সেনা মোতায়েন না হওয়ায় উত্তপ্ত নারায়ণগঞ্জ

নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিন। প্রার্থী ও সমর্থকরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভোটারের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। সব মিলিয়ে শান্ত ও উৎসবমুখর পরিবেশ পুরো বন্দর নগরীতে। এরই মধ্যে সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা- ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন হচ্ছে না। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে শান্ত পরিবেশ উধাও। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পুরো শহর। শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ। রাস্তায় নেমে আসে একাধিক মিছিল। সর্বত্র চাপা উত্তেজনা।

গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যার পর নারায়ণগঞ্জের চিত্র ছিল এমনই। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচনে সেনাবাহিনী চেয়ে ব্যর্থ হলো কমিশন। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন চার কম্পানি সেনা সদস্যের বিপরীতে বাড়তি ১০০ র‌্যাব সদস্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় জরুরি বৈঠকের পর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এ টি এম শামসুল হুদা। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সরকার দায়ী কি না_এমন প্রশ্নের জবাবে ড. এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, 'সরকারের অমনোযোগিতার কারণে এমনটা হয়েছে কি না বলতে পারছি না। কারণ এখনো লিখিত সিদ্ধান্ত পাইনি।' একই সঙ্গে তিনি বলেন, 'সরকার আমাদের প্রতিপক্ষ নয়। সেনা মোতায়েন না করার বিষয়টি আমাদের জানানো উচিত ছিল। সরকার কেন এটা পারল না, কার গাফিলতি ছিল সেটা আমাদের জানতে হবে। এ বিষয়ে আমরা সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চাইব। কারণ সাংবিধানিকভাবে কমিশন চাইলে সরকার সেনা মোতায়েন করতে বাধ্য। সেনা মোতায়েন না হওয়ায় নির্বাচনে কোনো ধরনের গোলযোগ হলে সে দায় কমিশন নেবে না।' সেনা মোতায়েন না করার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে আইনের লঙ্ঘন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সিইসি বলেন, 'আমরা সেনাবাহিনী নিয়োগ করতে চেয়েছিলাম। এ বিষয়ে ওয়াদা করেছিলাম, চেষ্টাও ছিল। সবাই সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করে। কিন্তু একটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হলে সবাইকে সঠিকভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাহলেই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সমস্যা হয় না।' তিনি বলেন, 'নারায়ণগঞ্জে চার কম্পানি সেনা নিয়োগের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে আমরা সময়মতো সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দিয়েছিলাম। সেই চিঠির কোনো জবাব পাইনি। জবাব পাওয়ার প্রয়োজনও ছিল না। কারণ আগেও নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দিয়েছি। জবাব ছাড়াই সেনা মোতায়েন হয়েছে। এবার আমরা দুই দিন আগে জানতে পারলাম সেনা মোতায়েন হচ্ছে না। যদিও লিখিত বা মৌখিকভাবে আমাদের এখনো কিছু জানানো হয়নি।'
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শামসুল হুদা বলেন, এই নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গেছে। প্রচুর খরচ হয়েছে। এলাকাবাসীও নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। এ অবস্থায় সেনাবাহিনী মোতায়েন হচ্ছে না বলে নির্বাচন স্থগিত করা যায় না। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সেনাবাহিনী ছাড়াই নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচন কমিশনাররা সেনাবাহিনী মোতায়েনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসম্মতির কথা দুই দিন আগেই জানতে পারেন। কিন্তু তাঁরা বিষয়টি প্রকাশ করেননি। গতকাল সকাল থেকে নির্বাচন কমিশনাররা সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে অতিরিক্ত র‌্যাব পাওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকেন। বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তাদের দ্রুত নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে আসতে বলা হয়। তাঁদের নিয়ে কমিশন কার্যালয়ে বিকেল সাড়ে ৩টায় বৈঠক শুরু করেন নির্বাচন কমিশনাররা। বৈঠকে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. হুদা ও নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে কমিশন সচিবালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।
গত রাতে এম সাখাওয়াত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, "আমরা টেলিফোনে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে কথা বলেও কোনো সদুত্তর পাইনি। সেনা মোতায়েন হচ্ছে না, এ তথ্যটিও স্পষ্টভাবে আমাদের জানানো হয়নি। 'হবে, হচ্ছে, দেখি কী হয়' বলে সময় কাটানো হয়েছে।"
বন্দর নগরীর চিত্র
নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন না করা সংক্রান্ত ইসির ঘোষণায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নারায়ণগঞ্জ। প্রার্থীরা তো বটেই, সাধারণ ভোটাররাও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়েও। সেনাবাহিনী মাঠে না থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব_জেলা রিটার্নিং অফিসারের এমন দাবিতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না অনেকেই।
