যখনই একটু অবকাশ পাই by আলতাফ শাহনেওয়াজ

বছরের কোনো সময়েই অবসর মেলে না তারকাদের। কেবল ঈদ আর পূজার ছুটিতে খানিকটা আয়েশি মুহূর্ত কাটানোর সুযোগ পান তাঁরা। এবার ঈদ ও পূজা কাছাকাছি সময়ে হওয়ায় এসেছে সুযোগ—তারকারা কাটাতে পারছেন একটু বেশি অবসর।


এই অখণ্ড অবসরে দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে কী করবেন তাঁরা—কোন আকাশে মেলে দেবেন নিজের মনের ঘুড়ি?

‘যখনই একটু ছুটি পাই আমি ছুটে যাই ছাদে...’—এ গানটি মনে পড়লে দারুণ মন খারাপ হয় তাঁদের। তাঁরা সবাই ব্যস্ত তারকা। ধরাবাঁধা ছক কাটা মুখস্থ রুটিনের ভেতর তাঁদের কেউ দিনভর শুটিংয়ে ব্যস্ত, কেউ বা আবার ব্যস্ত রেকর্ডিং, প্লেব্যাক—গানের জগৎ নিয়ে। তবে তাঁদের ভেতর একটিই মিল—সবার জীবন থেকে বেমালুম হাওয়া হয়ে গেছে অবসর। একটানা বেশ কয়েক দিন ছুটি তাঁদের কাছে যেন সোনার হরিণ। তাই লোপামুদ্রা মিত্রের গানটি মনে করে তাঁদের তো মন খারাপ হবেই। কিন্তু এবার কোরবানির ঈদ ও দুর্গাপূজা মিলিয়ে একনাগাড়ে বেশ কয়েক দিন ছুটি কাটাবেন তারকারা। এই ছুটির অবসর কীভাবে কাটাবেন তাঁরা? প্রিয় লেখকের কোন বইটি পড়বেন, ফিরে যাবেন কি মন ছুঁয়ে যাওয়া কোনো গানের ভেতর, নাকি সময়ের অভাবে যেসব চলচ্চিত্র দেখি দেখি করেও দেখা হচ্ছিল না, সেসব দেখে ফেলবেন এবার? কেউ কি বাক্সপেটরা নিয়ে বেড়াতে যাবেন দূরে কোথাও? প্রশ্নের উত্তরগুলো প্রিয় তারকাদের মুখেই শোনা যাক।

মম
এমনিতে প্রায়ই বইয়ের পাতায় চোখ রাখেন মম। প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পগুলো পড়তে পড়তে হারিয়ে যান অন্য ভুবনে। ফলে এবারের দীর্ঘ ছুটিতে বই তাঁর কাছ-ছাড়া হচ্ছে না। ‘সুনীলের গল্পসমগ্র ধরেছি, এবার শেষ করে ফেলব। আর ড. আহমদ শরীফের বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য একাডেমিক কারণেই পড়তে হবে। তাই ওই বইয়েও চোখ বোলাব ফাঁকে ফাঁকে।’ মমর সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল, ঈদের এক দিন পর স্বামী এজাজ মুন্না ও ছেলে উদ্ভাসসহ পাঁচ-সাত দিনের জন্য দেশের বাইরে ঢুঁ মারতে পারেন তিনি। উচ্ছ্বাসমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘নিজের মতো কিছুটা সময় কাটাব, ভাবতেই ভালো লাগছে!’

