মুজিবনগর স্মৃতিকেন্দ্রে মুজিব নেই! by কুন্তল রায় ও তুহিন আরণ্য

মেহেরপুরের মুজিবনগরের আম্রকাননে নতুন তৈরি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্রের জাদুঘরে ঢোকার পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৭ ফুট লম্বা ও ১০ ফুট চওড়া একটি প্রতিকৃতি বসানোর কথা ছিল। তা না বসিয়েই এ খাতে বরাদ্দ অর্থ খরচ দেখানো হয়েছে।


প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এই স্মৃতিকেন্দ্রে এ ধরনের আরও অনিয়ম পাওয়া গেছে। জাদুঘরের ভেতরে ১০ জন জাতীয় নেতার তিন ফুট লম্বা তেলচিত্র রাখার কথা থাকলেও কারোরই রাখা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ৩০টি বড় আকারের তেলচিত্রের জায়গায় আছে ২৪টি। আট বছরের প্রকল্প ১৩ বছরেও ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’। এখন স্মৃতিকেন্দ্রটি ব্যবহারের উপযোগী করতে ৮০ কোটি টাকায় তিন বছর মেয়াদি আরেকটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে।
‘মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপন (দ্বিতীয় সংশোধনী)’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত বিভাগ। ব্যয় হয়েছে ৪৫ কোটি ছয় লাখ ৩৯ হাজার টাকা। কাগজে-কলমে গত বছরের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদনে (পিসিআর) বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ দেখানো হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়নি। অনেক কাজ অসমাপ্ত রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র প্রকল্পের সর্বশেষ পরিচালক প্রদোষ কান্তি দাস স্মৃতিকেন্দ্রে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি না থাকার বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেছেন, ‘ছবিটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আছে।’ মন্ত্রণালয়ে কেন পড়ে আছে, জানতে চাইলে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার এই আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে। প্রকল্প দলিলে বলা হয়েছে, মুজিবনগরের ঐতিহাসিক ঘটনাকে মহিমান্বিত করতে ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য। ১৯৯৮ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০০৬ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। শেষ না হওয়ায় মেয়াদ ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে প্রকল্পে সংশোধনী এনে সময় ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ায়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্পটি মূল্যায়ন করেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৩ বছরে প্রকল্পটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে না পারা দুঃখজনক। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও উদাসীনতা ছিল। প্রতিবেদনে সমস্যাগুলো খতিয়ে দেখে কারণ উদ্ঘাটন করতে এবং দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘নির্মাণকাজ করেছে গণপূর্ত বিভাগ। কী কাজ করা হচ্ছে বা কী মানের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে, তা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। কাজ শেষ হয়েছে বলা হলেও গণপূর্ত বিভাগ আজ পর্যন্ত প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেনি।’
প্রকল্পের সর্বশেষ পরিচালক প্রদোষ কান্তি দাসও যথাসময়ে কাজ শেষ না করার জন্য গণপূর্ত বিভাগকে দায়ী করেন।
গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়াউদ্দিন হায়দার প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে নির্মাণকাজের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, প্রকল্পে আর্থিক অনিয়ম হয়নি। অনেক বাড়তি কাজ করতে হয়েছে, তাই বরাদ্দকৃত টাকায় সংকুলান হয়নি। তবে কার অনুমোদনে বাড়তি কাজ হয়েছে, তা তিনি বলতে পারেননি। অনুমোদনহীন কাজের কথা আইএমইডির প্রতিবেদনেও আছে।
কাজ না করেই খরচ: জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, কমরেড মণি সিং, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ—এই ১০ জন জাতীয় নেতার তিন ফুট লম্বা ও দুই ফুট চওড়া তেলচিত্র রাখার কথা প্রকল্পে ছিল। প্রকল্প এলাকা ঘুরে কারও ছবিই পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ৩০টি বড় আকারের তেলচিত্র থাকার কথা ছিল। আছে ২৪টি। ছবিগুলোর জন্য প্রায় এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
দেখা যায়, স্মৃতিকেন্দ্রের মিলনায়তন ভবন ও সংলগ্ন প্লাজা নির্মাণ শেষ হয়নি। মিলনায়তনে টিনের বেড়া দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মিলনায়তনে প্রবেশপথের দুই পাশে স্টিলের বেষ্টনী ও মঞ্চে কাঠের পাটাতন লাগানো হয়নি।
আইএমইডি বলছে, প্লাজা ও মিলনায়তন নির্মাণ অসম্পূর্ণ রয়েছে। তবে এ খাতের সাত কোটি ২২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। আর্থিক অসংগতি ও কাজ অসমাপ্ত থাকার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা প্রকল্প পরিচালক যুক্তিসংগত কারণ ব্যাখ্যা করেননি।
আরও অনিয়ম: ঐতিহাসিক দলিলপত্র ও তথ্যাবলি সংরক্ষণ, ইতিহাসের ঘটনাক্রমিক বৃহদাকার স্থিরচিত্র এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচিহ্ন—তিনটি কাজ শেষ করার কথা প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। এতে ব্যয় হয়েছে ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচিহ্নের আওতায় কোন কাজটি হয়েছে, তা আইএমইডি আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি। অন্যদিকে ঠিকাদারের পাওনা প্রায় আট লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়নি।
আইএমইডির সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে গেলে জটিলতা বাড়বে। চিঠি চালাচালি করতে হবে, কে দায়ী তা খুঁজতে হবে। এতে কাজের কাজ কিছু হবে না।
স্মৃতিকেন্দ্রটি দর্শনার্থীদের ব্যবহারের উপযোগী হয়নি। মন্ত্রণালয় সূত্র জানাচ্ছে, ব্যবহারের উপযোগী করতে আবার নতুন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০ কোটি টাকা। বাস্তবায়নকাল তিন বছর।

No comments

Powered by Blogger.