নারায়ণগঞ্জে গতকাল দিনভর আলোচনার মূল বিষয় ছিল সেনাবাহিনী কখন মাঠে নামবে তা নিয়ে। আদৌ নামবে না_এমনটা ছিল বেশির ভাগ মানুষের ভাবনার বাইরে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদার সেনা মোতায়েন না হওয়ার ঘোষণায় এ জন্য বেশির ভাগ ভোটারই বিস্মিত হয়েছেন। প্রার্থীরাও অনেকে সরব হয়ে উঠেছেন নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার আশঙ্কায়। এতে করে শান্ত নির্বাচনী পরিবেশের ইতি ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সেনা মোতায়েন না করা সংক্রান্ত সিইসির ঘোষণার পরপরই গতকাল সন্ধ্যায় স্থানীয় বিএনপি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবিতে মিছিল বের করে। শহরের বালুর মাঠ, চাষাঢ়া, উকিলপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে শত শত লোক প্রেসক্লাব এলাকায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে। চাষাঢ়া জিয়া হল মিলনায়তনের সামনেও শত শত লোক বিক্ষোভ করে।
নির্বাচন কমিশনের সেনা মোতায়েন না করার ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এ কে এম শামীম ওসমান বলেন, নির্বাচন কমিশনের যেকোনো সিদ্ধান্তকে তিনি স্বাগত জানান। অন্য মেয়র পদপ্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াত আইভী বলেন, সেনা মোতায়েন না করার আশঙ্কাই সত্য হলো। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবিতে দেখা করেছেন রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে। সেনা মোতায়েন না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
জেলা রিটার্নিং অফিসার বিশ্বাস লুৎফর রহমান বলেন, 'সেনাবাহিনী মোতায়েন না হলেও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। নিয়ম অনুযায়ী ২ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। আমার যে জনবল আছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব। সেনাবাহিনী না থাকলেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব তা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখাতে চাই।'
সেনা মোতায়েন নিয়ে দেড় মাস ধরে যা হয়েছে : নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন গত ১২ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের বলেন, 'আমাদের মেয়াদের শেষ সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচন নিয়ে ইসি সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নারায়ণগঞ্জে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির পাশাপাশি প্রয়োজনে সেনাবাহিনী নামানোর চিন্তা-ভাবনা করছে নির্বাচন কমিশন।'
ওইদিন সাখাওয়াত হোসেন আরো জানান, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনে সেনাবাহিনীকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল।
এম সাখাওয়াতের ওই বক্তব্যের ১০ দিন পর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এ সময় সিইসি এম শামসুল হুদা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'এই নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা আমাদের নেই।' এরপর গত ১৩ অক্টোবর তিনি বলেন, 'নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পাঁচ দিনের জন্য সেনা মোতায়েন হতে পারে।'
১৬ অক্টোবর এই নির্বাচনে চার কম্পানি (চার শতাধিক) সেনা চেয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন। এদিন নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারকে (পিএসও) পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, কমিশন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভোট গ্রহণের আগের দুই দিন, ভোট গ্রহণের দিন ও ভোট গ্রহণের পরের দুই দিন মিলিয়ে মোট পাঁচ দিন সেনা নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চিঠিতে আরো জানানো হয়, এ নির্বাচনে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন অনুসারেই সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হবে। অর্থাৎ এ নির্বাচনে সেনাবাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।
সূত্র জানায়, এই নির্বাচনে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) নিয়োগ না করতে পারার কারণেই মূলত নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়।
এরপর গত ২৪ অক্টোবর এই নির্বাচনে সেনাবাহিনীর কর্মপরিধি নির্ধারণ করে দিয়ে নির্বাচন কমিশন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দেয়। চিঠিতে বলা হয়, নির্ধারিত কর্মপরিধি অনুসারে চার কম্পানি সেনা সদস্যের মধ্যে এক কম্পানিকে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে রিজার্ভ রাখা হবে। তারা ভোট গ্রহণের দিন সকাল থেকে রিটার্নিং অফিসারের কন্ট্রোলরুমে নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলবে। এ ছাড়া এক কম্পানি করে সেনা সদস্য নারায়ণগঞ্জ সিটি এলাকার তিন থানায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতায়েন থাকবে।
গত ফেব্রুয়ারির ঘটনার পুনরাবৃত্তি : এর আগে গত ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ১২টি পৌরসভা এবং জাতীয় সংসদের হবিগঞ্জ-১ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের উপনির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তারা সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সে সময় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে এ বিষয়ে কয়েক দফা চিঠি দিয়েও জবাব পায়নি কমিশন। এতে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে বলেও সে সময় অনেকে অভিযোগ করেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে সরকারের কাছে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি।
এবারও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী চেয়ে ব্যর্থ হবেন কি না_এ প্রশ্নের জবাবে সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা এখন যাওয়ার পথে। কয়েক মাস পরই আমাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই বিদায়বেলায় সরকারের সঙ্গে আমাদের বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হবে না বলেই আমরা আশা করছি।'

No comments

Powered by Blogger.