বিন্দু
বাবা পদোন্নতি পেয়েছেন। ছোট ভাইটি লেখাপড়ায় ভালো করেছে। কিন্তু সময়ের অভাবে এসবের কিছুই উদ্যাপন করতে পারেননি বিন্দু। এবারের ছুটি তাই তাঁর কাছে উদ্যাপনের উৎসব। এর সঙ্গে ইচ্ছামতো ঘুমও উদ্যাপন করবেন। ‘একটানা বিশ্রাম নেওয়ার চেয়ে ভালো কিছু কি আছে দুনিয়ায়?’ এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েই জানালেন, অবসরে পুরোনো দিনের সুরের মধ্যে ডুবে যাবেন। ‘মোহাম্মদ রফি, লতা মুঙ্গেশকর আর রাহুল দেব বর্মণের গানগুলো আবার শোনার ইচ্ছা আছে। এ ছাড়া সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা ও ঋতুপর্ণ ঘোষের বেশ কয়েকটি ছবি এনে রেখেছি। ওগুলো অবসরে দেখে ফেলতে পারলে মন্দ হবে না,’ বললেন বিন্দু। এরপর চুপি চুপি বললেন, ‘চারপাশে বরফি আর ইংলিশ ভিংলিশ-এর এত সুনাম শুনছি, ওই দুটি ছবি না দেখলে যেন শান্তি পাচ্ছি না।’

ন্যান্সি
সংগীতশিল্পী ন্যান্সি ছেলেবেলা থেকেই বইয়ের পোকা। সপ্তম শ্রেণীতে উঠতে না উঠতেই মাসুদ রানা ও তিন গোয়েন্দা সিরিজের রহস্যভরা জগতে ঢুকে পড়েছিলেন। তারপর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে পড়েছেন চমৎকার সব বই। তাই অবসর কি অনবসর—বই সব সময় তাঁর নিত্যসঙ্গী। ‘আমার তো ঈদের ছুটিছাঁটা লাগে না। এমনিতেই প্রচুর বই পড়ি। সামনে আবার পড়ার ইচ্ছা আছে সমরেশ মজুমদারের মেয়েরা যেমন হয় এবং শংকরের হঠাৎ একদিন। হুমায়ূন আহমেদের তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণেও আরেকবার পড়তে চাই।’ এভাবে বলতে বলতে এই সংগীতশিল্পী জানালেন তাঁর প্রিয় দুই বইয়ের নাম—হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের শী ও মারিয়া পুজোর গড ফাদার। তিনি বললেন, ‘বই পড়া, গান গাওয়া, গান শোনা—আমার কাছে সবই সমার্থক। একটার মধ্য দিয়ে আরেকটাকে পাই আমি।’ ঈদ-পূজা উপলক্ষে নতুন যেসব অ্যালবাম আসবে, অবসরে এবার সেগুলোই শুনবেন ন্যান্সি। ঈদ কাটাবেন নেত্রকোনায়।

কনা
‘ঈদ বা পূজার সময় আমাদের ব্যস্ততা কিন্তু বেড়ে যায়। নিজের পরিবারকে সময় দেওয়া, চ্যানেলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান—একদমই অবসর মেলে না।’ একটানা ছুটির অবসরে কোন বই পড়বেন, কী গান শুনবেন, ছবি দেখবেন কি না, আমাদের এসব প্রশ্নের সামনে এক ঝটকায় এই হলো কনার উত্তর। তবে কি ছুটিতেও অবসর মিলবে না তাঁর? হেসে জানালেন, ‘বাজারে আসা অ্যালবামগুলো দেখব, তারপর সেগুলোর মধ্য থেকে কোনো কোনোটা শুনতে শুনতে কাটিয়ে দেব ছুটির মুহূর্তটুকু।’ নিজে গান করেন। কথার মাধ্যমেও বোঝালেন সংগীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। তবে কনা ঈদ উপলক্ষে এবার সপরিবারে যেতে পারেন গাজীপুরে, গ্রামের বাড়িতে। আর ছবি দেখার প্রসঙ্গ তুলতেই দিলেন ত্বরিত উত্তর, ‘আমি কিন্তু হলে গিয়ে ছবি দেখি। এবারও যেতে পারি, স্টার সিনেপ্লেক্স অথবা মধুমিতায়।’

