ভালোবেসে মুসলিম হওয়ায় অপবাদ, অবশেষে হাদিয়ার জয়

ভারতের দক্ষিণী রাজ্য কেরালার ২৪ বছর বয়সী হিন্দু তরুণী অখিলা। মুসলিম যুবক সাফিন জাহানকে ভালোবাসতেন। তাকে বিয়ে করতে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন অখিলা। মুসলিম হিসেবে নিজের নাম রাখেন হাদিয়া৷ কিন্তু মুসলিম যুবককে ভালোবাসা ও নিজের মুসলিম হওয়াটা হাদিয়ার জন্য সহজ ছিল না। তাকে জঙ্গিবাদের অপবাদ দেন নিজের বাবা। আর হাইকোর্টও বাবার পক্ষেই রায় দেন। এ অবস্থায় দুই বছরের এক অসম সাহসের লড়াইয়ে নামেন হাদিয়া। যাতে জয়ী হয়ে জঙ্গিবাদের অপবাদ থেকে নিজেকে এবং স্বামীকে শুধু মুক্তই করেননি, ব্যক্তিস্বাধীনতার লড়াইয়ে নজিরও তৈরি করেন। এ জন্য ভারতজুড়ে প্রশংসিত হয়েছেন হাদিয়া। জানা গেছে, হাদিয়া প্রথমে হাইকোর্টের ধারস্থ হন। এর পর জাতীয় তদন্ত এজেন্সিতে। শেষে সুপ্রিমকোর্ট৷ এ সময় অসহ্য মানসিক চাপ ও হেনস্তা সহ্য করতে হয়েছিল হাদিয়াকে৷ তার বাবার অভিযোগ ছিল- কথিত লাভ জেহাদের জেরে তার মেয়েকে ফুঁসলিয়ে মগজ ধোলাই করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে৷ ইসলাম ধর্মগ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে৷ এটি মুসলিম মৌলবাদী কিছু গোষ্ঠীর লাভ জেহাদের চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়৷ এভাবে হিন্দু মেয়েদের ধর্মান্তরিত করে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধদীর্ণ দেশে পাচার করা হচ্ছে৷ এই অভিযোগের ভিত্তিতে কেরালা হাইকোর্ট হাদিয়ার বিয়েকে নিছক ধোঁকাবাজি বলে বাতিল করে দেন৷ হাদিয়াকে বাবার বাড়িতে থাকারও নির্দেশ দেন আদালত৷ যদিও হাদিয়া আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন- তিনি সাফিনকে বিয়ে করেছেন স্বেচ্ছায়, চাপে পড়ে নয়৷ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে হাদিয়ার স্বামী সাফিন সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেন৷ সুপ্রিমকোর্ট গত বছরের নভেম্বর মাসে কেরালা হাইকোর্টের রায় খারিজ করে হাদিয়াকে বাবার বাড়ির বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার অনুমতি দেন। তবে তাকে স্বামীর বাড়ির পরিবর্তে হোমিওপ্যাথি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে থেকে তার পড়াশোনা শেষ করার অনুমতি দেন৷ কিন্তু হাদিয়ার কাছে এ রায় সন্তোষজনক মনে হয়নি৷ তার দাবি প্রাপ্তবয়স্ক নারী হিসেবে তিনি কেন স্বামীর সঙ্গে থাকার অধিকার পাবেন না? এটি তার ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্ন৷ অবশেষে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে গঠিত তিন বিচারকের বেঞ্চ রায় দেন- ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী হাদিয়ার বিয়ে সঙ্গত ও বৈধ৷ তাই স্বামীর সঙ্গে থাকার অধিকার হাদিয়ার আছে৷ এই রায়ে অসন্তুষ্ট পিতার প্রতিক্রিয়া, তিনি রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করবেন৷
তার মেয়েকে তিনি মনে করেন তুলে দেওয়া হল এক সন্ত্রাসবাদীর হাতে৷ তিনি এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই এখনও চালিয়ে যাবেন, জাতীয় তদন্তকারী এজেন্সি-এনআইএকে দিয়ে বিশদ তদন্তের দাবি জানাবেন৷ হাদিয়ার আইনি লড়াই সম্পর্কে গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা সংস্থার জেনারেল সেক্রেটারি ধীরাজ সেনগুপ্ত বলেন, এটি সারা দেশে সাড়া জাগানো একটি মামলা৷ যদিও শেষমেষ সর্বোচ্চ আদালত হাদিয়ার বিয়েকে স্বীকৃতি দিয়েছেন৷ এটিকে ধর্মনিরপেক্ষতার নজির বলে ধরা যেতে পারে৷ তিনি বলেন, তবে প্রশ্ন উঠেছে- একই আইন একটি হাইকোর্ট, যেটিকে তো কম বলা যাবে না- সেই বিয়েটি মানল না কেন? আলোচনার সূচিতে প্রায় উঠে আসছে বিচার বিভাগে সাম্প্রদায়িকতার ছায়া পড়ছে কিনা৷ প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে৷ শুধু তাই নয়, আঙুল উঠছে বিচার বিভাগের ওপর সরকারের প্রভাব খাটানোর দিকে৷ তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও অনেকটা প্রশ্নচিহ্নের মুখে৷ তাই হাদিয়ার কেসটা অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ৷ ধীরাজ সেনগুপ্ত বলেন, এ রকম আরও অনেক কেস আছে৷ যেমন রাজস্থানে যদি উঁচু জাতের পুরুষ নিচু জাতের কোনো নারীকে ধর্ষণ করে, তা হলে সেটি ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে না৷ সুপ্রিমকোর্টের রায় হাদিয়ার পক্ষে গেলেও বিচার বিভাগের রাজনীতিকরণ হচ্ছে, হিন্দুত্ববাদের ছাপ পড়ছে, যেটি যথেষ্ট চিন্তার কারণ৷ অন্যদিকে হাদিয়া মর্যাদাহানি ও দীর্ঘ দুই বছর ধরে মানসিক ধকল এবং হয়রানির জন্য কেরালা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন৷ তিনি বলেন, আমার জীবন থেকে অতিমূল্যবান দুটি বছর খোয়া গেছে৷ বাবার কাছে সে ক্ষতিপূরণ চাইনি৷ কারণ তার ধারণা, তার বাবা-মাকে কিছু কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে তাদের ওপর প্রভাব খাটিয়েছিল৷ হাদিয়ার স্বামী সাফিন জাহান বলেন, সুপ্রিমকোর্টের রায়ের প্রভাব থিতিয়ে যাওয়ার পর তিনি হাদিয়ার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন৷ কারণ ইসলাম গুরুজনদের শ্রদ্ধা করতে শেখায়৷ সূত্র: ডয়েচে ভেলে।

No comments

Powered by Blogger.