আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন আইনের ব্যত্যয় ঘটেছিল কি? by সাহাবউদ্দিন আহমেদ

নেপালের কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ গত সোমবার বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকে নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বৈশিষ্ট্য নিয়ে নানারকম আলোচনা চলছে। লক্ষ করা যাচ্ছে, কোনো কোনো আলোচক ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দর হিসেবে বর্ণনা করছেন। প্রকৃতপক্ষে এ বিমানবন্দরকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করার পরিবর্তে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিমানবন্দর হিসেবে বর্ণনা করলেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। অর্থাৎ ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বৈশিষ্ট্য অন্য আর দশটি দেশের বিমানবন্দরের বৈশিষ্ট্য থেকে একেবারে আলাদা। কাজেই এ বিমানবন্দরে বিমান অবতরণকালে পাইলট কর্তৃক বিশেষ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে, এ সম্পর্কে পাইলট, কো-পাইলটসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আগেই বিস্তারিত জানানো হয়। সাধারণত যেসব পাইলটের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় ঘাটতি রয়েছে, তেমন পাইলটদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিমানবন্দরে অবতরণের কাজে যুক্ত করা হয় না। এ ধরনের বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ অবতরণের ক্ষেত্রে পাইলটের পাশাপাশি কো-পাইলটকেও সমান দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়। যে কোনো কারণে পাইলট কোনো সমস্যার মুখোমুখি হলে কো-পাইলটকেই সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। অবশ্য উড়োজাহাজ চালনার ক্ষেত্রে পাইলট ও কো-পাইলটের একইরকম দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি সাধারণ নিয়মের মধ্যেই পড়ে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার পর সবার মনে যেসব প্রশ্ন ভিড় করছে তার অন্যতম হল- অবতরণের আগে পাইলট ও এয়ারট্রাফিক কন্ট্রোলারের মধ্যে কী কথোপকথন হয়েছিল? উড়োজাহাজের ব্ল্যাকবক্সের তথ্য থেকেই এসব প্রশ্নের জবাব মিলবে। অবতরণের আগে পাইলটকে কী কী নিয়ম মানতে হয়, সাধারণ পাঠকের কারও কারও এ বিষয়টি অজানা থাকতেই পারে। যারা জানেন না তাদের উদ্দেশে বলছি, কোনো বিমানবন্দরে অবতরণের আগে পাইলট এয়ারট্রাফিক কন্ট্রোলারের নির্দেশ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করেন। অর্থাৎ পাইলট এয়ারট্রাফিক কন্ট্রোলারের বার্তা অনুসরণ করেই বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। অনেক সময় এয়ারট্রাফিক কন্ট্রোলার কর্তৃক প্রেরিত বার্তা অনুসরণ করা পাইলটের পক্ষে অসম্ভব হলে পাইলটের সামনে জরুরি অবতরণ ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না।
আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের আইন অনুযায়ী আকাশে থাকা কোনো উড়োজাহাজ জরুরি অবতরণের অনুমতি চাইলে তাৎক্ষণিকভাবে ওই উড়োজাহাজটির অবতরণের ব্যবস্থা করে দিতে হয়। দুর্ঘটনাকবলিত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজটির অবতরণে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন আইনের ব্যত্যয় ঘটেছিল কিনা তদন্তে তাও পরিষ্কার হবে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে উড়োজাহাজ থেকে রানওয়ে দেখা না গেলে পাইলটরা ইন্সট্র–মেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেমের (আইএলএস) মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উড়োজাহাজের মনিটরে রানওয়ে দেখতে পান এবং রানওয়েবিষয়ক সব তথ্যও জানতে পারেন। নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের কোনো প্রান্তেই ইন্সট্র–মেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম নেই। এই বিমানবন্দরের পাশে পাহাড়ের অবস্থান এবং আইএলএস না থাকা- এসব কারণেও এখানে বিমান অবতরণে নানারকম জটিলতা দেখা দেয়। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের কেবল দক্ষিণ প্রান্তে বেতার তরঙ্গের সাহায্য নিয়ে অবতরণ করা যায়। এ বিমানবন্দরের রানওয়ের উত্তর প্রান্তে এ সুযোগটিও নেই। অর্থাৎ উত্তর প্রান্তে উড়োজাহাজ অবতরণে পাইলটকে পুরোপুরি নিজ দায়িত্বে রানওয়ে দেখে উড়োজাহাজ অবতরণ করাতে হয়। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ অবতরণে এয়ারট্রাফিক কন্ট্রোলারের ওপর পুরোপুরি নির্র্ভর করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে বার্তা প্রেরকের ভুল কিংবা পাইলটের শ্রবণজনিত ত্র“টির কারণেও নানারকম সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো ভুল-ত্রুটি হয়েছিল কিনা এটাও তদন্ত শেষে স্পষ্ট হবে। ত্রিভুবন বিমানবন্দরে রানওয়ের পাশেই রয়েছে পাহাড়, যার কারণে অবতরণের সময় পাইলটদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হয়। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ অবতরণের ক্ষেত্রে আশপাশের ভৌগোলিক পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনায় না রাখলে উড়োজাহাজ অবতরণে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এ বিমানবন্দরে বিমান অবতরণের অনেক আগেই পাইলটসহ সংশ্লিষ্ট সবার নেপালের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানা হয়ে যায়। কোনো উড়োজাহাজ মাটি থেকে কয়েক হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় কোনো একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে যেতে পারে কিংবা কোনো একটি ইঞ্জিনে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে পাইলট বিকল হওয়া ইঞ্জিনটি বন্ধ করে দেন। তখন অন্য এক বা একাধিক ইঞ্জিনের মাধ্যমে পাইলট উড়োজাহাজটিকে নিয়ে কাছাকাছি কোনো বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। কখনও কখনও উড়োজাহাজের অবতরণকালে চাকা বের না হওয়ার ঘটনাও ঘটে। তখন চাকা ছাড়াই বিশেষ কায়দায় উড়োজাহাজ অবতরণ করানো যায় এবং যাত্রীদের নিরাপদে বের করা সম্ভব হয়। এতে অবশ্য উড়োজাহাজের কিছুটা ক্ষতি মেনে নিতে হয়। এ ছাড়া কোনো উড়োজাহাজ উড্ডয়ন বা অবতরণকালে কোনোরকম জটিলতা দেখা দিলে কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে এ সম্পর্কে পাইলটকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পাইলট তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে মুহূর্তে পরিস্থিতি মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেন। আমাদের জানামতে, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের দুর্ঘটনাকবলিত উড়োজাহাজের প্রধান পাইলটের দীর্ঘদিনের বিমান চালনার অভিজ্ঞতা ছিল। গত সোমবার কোন পরিস্থিতিতে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে, ব্ল্যাকবক্সের তথ্য বিশ্লষণে তার বিস্তারিত জানা যাবে।
ক্যাপ্টেন সাহাবউদ্দিন আহমেদ, বীর-উত্তম : ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি

No comments

Powered by Blogger.