আজাদ আবুল কালাম
এখন আর ফাঁকা সময় সেভাবে না মিললেও নিজের একান্ত অবসর ঠিকই বের করে নিতে জানেন অভিনেতা-নির্দেশক আজাদ আবুল কালাম। বরাবরই তাঁর কিছু না কিছু পড়াশোনা করার অভ্যাস। লম্বা এই ছুটিতে কী করবেন, এমন প্রশ্নোত্তরে বললেন, ‘আগেভাগে কিছুই বলতে পারছি না। তবে ছুটি আমি মুগদাপাড়ায় আমার মায়ের সঙ্গে কাটাতে চাই। আর পড়াশোনার কথা যদি বলি, কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের ছেলে কাজী দিশু, তাঁর সঙ্গে একসময় অনেক সুন্দর মুহূর্ত কেটেছে আমার। তাঁর লেখা কয়েকটি বই বেশ কিছুদিন ধরে জমা হয়ে আছে। এবার ওগুলো পড়ে শেষ করতে চাই। গল্পগ্রন্থ পাখির চোখে দেশান্তরের গল্প, অ্যাডগার অ্যালানপোর কয়েকটি গল্পের অনুবাদ কালো বিড়াল ও অন্যান্যসহ চমৎকার কিছু বই লিখেছেন কাজী দিশু। আশা করছি বইগুলো পড়ে সমৃদ্ধ হব। এ ছাড়া আগামী বইমেলায় প্রকাশিতব্য আমার নতুন গল্পের বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসব এই ছুটিতে। ২০০৮ সালে একটি গল্প লিখেছিলাম ‘ঢাকার গোশ’ নামে। ওটা একটু ঠিকঠাক করে পরিমার্জন করব। বোধ করি, এভাবেই পার হয়ে যাবে ঈদের ছুটির অবসর।’

চঞ্চল চৌধুরী
এবারের ঈদ ও পূজার ছুটিতে পাবনার সুজানগরের ছেলে চঞ্চল চৌধুরী ফিরে যাবেন মায়ের কাছে। ‘ঈদ ও পূজা কাছাকাছি হওয়ায় একসঙ্গে বেশ কিছুদিন ছুটি পেয়েছি। অনেক দিন পর গ্রামের বাড়িতে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকব। তাই সম্ভবত বই পড়া, গান শোনা বা ছবি দেখা—কোনোটাই সেভাবে হয়ে উঠবে না।’ অভিনেতা চঞ্চল স্পষ্টভাবে যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন নিজের গ্রাম সম্পর্কে দু-চার কথা বলার সুযোগটি ছাড়তে চাইলেন না। বললেন, ‘আমাদের কামারহাটি গ্রামটি একদম পদ্মা নদীর গা ঘেঁষে। বাড়িতে গেলে স্কুলজীবনের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজি কিংবা নদীর পাড়ে বসে থেকে সময়টা কীভাবে যেন কেটে যায়। আর অনেক দিন বাদে নিজের গ্রামে নিজের মতো সময় কাটানোর সুযোগ, বই পড়া, গান শোনার চেয়ে এও কি কম, বলেন?’ চঞ্চলের এই প্রশ্ন মুহূর্তেই যেন মিলিয়ে দিল অনেক উত্তর।

তানিয়া আহমেদ
অভিনেত্রী তানিয়া আহমেদের প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য আমেরিকা যাওয়ার আগে অটোগ্রাফসহ নিজের কয়েকটি বই তানিয়াকে দিয়েছিলেন সদ্যপ্রয়াত এই লেখক। এবার অবসরে ওই বইগুলো পড়ে শেষ করবেন তিনি। ‘হুমায়ূন স্যারের বইগুলো পড়ি-পড়ি করেও পড়া হয়ে ওঠেনি। তাই আমার ভেতরে একরকম অপরাধবোধ আছে। ঈদ অবসরের সুযোগে বইগুলো পড়তে চাই। আফসোস একটাই, বই পড়ার পর স্যারকে তো আর জানাতে পারব না।’ তানিয়ার কণ্ঠে আফসোসের রেখা স্পষ্ট। সেই আফসোস মুছতে মুছতে বললেন, ‘এবারের ঈদ কুষ্টিয়ায় শ্বশুরবাড়িতে কাটাতে পারি। ওখানকার গড়াই নদীতে নৌকায় সপরিবারে ঘুরে বেড়ানো—মনে পড়লেই মনটা যেন ভালো হয়ে যায়।’

