এ ঘুম ভাঙবে কবে? by ফ্লোরা সরকার

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠোরে’, এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে যারা শিশু বয়বে কবিতাটি মুখস্থ করেননি বা পড়েননি। কিন্তু আফসোস! জাতীয় কবি এত সুন্দর একটা কবিতা শিখিয়েও এখনও আমাদের ভোরে ওঠাতে পারেননি। এমনকি ভোরে ওঠা দূরে থাক, আমাদের ঘুম থেকে জেগে ওঠাতেও পারেননি।

আর তাই এখনও আমরা ঘুমের ঘোরে হাঁটি, কাজ করি, কথা বলি, কথা শুনি, মাঝে মাঝে শুনেও না শোনার ভান করি, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা চোখ মেলে তাকাই কিন্তু দেখি না। দেখি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারি না। বুঝি না বলে কিছু শিখতেও পারি না। আর শিখব কী করে, কারণ আমরা তো আসলে দেখিই না। এ যেন অর্থনীতির সেই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের ভেতর ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়ে যাওয়া। কবি যখন কাজ করেন তখন কর্তব্যবোধ থেকে নয়, মনের তাগিদ থেকেই করেন। কর্তব্য আর তাগিদ দুটো সমার্থক শব্দ নয়। কর্তব্য মানুষ অনিচ্ছা নিয়েও করতে পারে, কিন্তু তাগিদ? না, তাগিদের কাজ মনের একান্ত ইচ্ছার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই কাজটাও হয় সুসম্পন্ন। তাগিদ থাকলে কর্তব্যবোধ অনায়াসে আসে। আর তাই আমরা দেখি ঘড়ির কাঁটা বিদ্যুতের সাশ্রয়ের জন্যই হোক বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক একঘণ্টা এগিয়ে দিয়েও আমরা আজও ভোরে উঠতে শিখিনি। যদিও ছোট ছোট শিশুরা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা আর অফিসগামী মানুষরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুম ঘুম চোখে আজকাল প্রকৃত ভোরের একঘণ্টা আগের ভোরে অর্থাত্ ডিজিটাল ভোরে উঠে স্কুল, কলেজ-ইউনিভার্সিটি আর অফিসে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু ওই যাওয়া পর্যন্তই। অনিচ্ছায় উঠে যাওয়া আর ইচ্ছেয় উঠে যাওয়ার মধ্যে সেই কর্তব্য আর তাগিদের পার্থক্য থেকে যায়। যাক, তবু তো আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভোরে ওঠানোর একটা সাময়িক অভ্যাস গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সাময়িক এই কারণে যে, ঘড়ির কাঁটা যথাস্থানে চলে গেলে আমরাও আবার আমাদের ঘুম থেকে ওঠার যথাস্থানে চলে যাব। এখন প্রশ্ন কেন এই ভোর নিয়ে এত দুঃখ-বেদনা আমাদের? ভোর মানে দোর খোলা। দোর খোলা মানে শুধু ঘরের দুয়ার খোলা নয়, সেই সঙ্গে মনের দুয়ারও মনের অজান্তে খুলে যায়। ঘরের দুয়ার খোলার সঙ্গে সঙ্গে যেমন ঘরে আলো আসে, মনের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তেমনি মনে আলো এসে পড়ে। সেই আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠে। আমরা তো বেশ কিছুদিন থেকেই আলোকিত জীবন চাই, আলোকিত জীবন চাই বলে চেঁচিয়ে গলা শেষ করে ফেলছি। আমরা সবকিছু চাই, কিন্তু পাওয়ার রাস্তাটা খুঁজে দেখি না। কারণ, ঘরের দুয়ার বন্ব্দ রেখে এই চিত্কার-চেঁচামেচি করে কী লাভ? আর ঘরের দুয়ার বন্ব্দ থাকবেই বা না কেন? আমরা যে এখনও ঘুম থেকেই জেগে উঠতে শিখিনি। পাঠক এবার ভাবছেন, এটা আবার কি ধরনের কথা? না জাগলে উনিই বা লিখছেন কি করে আর আমরাই বা পড়ছি কী করে? আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আপনাদের