সত্তরোর্ধ্ব শিক্ষককে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে... কেন!? by আবিদ রহমান

শিক্ষকদের শাসনে বিরক্ত-অতিষ্ঠ হয়ে আমরা ওনাদের বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করতাম। বেঁটে-মোটা শিক্ষকের নামকরণ হতো ব্যাটারি স্যার। ক্লাসরুমে ব্যাঙের মতো মুখ ফুলিয়ে ঘুমাতেন বিধায় ব্যাঙ স্যার।

নিষ্ঠুর হাতে বেত চালানো অংক স্যারের নাম হতো, কসাই। আর নন্দলাল স্যারের অন্য কোনো নাম ছিল কি না সেটাই মনে পড়ে না। আজ, সময়ের দূরত্বে বসে বুঝি, ওনারা আসলেই ছিলেন কারিগর। আমাদের মতো এক থোঁকা এলোমেলো কাঁদাকে মনূষ্যে রূপান্তরের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ছিলো সেইসব কর্মকাণ্ডের উৎস।
তখন শিক্ষক মানেই ছিলেন অভাবী। শতচ্ছিন্ন ছাতা হাতে তালি দেয়া বস্ত্রের একজন হতদরিদ্র জীব! শিক্ষার প্রতি নিখাদ নিবেদন ভিন্ন অন্য সবকিছুর প্রতি বৈরাগী। এমনকি নিজের সংসারের খোঁজ-খবর রাখার বদলে ছাত্রদের লেখাপড়া-টেস্ট পরীক্ষা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন বেশিরভাগ শিক্ষক। এখন শিক্ষকেরা ‘ফুল্লি’ প্রফেশনাল। ফেলো কড়ি মারো তেল মার্কা। প্রাইভেট পড়তে আসো— নগদ নারায়ণ ঢালো। ছাত্রদের রেজাল্টের খোঁজ-খবর নেবার সময় কোথায় শিক্ষকদের। ঢাকার এক শিক্ষক প্রাইভেট পড়াতে পড়াতে খাওয়ার সময় পান না। গিন্নিকে চামচ দিয়ে খাইয়ে দিতে হয় কারণ শিক্ষকটি তখন টাকার বিনিময়ে জ্ঞানের সওদা করছেন।

আমাদের জমানার গ্রামের শিক্ষকেরা একবারে ধোঁয়া তুলসি পাতা ছিলেন না। লজ্জ্বাজনক বেতনের অংকে সংসার চলে না। অন্যের জমিতে কামলা দেবার মতো সামাজিক অবস্হান বহু আগেই খুঁইয়ে বসেছিলেন শিক্ষকতায় এসে। আয়ের প্রধানতম উৎস কিছুটা সম্মানের বর্গাচাষ। ক্লাসের ফাঁকে, স্কুল ছুটির আড়ালে-আবডালে প্রিয় ছাত্রদের বিনে পয়সায় নিজের বর্গা নেয়া জমিটুকুতে একটু খাঁটিয়ে নিতেন। ছাত্রদের প্রায় ‘বাধ্য’ করতেন তাদের পারিবারিক ক্ষেতের মুলো-বেগুন-মরিচটা এনে দিতে। জ্ঞান বিতরণে ব্রতী অভাবী মানুষটির লোভের হাত বড় জোর এতদূর যেতো।

সেকারণেই আমাদের জমানার মানুষের কাছু শিক্ষকদের মূল্যটা এতো অপরিসীম। এখনো যেখানে পুরোনো শিক্ষকদের সাথে, যারা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে আছেন, দেখা হলে আমরা পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানাই। ক্রমেই আমাদের শিক্ষকদের সংখ্যা আশংকাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। এখনকার ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্ক মোটামুটি বাণিজ্যিক। টাকা গুণে দেয়া হচ্ছে। বিনিময়ে শিক্ষক বিক্রি/বিতরণ  করছেন ‘জ্ঞান’।

একটি ব্লগে বুধবার একটা সচিত্র নিউজ দেখলাম। সূত্র হিসাবে উল্লেখ ক’রা হয়েছে দৈনিক ইত্তেফাকের নাম। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের গন্ধর্ব্যপুর ইউনিয়নের মৈশামুড়া বালুর মাঠে এক অবসরপ্রাপ্ত ৭০ বছর বয়স্ক শিক্ষকের হাত পিছমোড়া করে পুরো গ্রাম ঘুরানো হচ্ছিলো। অবসরপ্রাপ্ত বয়োবৃদ্ধ শিক্ষকটির অপরাধ— তিনি ছেলের নেয়া কর্জ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছেন। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানিনা। জানিনা, কর্জের টাকাটা ওনার জ্ঞাতসারে ওনাকে সজ্ঞানে জামিন করে দেয়া হয়েছে কিনা। যদি হয়ে থাকে, টাকাটা যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হবার যৌক্তিক কোনো কারণ কি আছে?

বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শুধু এটুকু জানি, যারা এই রায় দিয়েছেন, তাদের কারো স্বার্থের লেজে পা দিয়েছিলেন এই বয়োবৃদ্ধ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকটি। আর হ্যাঁ, বিচার-সালিশকারী এবং রায় বাস্তবায়নকারীদের অধিকাংশ একসময় ওনার ছাত্র ছিলেন। এরই নাম কি বাঙালির গুরু দক্ষিণা! খুব জানতে ইচ্ছে করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আর মেম্বার মহোদয়দের ভূমিকা কী ছিলো? টাকার অংকটা কি এতোই বিশাল যে লাখ টাকা খর্চা করে নির্বাচনে বিজয়ী স্হানীয় সরকারের গণপ্রতিনিধিরা চাঁদা তুলে শোধ দিতে পারতেন না! নাকি সবই গ্রাম্য ভোটের রাজনীতির খেলা?

ফতোয়ার বিরুদ্ধে আমাদের ‘সু-শীল’ সমাজ বেশ সরব। ফতোয়া কি খালি নারীদের বেলায় হয়? ধর্মের নামে হয়? অধর্মের আবরণে কী কোনো ফতোয়া জারি হয়না? এই অন্যায়-অবিচার এবং অমানবিক ঘটনাটা যদি ফতোয়ার ফসল না হয়, তাহলে ব্যাপারটার যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা কি? উপজেলা শিক্ষা অফিসার কিংবা উপজেলা প্রশাসনের কি কোনো নৈতিক দায়-দায়িত্ব আছে? থানায় কি কেউ দয়া করে কোনো মামলা দায়ের করেছেন। নাকি জিজ্ঞেস করলে ওসি সাহেব আকাশ থেকে পড়বেন?

বিস্তারিত জানতে ইচ্ছুক আগামীর কোনো এক মোনাজাত উদ্দিনের মতো অনুসন্ধানী রিপোর্টারের কাছ থেকে। ব্যাখ্যা চাই উপজেলা প্রশাসন থেকে। সর্বোপরি মহামান্য ইউপি চেয়ারম্যান কী বলেন, সেটা শোনাও জরুরি। টিভি চ্যানেলগুলো টক শো’র এমন একটা জুসি বিষয় এড়িয়ে গেলো! আমাদের ‘সু-শীল’ সমাজের দু’একটা ক্ষ্যাপ মারার রাস্তা রুদ্ধ হয়ে থাকবে?

No comments

Powered by Blogger.