জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়- ২৩ শিক্ষক, ২২ কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়ম by শুভংকর কর্মকার

নিয়ম লঙ্ঘন করে গত কয়েক বছরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ ২৩ জন শিক্ষককে উচ্চতর পদে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এঁদের প্রত্যেকের পদোন্নতি ও নিয়োগের ক্ষেত্রে এক বা একাধিক বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে।


বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা নিয়োগ নিয়েও কিছু অভিযোগ উঠেছে। নয়জনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেকশন কর্মকর্তা (গ্রেড-২) পদে ২২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আবার চাকরি স্থায়ী হওয়ার আগেই তাঁদের পদোন্নতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে প্রশাসন।
নিয়ম ভেঙে নিয়োগ পাওয়া প্রায় সব শিক্ষকই সরকারদলীয় সমর্থক হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত। অনেকে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘নীল দল’ এবং শিক্ষক সমিতির বিভিন্ন পদে আছেন।
একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও কর্মকর্তা জানান, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এসব দলীয় শিক্ষক উচ্চ পদে নিয়োগের জন্য উপাচার্যকে বিভিন্নভাবে চাপ দিয়ে আসছিলেন। ‘পদ বাঁচাতে’ শেষ পর্যন্ত উপাচার্য তাঁদের কাছে মাথা নত করেন। নিয়োগের বাছাই কমিটি ও সিন্ডিকেটের সভাপতি উপাচার্য।
জানতে চাইলে উপাচার্য মেসবাহউদ্দিন আহমেদ অভ্যন্তরীণ কয়েকজন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে স্বীকার করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আমি উপাচার্য হওয়ার আগেই নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সেই যোগ্যতা নেই। এখন আমি তাঁদের প্রমোশন দেব না, সেটা তো হয় না। তাই শর্ত শিথিল করা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, গত বছরের এপ্রিল মাসে সিন্ডিকেটে অধ্যাপক নিয়োগের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ প্রার্থীদের জন্য উচ্চতর পদে নিয়োগের শর্ত শিথিলের সিদ্ধান্ত হয়। তবে কী বিধির কোন কোন শর্ত শিথিল হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। এই সিদ্ধান্তকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ‘যার জন্য যা প্রযোজ্য’ সেভাবে শর্ত শিথিল দেখানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অভিযোগ করেন, অধ্যাপক পদে শর্ত শিথিলতার সিদ্ধান্ত থাকলেও অন্যান্য পদ অর্থাৎ সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক পদে তা ছিল না। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ১৬ জন সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপককে শর্ত ভেঙে উচ্চতর পদে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এঁদের মধ্যে আটজন সহযোগী অধ্যাপক ও আটজন সহকারী অধ্যাপক। আর ‘শর্ত শিতিলের’ আওতায় সাতজনকে অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
শর্ত ভঙ্গের নমুনা: অরুণ কুমার গোস্বামী ২০০৮ সালের আগস্টে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। এক বছর আট মাস পর তাঁকে সহযোগী এবং দুই বছর তিন মাস পরই গত জুলাইয়ে অধ্যাপক হিসেবে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, অন্যান্য শর্তের পাশাপাশি পিএইচডি ডিগ্রিধারী অভ্যন্তরীণ শিক্ষকদের অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেতে হলে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ন্যূনতম চার বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা লাগে। সহযোগী অধ্যাপক হতে হলে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ন্যূনতম পাঁচ বছর শিক্ষকতা করতে হবে। তবে এর জন্য শিক্ষাজীবনে দুটি প্রথম শ্রেণী থাকা বাধ্যতামূলক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ অরুণ কুমারের ক্ষেত্রে এই নিয়ম দুটির কোনোটিই মানা হয়নি। মাত্র চার বছরের মধ্যে তাঁকে দুই দফায় উচ্চতর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁর শিক্ষাজীবনে একটি মাত্র প্রথম শ্রেণী আছে।
অরুণ কুমার গোস্মামী বলেন, ‘২০০৮ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একইসঙ্গে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে আবেদন করি। কিন্তু বাছাই বোর্ড আমাকে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়। তার আগে আমি সরকারি কলেজে ২০ বছর শিক্ষকতা করেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়মের ঘটনা ঘটেনি। বিরোধীরাই তথ্য বিকৃতি করে অপ্রচার চালাচ্ছে।’
গত বছরের সেপ্টেম্বরে শরাবান তোহুরা গণিত বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ পান। আট মাস পর তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপগ্রেডেশন নীতিমালার অধীনে তাঁকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। শরাবানের প্রভাষক পদের নিয়োগপত্রে লেখা ছিল, তিনি দুই বছর অবেক্ষাধীন থাকবেন। এ সময় তাঁর কাজ সন্তোষজনক হলে তাঁকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আপগ্রেডেশন নীতিমালা অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ শিক্ষকদের চাকরি স্থায়ী না হলে পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হবেন না। নীতিমালায় সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেতে হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রভাষক হিসেবে এক বছরসহ মোট তিন বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা লাগবে।