জানাতে বাধ্য হচ্ছি, আমি কিছুই লিখছি না এবং আপনারাও কিছুই পড়ছেন না। সাদা কাগজের ওপর কিছু অক্ষর গুছিয়ে বসে থাকলেই যেমন তা লেখা হয় না, হয় না তেমনি পড়াও। তাই যদি হতো তাহলে আর অফিসের কর্মকর্তাটিকে সকাল ন’টার কাজ দুপুর একটায় হাই তুলতে তুলতে স্লো মোশনে অলস ভঙ্গিতে অফিসের ফাইল খুলতে দেখতাম না। দেখতাম না সকাল সাতটায় মিরপুর থেকে বাসে উঠে কি করে সকাল এগারটায় বা তারও পরে মতিঝিলে গিয়ে পৌঁছাই। দেখতাম না একটা পোসিল্টং অর্ডার বা পেনশন অর্ডারের জন্য কি করে দিনের পর দিন আমাদের অপেক্ষা করতে হয়। দেখতাম না ডাক্তারের চেম্বারে কীভাবে জরুরি রোগীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। দেখতাম না সরকার বদলের সঙ্গে কি করে জমির হাত বদল হয়, হলের সিট বদল হয়, আমরা বোকার মতো হাঁ করে ঘুম ঘুম চোখে চেয়ে থাকি। দেখতাম না, যে ওষুধ জীবন বাঁচাবার জন্য তৈরি করে, সেটাই এখন মৃত্যু ডেকে আনে। দেখতাম না রাজনীতিবিদদের কাজের চেয়ে কথার ফুলঝুরি কি করে বাতাসে ফুর ফুর করে ঘুরে বেড়ায়।
বেশ কয়েক বছর আগে শিল্পকলা একাডেমিতে দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে একটা চমত্কার প্রদর্শনী দেখানো হয়েছিল। আধুনিক পেইন্টিংয়ের পাশাপাশি কিছু উত্তরাধুনিক পেইন্টিংও ছিল। সেই উত্তরাধুনিক পেইন্টিংয়ের একটিতে অডিও ভিজ্যুয়াল পদ্ধতির মাধ্যমে একটা অনন্য সাধারণ প্রদর্শনী ছিল। একটা বড় স্কিদ্ধনের ওপর বিশাল একটা মনুষ্যমুখ একটু কাঁত করে শুয়ে আছে। লোকটির চোখ বেশিরভাগ সময় বন্ব্দ থাকে, মাঝে মাঝে হঠাত্ চোখ দুটো খোলে, চারদিকে তাকায় আবার বন্ব্দ করে। সেই বিশাল মুখের ওপর একটি ছোট্ট শিশু কান্নারত অবস্থায় একই জায়গায় হামাগুড়ি দেয়। সেই কান্নার শব্দে লোকটির মুখের অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করি না। শিশুটি হামাগুড়ি দিতে দিতে কেঁদে চলে, লোকটি নির্বিকার সেইভাবে চোখ বন্ব্দ করে রাখে, শুধু মাঝে মাঝে হঠাত্ চোখ খুলে আবার বন্ব্দ করে ফেলে। যদিও প্রদর্শনীটি ধনী এবং গরিব দেশের অবস্থান বোঝাবার অর্থে দেখানো হয় কিন্তু আজ সেই প্রদর্শনীর সঙ্গে আমাদের দেশের অবস্থানের কোথায় যেন একটা যোগসূত্র খুঁজে পাই। সেই ছোট্ট শিশুটি যেন আমাদের দেশের অসহায় নাগরিকবৃন্দ আর সেই গালিভার আকৃতির মুখটি যেন আমাদের ক্ষমতাবান গুটিকয়েক শাসকবৃন্দ, যারা অসহায় নাগরিকদের অসহায়ত্ব দেখেও চোখ বন্ব্দ করে থাকে। তবে কবি নজরুলের খুকুমণি সত্যি সত্যি ঘুমালেও বাস্তবের খোকা-খুকুদের মধ্যে দুই ধরনের ঘুম দেখা যায়। এক. যারা সত্যি সত্যি ঘুমান, অর্থাত্ অসহায় নাগরিকবৃন্দ আর দুই. যারা জেগে জেগে ঘুমান এবং যে শ্রেণীটি আরও বেশি ভয়ঙ্কর। নাগরিক ঘুমায়, জেগে উঠলেও কোনো লাভ নেই, কারণ তাদের অসহায় আর্তি কেউ কোনোদিন শোনেনি, শোনে না, শুনবেও না। তাদের সমস্যার কথা সেই কবে থেকে বলে বলে, লিখে লিখে শুধু কথার খরচ আর কাগজের ব্যয় ছাড়া আর কিছু হয়নি। আবার রবীন্দ্রনাথের ‘একলা চলো’ নীতিতে চলতেও তারা ভয় পায়। পাছে তার মৌলিক অধিকার থেকে শুরু করে নাগরিকটুকুও হারাতে হয়। আর যারা জেগে ঘুমান? এদের ঘুমটাকে বরং দাপটি ঘুম বলা চলে। দাপট কেন? কারণ এরা তো জেগে ঘুমানই এবং সঙ্গে এটাও জানান দেন যে, তাদের মতো অতন্দ্রপ্রহরী, দেশপ্রেমী খুব কম আছেন এই দেশে। তারা না থাকলে দেশের অস্তিত্বই থাকবে না। তারা ছিলেন