শেয়ারবাজারে ক্ষমতাধর মালিকের দুর্বল কোম্পানি

মালিক প্রচণ্ড দাপুটে। ব্যবসায়ী কমিউনিটি এবং রাজনৈতিক অঙ্গনেও রয়েছে ব্যাপক প্রভাব। কিন্তু এসব ক্ষমতাধর মালিকের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি অত্যন্ত দুর্বল। বছরের পর বছর বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ দেয়া হয় না। লোকসানি এসব প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়েছে কয়েকশ’ কোটি টাকা। বার্ষিক সাধারণ সভাও (এজিএম) হয় না। আর্থিক রিপোর্টে নেই কোনো স্বচ্ছতা। শুধু নামেই টিকে আছে এসব কোম্পানি। এ ধরনের কোম্পানির শেয়ার কিনে প্রতিদিনই ঠকছেন বিনিয়োগকারীরা। এসব মালিকের মধ্যে রয়েছেন- ব্যবসায়ী নেতা সালমান এফ রহমান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেকসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি। ক্ষমতাধর এসব উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। স্টক এক্সচেঞ্জের নেতারাও ভয়ে কথা বলেন না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কোম্পানি আইনে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। তিনি বলেন, যেহেতু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বেশি, তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মিলে এসব মালিককে দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারেন। তবে উদ্যোক্তাদের নির্ধারিত পরিমাণ শেয়ার না থাকলে তাদের বিরুদ্ধে বিএসইসি ব্যবস্থা নিতে পারে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসায়ী নেতা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন কোম্পানি বেক্সিমকো সিনথেটিকস। ৮৬ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানির বর্তমানে ব্যাংক ঋণ ৭৬ কোটি টাকা। ১৯৯৩ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় এ প্রতিষ্ঠান। আর প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনও বিনিয়োগকারীদের নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি। জেড ক্যাটাগরির (দুর্বল) এ প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ ২০১২ সালে ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছে। এরপর ৫ বছরেও বিনিয়োগকারীদের কিছুই দিতে পারেনি। আলোচ্য সময়ে প্রতিবছরই লোকসান দিচ্ছে এ প্রতিষ্ঠান। ২০১৭ সালে কোম্পানির ১০ টাকার শেয়ারের বিপরীতে লোকসান ২ টাকা ৬২ পয়সা। প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি শেয়ারের সর্বশেষ মূল্য ১২ টাকা। কোম্পানির ৬৫ শতাংশ শেয়ারই সাধারণ বিনিয়োগকারী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাতে। অর্থাৎ এই কোম্পানি দেউলিয়া হলে মালিকপক্ষের চেয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আর ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেয়ায় মুদ্রা বাজারেও সংকট সৃষ্টি করেছে এ প্রতিষ্ঠান। অথচ মালিক হিসেবে সালমান এফ রহমানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। চীনভিত্তিক সংস্থা হুরুন গ্লোবালের জরিপ অনুসারে বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় উঠে এসেছে তার নাম। ওই তালিকা অনুসারে সালমান এফ রহমানের সম্পদের পরিমাণ ১৩০ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন জিএমজি এয়ারলাইন্স প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে শেয়ারবাজার থেকে ৩শ’ কোটি টাকা নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। কয়েকটি কোম্পানি একীভূত করে অতিরিক্ত শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা নিয়েছেন তিনি। এসব ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিএসইসি। ১৯৯৬ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি মামলার অন্যতম আসামি তিনি। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান যুগান্তরকে বলেন, বেক্সিমকো সিনথেটিকস পণ্য উৎপাদনের জন্য আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। বিগত বছরগুলোয় বিদেশ থেকে বেশি দামে কাঁচামাল আনতে হয়, ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া গ্যাসের দাম ও শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানির খরচ বেড়েছে। পাশাপাশি দেশীয় বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় পণ্য বাকিতে বিক্রির কারণে ক্যাশ ফ্লো কমে গেছে। এ কারণে কয়েক বছর কোম্পানি লোকসান দিচ্ছে। ফলে লভ্যাংশ ঘোষণা করা সম্ভব হচ্ছে না। ডিএসইতে তালিকাভুক্ত আবদুল আউয়াল মিন্টুর পারিবারিক কোম্পানি দুলামিয়া কটন। ৭ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানি ১৯৮৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের লোকসান ৩০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাংক ঋণ রয়েছে ৮ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ১০ বছরেও বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ দিতে পারেনি। জেড ক্যাটাগরির এ প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি ১০ টাকার শেয়ারের বিপরীতে ২০১৭ সালেই লোকসান প্রায় ৪ টাকা। তবে পরিশোধিত মূলধন কম হওয়ায় বাজারে এ প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার ৪৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আইন অনুসারে মালিকপক্ষের ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এ কোম্পানির আছে মাত্র ২১ শতাংশ। বাকি ৭৯ শতাংশ শেয়ার বিনিয়োগকারীদের হাতে। কিন্তু মালিক হিসেবে আবদুল আউয়াল মিন্টুর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। তিনি মাল্টিমড গ্রুপের চেয়ারম্যান। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি তিনি। এ ছাড়া ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির সভাপতি, গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি, ভারত বাংলাদেশ চেম্বারসহ অসংখ্যা ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচারের দায়ে পানামা পেপারসে নামও এসেছে তার। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেন না। বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কোনো কোম্পানি আইন ও নীতিমালা ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর বাইরে কোম্পানির পারফরম্যান্স খারাপ হলে বিএসইসির কিছু করার নেই। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ঢাকা ডাইং।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। জেড ক্যাটাগরির এ প্রতিষ্ঠানটি ২০০৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৪৩ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানও কখনো নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়া হয়েছে। ১০ টাকার শেয়ারের সর্বশেষ বাজারমূল্য ৯ টাকা। অর্থাৎ অনেকটা দেউলিয়ার পথে এ প্রতিষ্ঠান। এ কোম্পানিতেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ৫০ শতাংশের বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্তির পর এসব উদ্যোক্তা শেয়ার বিক্রি করে চলে যান। ফলে এদের কোনো দায় থাকে না। সামান্য কিছু শেয়ার নিয়ে কোম্পানির মালিকানা ধরে রাখেন। ফলে শেয়ার বিক্রির সময় এদের বাধা দেয়া উচিত। তিনি বলেন, এমন একটি আইন করে দিতে হবে কোম্পানি তালিকাভুক্তির ১৫ বছরে কেউ শেয়ার বিক্রি করতে পারবেন না। তার মতে, বাংলাদেশে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নিয়ে কেউ এত বেশি ভাবে না। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বিডি থাই অ্যালুমিনিয়াম। ১১৫ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। বি-ক্যাটাগরির এ প্রতিষ্ঠানটিতে মালিকদের শেয়ার মাত্র ২৩ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালে মাত্র ৫ শতাংশ বোনাস দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর কোম্পানি এপেক্স ফুটওয়্যার। ১১ কোটি টাকা মূলধনের প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৮৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ মূলধনের ৮০ গুণ ঋণ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ঋণ ঝুঁকিতে থাকা এ কোম্পানিতে মালিকপক্ষের শেয়ার মাত্র ১৯ শতাংশ। ডিএসইর পরিচালক মো. রকিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো কম্প­ায়েন্স না মানলে শেয়ারবাজারের উন্নয়ন হবে না। তিনি বলেন, কোম্পানির উদ্যোক্তারা বিনিয়োগকারীদের নিয়ে ভাবেন না। ফলে এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও সিটি ব্যাংকের পরিচালক দীন মোহাম্মদের কোম্পানি অ্যাপোলো ইস্পাত। প্রতিষ্ঠানটিতে উদ্যোক্তাদের শেয়ার মাত্র ২১ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যাংক ঋণ রয়েছে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি আইপিওর (প্রাথমিক শেয়ার) মাধ্যমে ২২ টাকায় তালিকাভুক্ত হলেও বর্তমানে শেয়ারের দাম ১৪ টাকায় নেমে এসেছে। এ ছাড়া তালিকাভুক্তির পর দাম কমেছে এ ধরনের কোম্পানির মধ্যে ওবায়দুল করিমের মালিকানাধীন কোম্পানি ওরিয়ন ফার্মা, সাবেক মন্ত্রী ফারুক খানের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একত্রিত হয়ে দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া প্রভাবশালীদের যেসব দুর্বল কোম্পানি রয়েছে তা হল- মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএফ কামালের প্রতিষ্ঠান মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজ, লকপুর গ্রুপের চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং।

No comments

Powered by Blogger.