শীর্ষ পর্যায়ের নীতিহীনতাঃ শাক দিয়ে মাছ ঢাকা গেল না

কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ছে। গত নির্বাচনের মনোনয়নপত্র অবৈধ হওয়ার কারণে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সংসদ সদস্যপদ হারানো আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের চাঞ্চল্যকর ঘটনা অনুসন্ব্দানে অবিশ্বাস্য ব্যাপার জানা গেছে। নানা ধরনের এসব অপচেষ্টার সঙ্গে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনও অনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। এ সবই করা হয়েছে দুর্নীতির দায়ে বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিটিকে রক্ষার জন্যই।

গতকালের আমার দেশ-এ প্রসঙ্গটি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বিস্তারিত রিপোর্ট । নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই ভোলা-৩ আসনে বিএনপি প্রার্থী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনের যে অভিযোগ নির্বাচন কমিশন খারিজ করে দিয়েছিল, সেই অভিযোগই আমলে নিয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট মেজর (অব.) জসিমের মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এর বিরুদ্ধে আপিলের মাধ্যমে রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করে শুরু হয় গোপন খেলা। হাইকোর্টের রায়ের চার মাস পর গত জুন মাসে নির্বাচন কমিশন মেজর জসিমের সংসদ সদস্যপদ রক্ষায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করে। এই ধারা আগেই লগ্ধঘন করে তারা মেজর জসিমের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছিল। নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ পদক্ষেপ কাজে আসেনি, কারণ তারা সম্ভবত জানত না মেজর জসিমের দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ আগেই আদালতের নথিতে জমা দেয়া ছিল। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্বের আরও নজির রয়েছে। নির্বাচনের আগে মেজর হাফিজের অভিযোগ পাওয়ার পর তারা বিষয়টি নিয়ে কমিশনের বাঘা বাঘা আইনজীবীদের দ্বারস্থ না হয়ে গিয়েছিলেন সেনা দফতরের জাজ অব অ্যাডভোকেট জেনারেলের (জেএজি) কাছে। তার পরামর্শেই মেজর জসিমের মনোনয়নপত্র বৈধ বলে রায় দেয় নির্বাচন কমিশন। সেনাবাহিনীর এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিটি কেন একজন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির অবৈধ মনোনয়নপত্রের পক্ষে দাঁড়ালেন, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এক্ষেত্রে এটাও প্রমাণ হয় যে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন মোটেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করেনি। ঘটনার এখানেই শেষ নয়, হাইকোর্টের রায় ঘোষণার ৭ মাস পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর খোদ প্রধানমন্ত্রী, যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও রয়েছেন, মেজর জসিমকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন। নিজ ক্ষমতাবলে তিনি সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট দফতরকে দিয়ে মেজর জসিম উদ্দিনের বাধ্যতামূলক অবসর আদেশ পরিবর্তন করে ‘অকালীন অবসর’ প্রদানের গেজেট নোটিফিকেশনের ব্যবস্থা করেন। এই ‘অস্ত্র’ ব্যবহার করে মেজর জসিম আপিল বিভাগে তার সংসদ সদস্যপদ রক্ষার শেষ চেষ্টা চালান। কিন্তু বিধিবাম। হাইকোর্টের রায়ের পর প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে দেয়া গেজেট নোটিফিকেশন অকার্যকর বলে আপিল বিভাগ তা বাতিল করে দিয়েছেন। এভাবে একটা মিথ্যা ঢাকতে কত মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছে, তার হদিস কি দেশবাসী জানতে পারবে? এখন ভোলা-৩ আসনে আবার নির্বাচনের পদক্ষেপ নেবে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু যে নির্বাচন কমিশন নিজস্ব বিধিমালা লগ্ধঘন করেছে এবং পরে আবার সেই বিধি সংশোধন করে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চেয়েছে, তার ওপর কি আস্থা রাখা যায়? যে ব্যক্তি নিজের দুর্নীতির কথা গোপন করে দল ও সবাইকে প্রতারণা করেছেন, সেই ব্যক্তিই যদি আবারও প্রার্থী হন তবে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে? আর যে প্রধানমন্ত্রী এই দুর্নীতি, অনিয়ম, প্রতারণাকে বৈধ করার জন্য নিজ ক্ষমতাবলে অনৈতিক ভূমিকা নিয়েছেন তার সরকারের অধীনে দেশ, জাতি ও জনগণের মঙ্গল দূরে থাক কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে, বিশ্বাস করা কঠিন। শীর্ষ পর্যায়েই যেখানে এ ধরনের নীতিহীনতা সেখানে মুখের নীতিকথা যে কেউ মানবে না, সেটা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ড থেকেই বোঝা যায়।

No comments

Powered by Blogger.