মুখোশ উন্মোচিত হলো by হায়দার আকবর খান রনো

ত ২ সেপ্টেম্বর শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর পুলিশের আকস্মিক আক্রমণ ও বেপরোয়া লাঠিচার্জ সরকারের মুখোশ উন্মোচন করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার আগেও ছিল; ফলে এবার নতুন করে চেনার প্রশ্ন ওঠে না। তবু মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা ছিল। এত বিপুল ভোট পেয়ে এবং দিন বদলের স্লোগান দিয়ে যারা ক্ষমতায় এসেছেন তাদের আচরণে ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে হয়তোবা কিছু পরিবর্তনের সুর দেখতে পাব।


দিন বদলাতে হলে আগে তো নিজেদের বদলাতে হবে। কিন্তু পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত দেখা যায়নি। বস্তুত, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এযাবত কোনো সরকারই গণতান্ত্রিক আচরণ করেনি। আর হঠাৎ করে মহাজোটের সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে উঠবে, তাইবা ভাবি কি করে। ২ সেপ্টেম্বরের ঘটনায় সরকারের রাজনৈতিক চরিত্রের দুটো দিক উন্মোচিত হয়েছে। একদিকে রয়েছে ফ্যাসিষ্ট চরিত্র, অপরদিকে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণের নীতি। একই ঘটনার মধ্য দিয়ে দুটি দিকই পরিষ্কার হয়ে উঠল। তেল গ্যাস সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটি কর্তৃক আহূত কর্মসূচি ছিল ২ সেপ্টেম্বর। বহু আগের ঘোষিত কর্মসূচি। প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা এবং বঙ্গোপসাগরে তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র দুটি বিদেশি কোম্পানির কাছে তুলে দেয়ার প্রতিবাদে জাতীয় কমিটি পেট্রোবাংলা ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। প্রথমত এই দাবি ছিল খুবই ন্যায়সঙ্গত দাবি, জাতীয় স্বার্থ রক্ষার দাবি। সরকার যেখানে জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে দিতে যাচ্ছে, সেখানে তারই প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল এই সংগঠনটি। গণতান্ত্রিক দেশে সভা, মিছিল করার অধিকার তো থাকতেই হবে। সরকার সেই মিছিল নিষিদ্ধ করেনি। ১৪৪ ধারাও জারি ছিল না। মুক্তাঙ্গনে সংক্ষিপ্ত সভার পর বিভিন্ন দাবির ফেষ্টুনে সুসজ্জিত মিছিলটি বের হয়েছিল। হঠাৎ দেখা গেল পল্টন মোড়ে পুলিশ তারকাটা দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করেছে। অর্থাৎ মিছিলকে যেতে দেবে না। মিছিলকারীরা আপত্তি জানালে পুলিশ ব্যারিকেড তুলে নিল। আমিও মিছিলে ছিলাম। ভাবলাম পুলিশের ভিমরতি ধরেছিল। তবে সেটা সরে গিয়ে শুভবুদ্ধি ফিরে এসেছে। মিছিলে বাধা দেয়ার কোনো অধিকার নেই পুলিশের। মিছিল করার অধিকার আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, সংবিধানে স্বীকৃত নাগরিক অধিকার। মিছিল এগিয়ে গেল। অল্প দূর যেতে না যেতেই। বিজয়নগরের রাস্তায় হঠাৎ করে পুলিশের ব্যারিকেড, মিছিলে বাধাদান ও বেধড়ক লাঠিচার্জ আমার কাছে আকস্মিক ও অকল্পনীয় ছিল। আমি লক্ষ্য করেছি, পুলিশ আগের থেকেই তারকাটার বেড়া নিয়ে প্রস্তুত ছিল। এটা সপষ্ট যে, সরকারের পূর্বসিদ্ধান্তই ছিল যে মিছিলে বাধা দিতে হবে। এটাই সরকারের ফ্যাসিষ্ট চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেই গণতন্ত্রী হয় না। ভিন্ন মত সহ্য করতে না পারা, বলপ্রয়োগ দ্বারা জনমতকে দমন করা, এসবই তো হচ্ছে ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। একটি পূর্বঘোষিত মিছিলের ওপর এমন বর্বর হামলা আর কী প্রমাণ করে? ২ সেপ্টেম্বরের ঘটনা আরেকটি জিনিসও প্রমাণ করে। বর্তমান