দুই হাজার কোটি টাকা ঘাটতি মূলধন পরিশোধ

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে জনগণের করের দুই হাজার কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ এ অর্থ মোট ঘাটতির ১০ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর মোট মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ২০ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এবার ঘাটতি মূলধন হিসেবে সোনালী ব্যাংককে ৪০০ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংককে ৩০০ কোটি টাকা ও বেসিক ব্যাংককে ৩০০ কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংককে ৪০০ কোটি টাকা, রাজশাহী কৃষি ব্যাংককে ১৯৯ কোটি টাকা ও গ্রামীণ ব্যাংককে (পরিশোধিত মূলধনের সরকারি অংশ হিসেবে) ২১ লাখ টাকা দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে ঘাটতি মূলধন দেয়ার প্রস্তাব সম্প্রতি অনুমোদন দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণের একটি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলোর ঘাটতি মূলধন পূরণে ২০ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। চলতি বাজেটে এ খাতে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। সে ভিত্তিতেই ব্যাংকগুলোকে টাকা দেয়া হবে। ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ পর্যন্ত এই পাঁচ অর্থবছরে ঘাটতি মূলধন পূরণ বাবদ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মোট ১০ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা দেয়া হয়। এর মধ্যে গত অর্থবছর দুই হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়। এর আগের অর্থবছর (২০১৫-১৬) এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছর দুই হাজার ৪০০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা মূলধন ঘাটতি হিসেবে পরিশোধ করা হয়। এ ছাড়া ২০১৩-১৪ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে যথাক্রমে চার হাজার ৪০৯ কোটি টাকা ও ১৩ কোটি ২০ লাখ টাকা দেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রাক-বাজেট বৈঠকে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান বলেন, ব্যাংকগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ জনগণের করের টাকায় মূলধন জোগান দেয়ার রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন যুগান্তরকে বলেন, সরকারি টাকায় ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগান দেয়া হয়। আর ব্যাংক তা খেয়ে ফেলে। ফারমার্স ব্যাংক তাদের মূলধন খেয়ে ফেলেছে। ব্যাংকটিকে মরে যেতে দেয়া উচিত। জনগণের টাকায় এর মূলধন জোগান দেয়ার কোনো মানে হয় না। সাবেক অর্থ সচিব মতিউল ইসলাম বলেন, বেপরোয়া ঋণ দেয়ার মাধ্যমে মূলধন ঘাটতিতে আছে দেশের ব্যাংকিং খাত। এ জন্য আর্থিক খাতের সংস্কার জরুরি। এ সংস্কার ছাড়া উন্নয়নের সুফল মিলবে না। সূত্রমতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর আশঙ্কাজনক মূলধন ঘাটতি উল্লেখ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়, এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু তাই নয়, সভরেন রেটিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জানা গেছে, ব্যাংকগুলোকে দুই হাজার কোটি টাকা দেয়া হলেও প্রকৃত মূলধন ঘাটতির পরিমাণ আরও বেশি। মোট ২০ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতির কথা উল্লেখ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে অর্থ চেয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ছয় হাজার কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের এক হাজার ২৫০ কোটি টাকা ও বেসিক ব্যাংকের দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাত হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা, রাজশাহী কৃষি ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ২১ লাখ টাকা মূলধন ঘাটতি হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঘাটতি মূলধন দেয়ার পরিমাণ নির্ধারণের প্রস্তাব তৈরির আগে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইওদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব। এরপর প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করা হয়। সূত্রমতে, মূলধন ঘাটতির কারণ হিসেবে অর্থ বিভাগে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশমতে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বেসেল-২-এর নিয়ম অনুযায়ী ‘ভিন্ন কর সম্পদ স্থিতি’ রাখা এবং পুনর্মূল্যায়ন সংরক্ষণ মূলধন থেকে সমন্বয় করায় ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে। রূপালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে একই কারণ উল্লেখ করা হয়।
তবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে উল্লেখ করেছে বেসিক ব্যাংক। এ ছাড়া ভিন্ন কারণে ঘাটতি হচ্ছে বলে মত দিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি ব্যাংক। বিশেষায়িত এ দুটি ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, কৃষিঋণের ওপর সুদাসলে দ্বিগুণের অধিক সুদ আরোপ করা হচ্ছে না। উপরন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী আগের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ আদায় স্থগিত করে পুনরায় ঋণ বিতরণ করতে হয়। এতে ঋণ ব্যবস্থাপনার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার সঙ্গে মূলধন ঘাটতি সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া স্বল্পসুদে ঋণ দেয়ায় ব্যাংকের মুনাফা হ্রাস পায়, অপরদিকে অষ্টম বেতন স্কেল বাস্তবায়নে ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। এর প্রভাবে ঘাটতি মূলধন পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। মূলধন ঘাটতি প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়দুল্লাহ আল মাসুম যুগান্তরকে বলেন, মূলধন বড় সমস্যা নয়। মূল সমস্যা হল তারল্য সংকট। ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন পরিস্থিতি ভালো কিন্তু গ্রাহককে টাকা দিতে পারছে না। এর মূল কারণ হল তাদের তারল্য নেই। এতে প্রমাণ হয়- তারল্য সংকটে ব্যাংক দেউলিয়া হতে পারে। এদিক থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক নিরাপদ জোনে আছে। বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আউয়াল খান যুগান্তরকে বলেন, মূলধন ঘাটতি অধিকাংশ ব্যাংকেই আছে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ব্যাংকগুলো এককভাবে এটা অতিক্রম করতে পারবে, তা নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তা দরকার। সরকার যদি আইপিও ইস্যু করে তবে তা মূলধন ঘাটতি পূরণের বড় হাতিয়ার হবে। এটি করতে পারলে ব্যাংকগুলোর জন্য ভালো হবে।

No comments

Powered by Blogger.