিনি আসেননি। লক্ষণীয় যে, এই ‘সম্পদ’ বিষয়ক কথা বেশি শোনা যেত মইন উ-সহ ‘উদ্দিন সাহেবদের’ মুখে। ঠিক কার বা কোন দিকে ইঙ্গিত করে তারা বলতেন সে কথা নিশ্চয়ই উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু যেটা অবশ্যই বলা দরকার তা হলো, অনেক ‘হাতি-ঘোড়া’ মারার এবং শত কোটি টাকার অংকে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় করার পরও কিন্তু ওই ‘সম্পদের’ কোনো হদিস কেউ বের করতে পারেনি। লজ্জার বিষয় হলো, হদিস না পাওয়া সত্ত্বেও এতদিন পর এসে প্রধানমন্ত্রী ‘উদ্দিন সহেবদের’ সেই নোংরা ঢেঁকুরই তুলেছেন। বিরোধী দলের প্রতি সংসদে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানাতে গিয়েও প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক অর্থে ফাউল করেছেন। তিনি বলেছেন, সংসদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যখন ভোগ করছেন তখন দয়া করে সংসদে আসুন, বসুন। এভাবে সব মিলিয়ে সম্মেলনের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তাকে কোনো বিচারেই গণতন্ত্রসম্মত বলা যায় না। এর মধ্য দিয়ে আর যা-ই হোক, ‘জাতীয় ঐক্যে’র প্রশ্নে অন্তত সততার প্রকাশ ঘটেনি। ওটা কোনো ‘আন্তর্জাতিক’ সম্মেলন ছিল নাকি প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের কোনো জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। কারণ, ‘আন্তর্জাতিক’ কোনো অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখেন না, ব্যঙ্গ-তামাশা করে ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের’ কাছে নিজ দেশের রাজনীতিকদের ছোট করেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেটাই করেছেন। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের আগ্রহ আসলে কতটুকু। দারিদ্র্য বিমোচনের নামে মাতামাতি করা এবং সম্মেলনের মঞ্চে উঠিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে অপদস্থ করাই তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল।
বিভিন্ন জনের প্রতিক্রিয়াও ছিল যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ। যেমন সংসদে সরকারদলীয় চিফ স্লইপ আবদুস শহিদ বলে বসেছেন, প্রধামন্ত্রীর সঙ্গে ‘এক মঞ্চে’ উঠতে অস্বীকৃতি জানিয়ে খালেদা জিয়া নাকি প্রমাণ করেছেন, বিএনপি দারিদ্র্য বিমোচন চায় না! এর মাধ্যমে খালেদা জিয়া নাকি ‘রাজনৈতিক দীনতা’ দেখিয়েছেন! আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন, দারিদ্র্য বিমোচন শুধু নয়, খালেদা জিয়া নাকি আইনের শাসনও চান না! এখানে ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ হয়ে ওঠা আকবর আলি খানের মন্তব্যও স্মরণ করা দরকার। বেতন-ভাতাসহ সর্বতোভাবে সুবিধাভোগী এই সাবেক আমলা খালেদা জিয়ার মতো জনপ্রিয় জাতীয় নেত্রীর সমালোচনা করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। বলেছেন, খালেদা জিয়া নাকি ‘দলীয় দৃষ্টিকোণ’ থেকে সম্মেলন বর্জন করেছেন! শুনতে ‘আহামরি’ ধরনের মন্তব্য মনে হলেও মোড়লগিরি জাহির করতে গিয়ে আকবর আলি কিন্তু মূল বিষয়টিই এড়িয়ে গেছেন। যেহেতু দলের নেত্রী সেহেতু তিনি ‘দলীয় দৃষ্টিকোণ’ থেকেই যে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন। খালেদা জিয়া তো আকবর আলির মতো ধান্দাবাজ চাকরিজীবী নন যে, সব সরকারের আমলে সুবিধা লুটবেন এবং অসুবিধা দেখলেই পদত্যাগের নামে চাকরি পাল্টে লম্বা লম্বা ভাষণ দেবেন, নতুন কোনো চাকরির জন্য লাইন লাগাবেন এবং একে-ওকে তেল মর্দন করবেন! ওই সম্মেলনে শুধু নয়, দারিদ্র্য বিমোচনের