সরকার সাম্রাজ্যবাদের কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছে। যে দাবি নিয়ে মিছিলটি ছিল সেই দাবি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছে না সরকার। কারণ যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে বর্তমান সরকার, সেই শ্রেণীটি হচ্ছে মুৎসুদ্দি শ্রেণী। সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত। তাই গণতান্ত্রিক নিয়ম-কানুনের সামান্যতম তোয়াক্কা না করে সরকার এই মিছিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির সেবা করা এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য সরকারকে তাই এহেন অগণতান্ত্রিক হিংস্র ভূমিকা নিতে হয়েছে। যে কারণে এই মিছিলটি ছিল তা একটু ভালো করে দেখা যাক। গত ২৪ আগষ্ট সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বঙ্গোপসাগরের তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র একটি মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপস ও একটি আইরিশ কোম্পানি তাল্লোকে অনুসন্ধান ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য বরাদ্দ দেয়া হবে এবং তা দেয়া হবে ২০০৮ সালের মডেল পিএসসির ভিত্তিতে। তারই প্রতিবাদে এই মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তড়িঘড়ি করে যে উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির খসড়া তৈরি করেছিল সেটাই মডেল পিএসসি-২০০৮ নামে পরিচিত। এই মডেল পিএসসিটি ছিল চরমভাবে জাতীয় স্বার্থবিরোধী, যেখানে উত্তোলিত গ্যাসের ৮০ শতাংশ কোম্পানি বিদেশে রফতানি করতে পারবে। শুধু তাই নয়, কার্যত একশ'ভাগই বিদেশে রফতানির আশঙ্কা আছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে ছিল চরমভাবে গণবিরোধী এবং বিদেশি প্রভুর সেবায় নিয়োজিত, তার প্রমাণ তো ওই ২০০৮ সালের মডেল পিএসসি প্রণয়ন। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এই যে বর্তমানের নির্বাচিত সরকার বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বহু কাজকে বাতিল করলেও ২০০৮ সালের মডেল পিএসসি হুবহু গ্রহণ করেছে। কারণ এক্ষেত্রে উভয়ের স্বার্থ অভিন্ন। উভয়ই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সেবা করতে আগ্রহী। বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে (তার সঙ্গে হয়তোবা কারও ব্যক্তিগত স্বার্থও থাকতে পারে) জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে উভয়ই প্রস্তুত ছিল। উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি বা পিএসসির বিষয়টি একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। সরকার যখন বিদেশি কোনো তেল বা গ্যাস কোম্পানিকে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে গ্যাস বা তেল অনুসন্ধানের জন্য আহ্বান করে তখন সেই বিশেষ কোম্পানির সঙ্গে যে উৎপাদন-বণ্টনের চুক্তি হয় তাই-ই হচ্ছে পিএসসি। ইতোপূর্বে খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে (১৯৯১-১৯৯৬) এবং শেখ হাসিনার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে (১৯৯৬-২০০১) মোট ৭টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য। এই চুক্তিগুলো ছিল চরমভাবে জাতীয় স্বার্থবিরোধী। কারণ : ১. এখানে বিদেশি কোম্পানিকে টেন্ডারে অংশগ্রহণের সুযোগ দিলেও আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাপেক্সকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাইরে রাখা হয়েছিল, অথচ ইতিপূর্বে বাপেক্সের গ্যাস অনুসন্ধানের ভালো রেকর্ড আছে। গড়ে তিনটি খনন করলে