মিলন
‘অবসর আমাদের কাছে দুর্লভ বস্তু। এর জন্য রীতিমতো সাধ্যসাধনা করতে হয়। হা হা হা...।’ নিজের বর্তমান বাস্তবতার কথা বলতে বলতে এ রকম রসিকতার সুরই ভেসে এল আনিসুর রহমান মিলনের কণ্ঠে। তাঁর কথার মধ্যে তখনো উঁকি দিচ্ছে রসমাখা হাসি। তিনি বললেন, ‘ঈদের অবসরে সুযোগ পেলে আরজ আলী মাতব্বরের রচনাবলী নতুন করে নেড়েচেড়ে দেখতে পারি। ১৯৯৪ সালের দিকে এটি প্রথম পড়েছিলাম। পড়ার পর শরীরে সে কী উত্তেজনা! মনে হয়েছিল, আমরা কী আসলেই শিক্ষিত, কতটা শিক্ষিত আমরা? যা হোক, এই বই নতুন চিন্তার দিশা দিয়েছে আমাকে।’ ছুটিতে লালনের গান এবং বিভিন্ন লোকগীতি খুব প্রিয় এই ব্যস্ত অভিনেতার। এ ক্ষেত্রে শিল্পী হিসেবে তাঁর প্রথম পছন্দ চন্দনা মজুমদার। আবেশমাখা গলায় মিলন বললেন, ‘সারাটা জীবন লালনের গান শুনে যদি কাটিয়ে দেওয়া যেত!’ তবে সারা জীবন না হলেও এবারের ছুটিতে লালনসংগীত সঙ্গী হচ্ছে তাঁর। এদিকে চলচ্চিত্র দেখার কথা উঠতেই তাঁর ঝটপট উত্তর, ‘সময় পেলেই ছবি দেখি আমি। শেষ দেখেছি ওয়ান থাউজেন্ট ওয়ার্ড। এটি একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র। এবার ছুটির ফাঁকে বরফি দেখার একটা চান্স নিতে পারি।’

পূর্ণিমা
অবসরে নায়িকা পূর্ণিমার খুব ঘোরাঘুরির বাতিক। ঈদ উপলক্ষে এবারের অবসরটুকুতেও তাই ভ্রমণের বিকল্প কিছু ভাবছেন না চলচ্চিত্রের এই তারকা। তিনি বললেন, ‘ছুটিতে কাতারে যাব। ওখানে আমাদের স্টেজ শো আছে। আমি ছাড়াও সামিনা চৌধুরী, ফেরদৌস, মীম, শুভ—তাঁরাও থাকবেন। সব মিলিয়ে তিন দিন কাটাব আমরা।’ কাতারে বেড়ানোর সময় ভালো কোনো থিয়েটার হলে টোকেন-২ ছবিটি প্রদর্শিত হলে রথ দেখা এবং কলা বেচার মতো সেটি দেখে আসতে চান পূর্ণিমা। এ প্রসঙ্গে জানালেন, ‘কিছুদিন আগেই হিরোইন দেখেছি। খুব ভালো লেগেছে। ভাবছি, এবার ঈদের ছুটিটা আমার নতুন চলচ্চিত্র ছায়াছবির গানগুলো শুনতে শুনতেই কাটিয়ে দেব। এর মধ্যে গানগুলো নিজের সংগ্রহে রেখেছি।’ পূর্ণিমার এমন কথায় ঈদ-পূজার ছুটির আমেজের আভা যেন আরও ঘন হয়ে এল।

‘ছুটির বাঁশি বাজল নীল গগনে...’—রবীন্দ্রনাথের এই গানের মতো ব্যস্ত তারকাদের জীবনেও খানিকটা ছুটির ফুরসত মিলবে তবে এবার। তাই একেকটি দিন পেরিয়ে এখন কেবল দিন গোনার পালা। সেই ছুটি, তারকাদের আরাধ্য সেই অবসরটুকু কখন আসে, কখন আসে...।

No comments

Powered by Blogger.