এবং আছেন বলেই দেশ স্বাধীন হওয়া থেকে শুরু করে এখনও দেশটা টিকে আছে। অর্থনীতির ভাষায় যেমন বলা হয়, একজন লোক বা একটি প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হতে পারে, কিন্তু একটা দেশ কখনও দেউলিয়া হয় না। অর্থাত্ টিকে থাকে। কিন্তু এটা কোন ধরনের টিকে থাকা? জেনেশুনে নিজের পানির ভাগ অন্যকে দিয়ে দেয়ার মধ্যে টিকে থাকা? আলো দেব অর্থাত্ বিদ্যুত্ দেব বলে নিজের তেল-গ্যাস, অন্যের হাতে সঁপে দেয়ার মধ্যে টিকে থাকা? শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার নাম করে ছোট অসহায় গরিব শিশুদের নামে টাকা আত্মসাত্ করার মাধ্যমে টিকে থাকা? আমার বাড়ির আঙ্গিনা দিয়ে বিনে পয়সায় আমার রাস্তা অন্যকে ছেড়ে দেয়ার মাধ্যমে টিকে থাকা? এ যেন আছি আছি এবং নেই নেই—এই দুই অবস্থানে বাস করা। ঘুম মানে বোধহীন অবস্থান। ঘুম মানে চুপ করে থাকা। ঘুম মানে জেনেও না জানার ভান করা। ঘুম মানে দেখেও না দেখার ভান করা। আমরা আর কিছু না পারি, ভান করতে পারি বড়। ভান করতে পারি বলেই বসার ঘরটাকে এত সুন্দর করে সাজাই। বাড়ির বাকি ঘর শত নোংরা থাক, তাতে কিছুই এসে যায় না। কারণ, বসার ঘরের সঙ্গে বাইরের লোকদের লোক-দেখানো একটা সম্পর্ক থাকে। কিন্তু একবারও ভেবে দেখি ভেতরের নোংরা একদিন সত্যি সত্যি বাইরের লোকের সামনে চলে আসতে পারে? আর পারে বলেই ১/১১’র মতো ঘটনা হঠাত্ থলের ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে দেখা যায়, যা একটা অনুন্নত দেশকে আরও দশ-বিশ বছর পিছিয়ে দেয়। কিন্তু তখন ঘুম থেকে জেগে উঠলেই কী আর না উঠলেই কী, যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আর সেই কারণেই এই লেখার উদ্যোগ। এভাবে ঘুমিয়ে সময়ের অপচয় করলে শুধু ১/১১ কেন, হয়তো দেখা যাবে এর চেয়েও আরও বড় কোনো ক্ষতি বাংলাদেশের হয়ে গেছে। তখন শত জেগে থেকেও হয়তো আমরা আর আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমির মর্যাদা ধরে রাখতে পারব না। আমাদের যা কিছু সামান্য সম্পদ আছে তা বেহাত হয়ে যাবে এরকম বাংলাদেশের স্বপম্ন নিয়ে নিশ্চয়ই আমরা একত্তরে যুদ্ধ করিনি। আমরা তো কম ঘুম ঘুমালাম না। সেই স্বাধীনতার পর থেকে তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কাটালাম এই আটত্রিশটা বছর। আটত্রিশ বছর একজন মানুষের জন্যই অনেক সময়, আর একটা দেশের জন্য? মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। প্রবন্ব্দের শুরুতে তাই ভোর নিয়ে এত দুঃখ-বেদনা করার এটাই কারণ। প্রকৃতি তার স্বাভাবিক নিয়মে ভোর নিয়ে আসে, কিন্তু আমাদের ঘুম না ভাঙলে ভোর হবে কি করে? আর তাই কবি নজরুলের আরেকটা কবিতায় কবিকে বলতে দেখি—‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?’ এই অসাধারণ বাক্যটা আমরা বার বার পড়ে, মুখস্থ করেও কোনোদিন আত্মস্ত করতে পারলাম না। পারিনি বলেই আমাদের জীবনে আজও সকাল আসেনি। সকাল আসেনি বলে আমরা অন্ব্দকারে নিমজ্জিত মানুষের মতো কেউ ঘুমিয়ে কাটাই, কেউ বা জেগে ঘুমাই। কিন্তু এভাবে বেশিদিন ঘুম ঘুম খেলা খেললে শেষে ভানুর কৌতুকের মতো আমরা বলতে থাকব—‘দেখি না কী করে’ আর ওদিকে চোর এসে আমার বাড়ির সব জিনিসপত্র চুরি করে ঘর ফাঁকা করতে থাকবে, তখনও আমরা বলতে থাকব—‘দেখি না কী করে।’ এখন আপনারাই বলুন, এভাবে দেখে যাওয়া কি আমাদের ঠিক হচ্ছে?

No comments

Powered by Blogger.