জ্ঞানই শক্তি by আতাউর রহমান

কোনো এক পত্রিকা সম্প্রতি আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। একটি প্রশ্ন ছিল মঞ্চ নাটকের সমকালিনতা বিষয়ক। আমি সাক্ষাৎ গ্রহণকারীকে বলেছিলাম, সমকালিনতা ও প্রাসঙ্গিকতা সমার্থক নয়। সমকালীন অর্থ বর্তমান সময়ের ঘটনা, যাকে ইংরেজিতে আমরা বলি টপিক্যাল। প্রাসঙ্গিকতা অর্থবহতা ব্যক্ত করে। পুরনো একটা ঘটনা ও বচন আজকের এ আধুনিক যুগেও প্রাসঙ্গিক হতে পারে। কথায় কথায় পুরাণ, কল্পকথা ও মহাকাব্যের প্রসঙ্গ চলে এলো। উত্থাপিত হলো এপিক রিয়ালিটির প্রসঙ্গ, যাকে মহাকাব্যিক বাস্তবতা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
উদাহরণস্বরূপ মহাভারতে বর্ণিত দুর্যোধনের উরুভঙ্গের প্রসঙ্গ টানা যায়। গদা যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধরত দুই সৈনিক কোমরের নিচে গদার আঘাত চালাতে পারে না। আধুনিক যুগের বক্সিং খেলায়ও শরীরের কোন্ কোন্ জায়গায় ঘুষি মারা যাবে অথবা যাবে না তার ব্যবস্থাপত্র দেয়া আছে। ভিম সেন প্রতিপক্ষ দুর্যোধনকে কোমরের নিচে গদা চালিয়ে তার উরু ভেঙে দিয়েছিল। যুদ্ধের নিয়মনীতিতে এ ছিল সম্পূর্ণ গর্হিত কাজ। তবুও এই অন্যায়টি ঘটে গেল। কৌরবেরা পান্ডবদের প্রতি অন্যায় করেছিল, কিন্তু অন্যায়কে কখনও আরেক অন্যায় দিয়ে স্থায়ীভাবে পরাভূত করা যায় না। তারপর একটা বচন চালু হলো-যুদ্ধে ও প্রেমে ন্যায়নীতির সীমা অতিক্রম করা যায়। মানুষ যুগ যুগ ধরে এভাবে নিজ স্বার্থে ন্যায়নীতিকে বিসর্জন দিয়েছে। পাশাপাশি একথাও সত্য, যিনি কোনো অন্যায় করেন, তার অন্তর্গত হৃদয়ের শান্তি বিঘ্নিত হয়। হোমারের ইলিয়ডেও এভাবে প্রাচীন ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা আজও খুঁজে পাওয়া যায়। কখনও কখনও তা রূপকের মোড়কে আবৃত থাকে। এই বিশ্বে যত কারিগরি বুৎপত্তিই বিজ্ঞানীরা দেখাক না কেন, তা কখনও একশ' ভাগ নিরাপদ নয়। উপগ্রহ, রকেট, এরোপ্লেনে এতসব নিরাপত্তার বেষ্টনী থাকা সত্ত্বেও দুর্ঘটনা ঘটেছে, যদিও তা সংখ্যায় কম। আরেকটি দেখার বিষয় হলো যে, বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার এত উন্নতি সত্ত্বেও আমরা আজও প্রাকৃতিক বিপর্যয় অথবা শক্তিকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত করতে সক্ষম নই। বন্যা, ঝঞ্ঝা, দাবানাল ইত্যাদি আমেরিকার মতো দেশকেও কাবু করে ফেলে। শক্তিমান মানুষের দেহে যেমন দুর্বল স্থানের অস্তিত্ব থাকে, তেমনি সুদৃঢ় স্থাপনায়ও ঠুনকো ও পলকা জায়গা থাকে। হোমারের ইলিয়ডের থেটিস পুত্র অ্যাকিলেসকে পবিত্র ষ্টাইক্স নদীতে জন্মের পর পরই ডোবানোর কারণে তিনি অবধ্য হয়ে গেলেন। তবে পায়ের গোঁড়ালি দুটো রয়ে গেল আঘাতের দুর্বল স্থান হিসেবে চিহ্নিত, কারণ তার মা জলদেবী থেটিস তাকে পায়ের গোঁড়ালি ধরে পবিত্র নদীতে ডুবিয়েছিলেন। ট্রয়ের যুদ্ধে তাকে পায়ের গোঁড়ালিতে হেক্টর ভ্রাতা প্যারিস তীর ছুঁড়ে হত্যা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মুক্তধারা' নাটকে মুক্তধারার বাঁধ যা গরিবের শস্য ক্ষেত্রের জল আটকিয়ে ছিল তার দুর্বল স্থাপনা অংশের খবর জানতেন রাজকুমার অভিজিৎ, যিনি