শরাবান তহুরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে আবেদন করি। আমাকে প্রথম প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে তার আগে আমি কলেজে ছয় বছর প্রভাষক ছিলাম। আমার শিক্ষাগতযোগ্যতা ও প্রকাশনা সব আছে। পরে আবেদন করলে বাছাই বোর্ডই আমাকে যোগ্য বিবেচনা করে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।’
অভ্যন্তরীণ প্রার্থীদের অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেতে হলে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ন্যূনতম চার বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু সাবেক জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক এস এম আনোয়ারা বেগম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে মাত্র এক বছর পাঁচ মাসের অভিজ্ঞতা নিয়েই সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর জানায়, ২০০৯ সালের নভেম্বরে আনোয়ারা বেগম রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে তিনি অধ্যাপক পদে নিয়োগ পান। গত এপ্রিল মাসে তিনি ‘নীল দলের’ প্যানেল থেকে নির্বাচন করে শিক্ষক সমিতির সহসভাপতি হয়েছেন।
এস এম আনোয়ারা এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি সরকারি কলেজে ২৭ বছর চাকরি করেছি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাওয়ার আগেই আমি অধ্যাপক ছিলাম। বাছাই বোর্ড আমাকে নিয়োগ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি।’
প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সাইফুল ইসলাম গত চার বছরে দুই বার উচ্চতর পদে নিয়োগ পেয়ে অধ্যাপক হয়েছেন। তিনি শিক্ষক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য।
জুনায়েদ আহমদ হালিম গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর নিয়োগ পান। এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ২০১০ সালের জুলাই মাসে তিনি আবার সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান।
নিয়ম অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ একজন শিক্ষককে (পিএইচডি ডিগ্রিবিহীন) সহযোগী অধ্যাপক হতে হলে সহকারী অধ্যাপক পদে ছয় বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।
একজনের জন্য একাধিক বিধি ভঙ্গ: গত ২৩ মে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিয়েন ছুটি নিয়ে মো. শাহিনুর রহমান ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু এর পাঁচ মাস আগে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত হয়, লিয়েন ছুটিতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাউকে যোগদান করানো হবে না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট যখন এই সিদ্ধান্ত নেয়, তখন শাহিনুর রহমান কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিয়েন ছুটি নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত ছিলেন। তারও আগে একবার তিনি লিয়েন ছুটি নিয়ে ২০১০ সালের এপ্রিল থেকে এক বছর চার মাস জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে গেছেন।
সর্বশেষ যোগদানের সময় শাহিনুর রহমান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত ছাড়পত্র জমা দেননি। এ জন্য তিনি তিন মাসের সময় চান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তপক্ষের কাছে। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তটি অগ্রাহ্য করে উপাচার্য তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন। কিন্তু সাড়ে চার মাস পার হয়ে গেলেও ওই শিক্ষক ছাড়পত্র জমা দেননি।
গত বুধবার পর্যন্ত বিষয়টি নিশ্চিত করে রেজিস্ট্রার ওহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত অধ্যাপক শাহিনুর আগের প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্র আনেননি।’
কর্মকর্তা নিয়োগে নয়-ছয়: চলতি বছর একাধিক নিয়ম ভঙ্গ করে সেকশন কর্মকর্তা (গ্রেড-২) পদে ২২ জনকে নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এসব কর্মকর্তার নিয়োগপত্রের এক নম্বর শর্তে উল্লেখ আছে, দুই বছর অবেক্ষাধীন থাকার পর তাদের চাকরি স্থায়ী হবে। আবার তিন নম্বর শর্তে আছে, চাকরিকাল এক বছর পার হলে তাঁদের পদোন্নতি দিয়ে গ্রেড-১ কর্মকর্তা করা হবে। অর্থাৎ চাকরি স্থায়ী হওয়ার আগেই তাঁরা পদোন্নতি পাবেন।
কিন্তু গত মে মাসে সিন্ডিকেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের জন্য যে আপগ্রেডেশন নীতিমালা অনুমোদন হয় তার ৫ নম্বর শর্তে বলা আছে, কোনো কর্মকর্তার চাকরি স্থায়ী না হলে তিনি পদোন্নতির যোগ্য হবেন না।
তবে উপাচার্য দাবি করেছেন, কর্মকর্তা নিয়োগে কোনো অনিয়ম হয়নি। বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে যাঁদের নেওয়া হয়েছে তাঁদের পদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে আগেই অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
উপাচার্য মেসবাহউদ্দিন আহমেদ দাবি করেন, ‘সব নিয়োগই দক্ষ বাছাই কমিটির মাধ্যমে হয়েছে এবং তা সিন্ডিকেটে অনুমোদন হয়েছে। যা করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে করেছি।’

No comments

Powered by Blogger.