প্রশ্নে জাতীয় সংসদেও ক্ষমতাসীনরা আন্তরিকতার প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে ১১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অধিবেশনের উল্লেখ করা যায়। সেদিনের নির্ধারিত আলোচ্যসূচি ছিল সংশোধিত দ্বিতীয় দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র। কিন্তু যিনি বিষয়টি উপস্থাপন করবেন সেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতই উপস্থিত ছিলেন না। অন্য মন্ত্রীরাও ছিলেন অনুপস্থিত। এ সময় সামনের সারির ২৯ আসনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাসদের হাসানুল হক ইনু ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। স্পিকার তাই দুঃখ করে বলেছেন, ‘যে মন্ত্রী বিষয়টি উপস্থাপন করবেন, তিনি নেই। যে এমপিরা বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, তারাও নেই। চিফ স্লইপও নেই। এটা আমি সহজভাবে নিতে পারছি না।’ উল্লেখ্য, সে সময় অধিবেশনে মোট ৮৭ জন এমপি উপস্থিত ছিলেন। তারাও আবার নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব শুরু করেছিলেন। অবস্থা দেখে-শুনে বিরক্ত স্পিকার না বলে পারেননি যে, এভাবে পরস্পরের সঙ্গে কথা বললে তো সংসদ ‘মাছ বাজার’ হয়ে যাচ্ছে!
কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, দারিদ্র্য নিয়ে যারা সংসদে পর্যন্ত ছেলেখেলা করেন সে ক্ষমতাসীনরাই আবার ‘হাঁড়ি-পাতিল্যা চোর’ এনজিওদের নেতৃত্বে দারিদ্র্য মোচনের নামে মাঠ গরম করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। উদ্দেশ্যও গোপন রাখা হচ্ছে না। তারা আসলে খালেদা জিয়াকে অপদস্থ করতে চাচ্ছেন—যেন তিনি দারিদ্র্য বিমোচন চান না! এজন্যই সম্মেলনটিকে কেন্দ্র করে আক্রমণ শাণিয়ে চলেছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রধানমন্ত্রী নিজেও পিছিয়ে থাকছেন না। অন্যদিকে দারিদ্র্য বিমোচন প্রচেষ্টা সম্পর্কে বেরিয়ে আসছে বিস্ময়কর নানা তথ্য। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। দারিদ্র্য বিমোচন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত উত্সবের একটি পর্বের অনুষ্ঠানে ১৮ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী রাখঢাক না করে বলেছেন, ক্ষুদ্র ঋণ দেশে চরম দারিদ্র্যের হার কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাত্ সরকার যে এনজিওদের নিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের নামে মাতামাতি করছে, সে এনজিওরা দারিদ্র্যের হার কমাতে পারেনি বরং বাড়িয়েছে। স্পিকার আবদুল হামিদের একটি মন্তব্যও উল্লেখ করা দরকার। একই উত্সবের অন্য এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে কোট-টাই পরে শীত ঠেকানোর অপসংস্কৃতির চর্চা করে দারিদ্র্য নির্মূল করা যাবে না। অথচ স্পিকার নিজেও এনজিওদের সঙ্গে মিলিতভাবে ‘শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত’ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রেই বিলাসিতাপূর্ণ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছেন। এটা এমন এক অনুষ্ঠান ছিল—যেখানে ছিন্নমূল বা দরিদ্ররা দূরে থাক, শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাও প্রবেশ করার সুযোগ পাননি। ওদিকে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও দারুণ কথা শুনিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী যেদিন ‘শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত’ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দারিদ্র্য বিমোচনের আড়াল নিয়ে খালেদা জিয়া এবং বিরোধী দলকে ধোয়ামোছা করছিলেন, সেদিনই শহীদ মিনারে আয়োজিত এক মানববন্ব্দন অনুষ্ঠানে কমরেড সেলিম বলেছেন, বর্তমান সরকারের ৩২টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ৩১টি মন্ত্রণালয়ই ‘দারিদ্র্য উত্পাদন’ করে। এজন্যই দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব হচ্ছে না।
তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ না দেয়ার কারণে বিরোধীদলীয় নেত্রীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার সময় বিষয়টি অনুধাবন করা দরকার। একথা সত্য, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনাকে দেখার জন্য রাজপথে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ‘ঢল’ নামে এবং তাদের সমাবেশে লাখ-লাখ মানুষ গিয়ে ভিড় জমায়। একথাও সত্য যে, দুই নেত্রীকে মিনিট কয়েক কথা বলতে দেখেও মানুষ উদ্বেলিত হয়, আশান্বিত হয়ে ওঠে। কিন্তু দারিদ্র্য বিমোচন এত সহজ কোনো ব্যাপার নয় যে, দুই নেত্রী ‘এক মঞ্চে’ বসলেই দারিদ্র্য দৌড়ে পালাবে! দুই নেত্রী তো আগেও ‘এক মঞ্চে’ বসেছেন—১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে এবং ২০০৮ সালের নভেম্বরে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে সেনাকুঞ্জে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দু’জন হেসে হেসে কথাও বলেছেন। কিন্তু তারপরও অবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি বরং দু’জনের রাজনৈতিক সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটেছে। সুতরাং এমন বোঝাতে চাওয়াটা মোটেই সঠিক নয় যে, দুই নেত্রী এক মঞ্চে বসলেই ‘গড়’ একেবারে ‘উল্টে’ যাবে! প্রশ্ন আসলে উদ্দেশ্যের এবং সঠিক পরিকল্পনার। আর এখানে এসেই আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম থেকে ‘ডিগবাজি’ দিয়ে চলেছে। প্রসঙ্গক্রমে প্রাধান্যে এসেছে জাতীয় সংসদ। বস্তুত ‘এক মঞ্চে’ বসানো সত্যিই উদ্দেশ্য হয়ে থাকলে দুই নেত্রীর জন্য বৃহত্তর মঞ্চ হিসেবে রয়েছে জাতীয় সংসদ। সংসদকে কর্যকর করার সদিচ্ছা থাকলে সরকারের উচিত বিরোধী দলের সঙ্গে ‘গণতন্ত্রসম্মত’ আচরণ করা। কিন্তু সুস্থ ও গণতন্ত্রসম্মত সেই পথে পা বাড়ানোর নামও করছেন না ক্ষমতাসীনরা। তারা বরং প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন থেকেই সংসদকে পঙ্গু করে রেখেছেন। আসন বিন্যাস নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে বিএনপি ও জামায়াতের এমপিদের সংসদের বাইরে ঠেলে দিয়েছেন। মাঝখানে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর মার্চে অধিবেশনে যোগ দিলেও বিরোধী দলের জন্য পরিবেশ তৈরি করা হয়নি। এদিকে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সরকারি দলের এমপিরা সংসদ ভবনকে ‘মাছের বাজার’ বানিয়ে ফেলছেন (কথাটা স্পিকার আবদুল হামিদের; বলেছেন ১১ অক্টোবরের অধিবেশনে)। সংসদ ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ ঘোষিত হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। পরিস্থিতিতে পরিবর্তন ঘটাতে হলে বিরোধী দলকে অধিবেশনে ফিরিয়ে নিতে হবে। বিরোধী দল সংসদে গেলে জাতীয় সংসদই দুই নেত্রীর জন্য সবচেয়ে বড় ‘মঞ্চ’ হয়ে উঠবে। তখন আর দুই নেত্রীকে ‘এক মঞ্চে’ ওঠানোর জন্য শিশির শীলদের মতো লোকজনকে ঘাড়ে তুলতে হবে না। ‘হাঁড়ি-পাতিল্যা চোর’ এনজিওদের নেতৃত্বে পাড়া মাতানোরও প্রয়োজন পড়বে না। উদ্দেশ্যে সততা থাকলে জাতীয় সংসদকে কার্যকর করার চেষ্টাই চালানো দরকার।

No comments

Powered by Blogger.