ভেজাল খাদ্যপণ্যে বাজার সয়লাবঃ স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে

টায় বালি, চালে কাঁকর, দুধে পানি, মধুতে চিনি- এসব নিয়েই এখন আমাদের জীবনযাপন। যাবতীয় খাবার, পানীয়, জীবন রক্ষাকারী ওষুধপথ্যসহ সব রকম ব্যবহার্য জিনিসের কোনোটি আর অকৃত্রিম নেই। এমনকি ভেজাল করতে যা ব্যবহার করা হয় তাও খাঁটি নয়। 'বিষেও ভেজাল' বলে একটা কথা প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে আমাদের দেশে। তবে সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য ও ওষুধের ভেজাল। এসব ভেজাল দ্রব্য সরাসরি স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।


বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং গণসচেতনতার অভাবে দেশে ভেজাল পণ্যের বাজার ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। সরকারের ভেজালবিরোধী অভিযান শিথিল হওয়ার সুযোগে ভেজাল পণ্যের উৎপাদন, মজুত, বিপণন বেড়ে চলছে। বিষাক্ত ভেজাল খাদ্যপণ্যে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহর এখন সয়লাব। এসব পণ্য চলে যাচ্ছে গ্রামগঞ্জে। আবার গ্রামগঞ্জ থেকে আসছে শহরের বাজারে। তবে বড় ধরনের ভেজাল কারখানাগুলোর সবই শহরে অবস্থিত। জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার লোকজন বাজার থেকে প্রতিদিন যা কিনছে বিশেষ করে খাদ্যপণ্য তার ৯৬ থেকে ৯৭ ভাগই ভেজাল এবং খাবার অনুপযোগী। গত ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে তিনটি অননুমোদিত ঘি কারখানায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ ট্রাক সমপরিমাণ নিম্নমানের ঘি আটক করেছে মোবাইল কোর্ট। অভিযানে এসব ঘি জব্ধ করে কারখানাগুলো সিল করে দেয়া হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এদিকে বগুড়ায় নিম্নমানের ভেজাল লাচ্ছা সেমাই কারখানার হদিস মিলেছে। একটি কারখানা থেকে ভেজাল দুই হাজার কেজি লাচ্ছা সেমাই এবং ১৬০ কেজি চিনি জব্ধ করে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। জেল-জরিমানাও করা হয়েছে। এভাবে মাঝেমধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান চললেও কোনোক্রমেই ভেজালকারীদের দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। কিছুদিন আগে মেলামিনযুক্ত গুঁড়োদুধ নিয়ে দেশজুড়ে হৈ চৈ পড়েছিল। এরপর নগরবাসী তরল দুধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু অনেক ব্যবসায়ী তরল দুধেও লাশ সংরক্ষণে ব্যবহৃত ফরমালিন এবং অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিক মিশিয়ে দিনের পর দিন দুধ 'টাটকা' রেখে বিক্রি শুরু করে। সাধারণ ব্যবসায়ীরা তো হামেশাই দুধে খালবিলের নোংরা পানি পর্যন্ত ব্যবহার করে থাকে। মাছ, শাকসব্জি এবং ফলমূলে ফরমালিন মেশানোর ব্যাপারটি এখন আর কারও অজানা নয়। ঘিতে দুধ নেই, সুগন্ধি আছে। সাবানে ব্যবহৃত চর্বিতে ভাজা হচ্ছে লাচ্ছা। এছাড়া দই, মিষ্টি, ইফতার সামগ্রীসহ বিভিন্ন ফাষ্টফুডে ক্ষতিকর রঙ মিলিয়ে বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। এদিকে মিনারেল বা ফিল্টার ওয়াটারের নামে বোতলজাত করে বিক্রি হচ্ছে ওয়াসার পানি। অভিযোগ আছে, ওয়াসার কিছু লোকও নাকি এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অনেকে আবার না জেনে, না বুঝে বাজার থেকে ভেজাল দ্রব্য কিনে তৈরি করছে বিষাক্ত খাদ্যদ্রব্য। বিষাক্ত রাসায়নিক 'কার্বাইড' মিশিয়ে ফলফলারি পাকানো হচ্ছে। রমজানে ঠান্ডা জুস ও সরবত নামের পানীয় পান করে অনেককেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। বস্তুত প্রতিদিন আমরা কমবেশি বিষ খাচ্ছি। দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন থাকলেও তা কাজে লাগছে না। গত জানুয়ারিতে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে প্রতি জেলায় স্বতন্ত্র আদালত (ফুড কোর্ট) স্থাপন করতে সরকারকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এছাড়া দেশে পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী খাদ্য নিরাপত্তা তথা খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধের আইন বহাল রয়েছে। সে অনুযায়ী অনেক সময় ভেজালবিরোধী অভিযানও চলছে। কিন্তু অসৎ মুনাফাখোরদের তৎপরতা এতটাই বেড়েছে যে, অনেকে সরকারের অনুমতি ছাড়াই রীতিমতো ভেজাল খাদ্যপণ্যের কারখানা খুলে বসেছে। এ অবস্থায় গণসচেতনতা ছাড়া কেবল মোবাইল কোর্ট বসিয়ে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ সহজ কাজ নয়। তবে ভেজালবিরোধী অভিযান একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হিসেবে সক্রিয় থাকলে ভেজাল খাদ্যপণ্যের উৎপাদন, বেচাকেনা কমতে বাধ্য। এজন্য সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরীক্ষাগার, জাতীয় খাদ্য পরামর্শক পরিষদ, বিএসটিআইকে সমৃদ্ধ করতে হবে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও লোকবল দিয়ে। ভেজালকারীদের শাস্তির আরও কঠোরতর করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবার সাহসী ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। এক্ষেত্রে অবহেলা মানে ভোক্তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া এবং ভেজালকারীদের তৎপরতা অব্যাহত রাখার সুযোগ সৃষ্টি করা।

No comments

Powered by Blogger.