নাটকের শেষ দৃশ্যে বাঁধ খুলে দেন এবং কৃষকদের শস্য ক্ষেত জলে ভরে যায়। তবে বাঁধ ভাঙা পানির তোড়ে তিনিও ভেসে যান। বেহুলা ও লখিন্দরের বাসরঘর ছিল সর্বভাবে নিশ্ছিদ্র, তবুও বিষাক্ত সাপ সেই গৃহে বাসর রাতে ঢুকে লখিন্দরকে ছোবল মেরে হত্যা করে। লোহার বাসরঘরের ছিদ্রপথের একটি স্থান মোম দিয়ে বন্ধ ছিল, সাপের উষ্ণ নিঃশ্বাসে তা গলে গিয়ে প্রবেশের পথ করে দেয়। আজকাল আধুনিক বিশ্বেও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, হয়ত ধরনটা বদলে গেছে। আমি একেই মহাকাব্যিক বাস্তবতা বলে আখ্যায়িত করি। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে বিপুলভাবে। একটি মাইক্রোচিপসের মধ্যে সারা বিশ্বকে ধরে রাখা যায়। আমার কাছে এ বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। এরপর যখন শুনি আমাদের গ্যালাক্সিতে কয়েক হাজার নভোমন্ডল আছে, যেখানে মানুষের কল্পনা পৌঁছায় না, তখন হতাশ হই বৈকি! আমাদের নভোমন্ডল যার কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য, তার রহস্য উদ্ঘাটন করতে আমরা আজও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা শক্তি, বিত্ত ও বুদ্ধির কত আসফালনই না করি, অথচ আমরা আজও কতটা অজ্ঞ রয়ে গেছি নানা বিষয়ে। পৃথিবীতে এত আবিষ্কারের পরও জীবন দর্শনের ক্ষেত্রে আমরা বিশ্ববাসীকে আজও তেমন নতুন কথা শোনাতে পারিনি। পুরনো বচনকেই নবব্যাখ্যায় প্রকাশ করে চলেছি মাত্র। আমি যে কথাটা বলতে চাই, মানুষের মধ্যে আদি যুগ থেকে সব বোধ, বুদ্ধি বা জ্ঞানের বীজ বপিত ছিল। সময়ের অগ্রযাত্রায় সেই জ্ঞান প্রকাশিত হয়ে চলেছে। সক্রেটিস ছিলেন পাশ্চাত্য দর্শনের আদি পিতা। তার পর পাশ্চাত্যের বিশ্বে বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান দার্শনিকের আগমন ঘটেছে যারা শুধু সক্রেটিসের দর্শনকে নবব্যাখ্যায় প্রকাশ করেছেন। তার দর্শন প্রচারে একটি হেঁয়ালিপনা, বক্রোক্তি, প্রচলিত মতের বিরোধিতা এবং অনেক সময় আত্মবিরোধিতা ছিল, তবু প্রায় সব সময় তিনি জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সত্য কথাই বলে গেছেন। তার দর্শনের মূলকথা ছিল নিজেকে ও অন্যকে প্রশ্ন কর এবং প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে তুমি নিজে সমৃদ্ধ হবে। আরেকটি বিষয় ছিল তার দর্শনের মূলে, তা হলো 'না' বাদের তত্ত্ব দিয়ে তিনি জগৎ ও জীবন দর্শনের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করা শুরু করতেন এবং ক্রমান্বয়ে নেতি থেকে ইতিতে উন্নীত হতেন। আমরা আধুনিককালের ইউরোপীয় দার্শনিক বার্টান্ড রাসেলের চিন্তায় সক্রেটিসের দর্শন-ভাবনার প্রতিফলন দেখতে পাই ভিন্নভাবে। তিনিও সন্দেহবাদ দিয়ে কোনো বিষয়কে পর্যালোচনা করতে ভালোবাসতেন এবং ক্রমান্বয়ে সন্দেহবাদ থেকে সার্বজনীন অনুমোদনের গন্তব্যে পৌঁছতেন। প্রশ্ন-উত্তরের পাশাপাশি সমালোচনারও একটি স্থান রয়েছে। সমালোচনা না হলে গণতন্ত্রও এগোয় না। সব কথার শেষ কথা, সেই পুরনো বচন, 'জ্ঞানই শক্তি'-এটাই আমাদের জীবনের মূল স্লোগান হোক। লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক

No comments

Powered by Blogger.