দুটিতে গ্যাসের অনুসন্ধান পেয়েছে। আমাদের জাতীয় সংস্থাকে গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিলে গ্যাস সম্পদের পুরোটাই বাংলাদেশের থাকত। ২. এ পর্যন্ত সব পিএসসিতে বিদেশি কোম্পানিকে অনুসন্ধানের জন্য খরচ উত্তোলিত গ্যাস থেকে প্রথমেই তুলে নেয়ার অধিকার দেয়া হয়েছে। দেখা গেছে, বিদেশি কোম্পানির খরচ বাপেক্সের তুলনায় ১১/১২ গুণ ধরা হয়েছে। এই খরচ বাংলাদেশকে বহন করতে হয়েছে। ৩. অনুসন্ধান খরচ তুলে নেয়ার পর বিদেশি কোম্পানি পাবে গ্যাসের প্রায় অর্ধেক। অর্থাৎ বিদেশি কোম্পানিকে ডেকে এনে আমরা মজুত গ্যাসের অর্ধেকেরও বেশি তুলে দেব। এসব চুক্তি হয়েছিল গোপনে। এমনকি শেখ হাসিনার আমলে সংসদীয় কমিটিতে এই বিষয়টি উত্থাপিত হলে তদানীন্তন জ্বালানি সচিব তৌফিক এলাহী চৌধুরী সংসদীয় কমিটির কাছে চুক্তির কাগজপত্তর দেখাতে সরাসরি অনাগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তার এই ঔদ্ধত্য হজম করতে হয়েছিল। বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির এই বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে বর্তমান সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা পদে উন্নীত করা হয়েছে। ১৯৯৮ সালে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিদেশি কোম্পানি কর্তৃক বাংলাদেশের ভৌগোলিক এলাকায় হাইড্রো কার্বন (তেল, গ্যাস) অনুসন্ধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। ২০০৭ সালে জরুরি আইনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদন জানালে হাইকোর্ট স্থলভাগে আগের মতো নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখলেও সমুদ্রাঞ্চলে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার তড়িঘড়ি করে মডেল পিএসসি প্রণয়ন করে। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মডেল পিএসসি অনুমোদিত হয়। এরই বিভিন্ন ধারায় বিদেশি কোম্পানিকে উত্তোলিত গ্যাসের ৮০ শতাংশ রফতানি করার অধিকার দেয়া আছে। বাকি ২০ শতাংশ বাংলাদেশ সরকারের দখলে থাকবে। তা অবশ্য পাইপলাইনে করে দেশের ভেতরে আনা যাবে। কিন্তু তা খুবই ব্যয়বহুল। ফলে সরকার বাধ্য হবে ওই অংশও বিদেশে রফতানি করতে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৯৩ সালের জ্বালানি নীতিতে গ্যাস রফতানির কোনো বিধান ছিল না। ১৯৯৭ সালের মডেল পিএসসিতে বিদেশি কোম্পানিকে বাজারজাতযোগ্য গ্যাস তরলীকরণ করে রফতানির সুযোগ দেয়া হয়েছিল। অথচ আশ্চর্যজনক বৈপরীত্ম লক্ষ্য করা যায় যে সেই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ৫০ বছরের গ্যাস মজুত না রেখে রফতানি করা যাবে না। আর এখন শেখ হাসিনার দ্বিতীয়বারের সরকার ২০০৮ সালের পিএসসি মডেল অনুসারে গ্যাস রফতানি করার অধিকার দিচ্ছে দুই বহুজাতিক কোম্পানিকে। আমাদের বিদ্যুৎ সংকট আছে। আছে জ্বালানি সংকট। তাই দ্রুত গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করা দরকার। এই অজুহাতেই সাগরের গ্যাস ক্ষেত্রের জন্য বিদেশি কোম্পানিকে ডেকে আনা হয়েছে। কিন্তু হায়! গ্যাস পাওয়া গেলেও ওই গ্যাস তো বিদেশে চলে যাবে। ইতোপূর্বের চুক্তিগুলোও খারাপ ছিল। তা ছিল জাতীয় স্বার্থবিরোধী। তবু তো উত্তোলিত গ্যাস বেশি দামে হলেও বাংলাদেশ পেত। এখন তো কিছুই পাবে না। বস্তুত জ্বালানি সংকটের অজুহাত তুলে বিদেশিদের সেবা করাই হচ্ছে সরকারের এই পদক্ষেপের আসল কারণ। আর ঠিক এই কারণেই সরকারের কাছে বিষয়টি এত সপর্শকাতর। এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ তারা সহ্য করতে রাজি নয়। তাই বিনা কারণে মিছিলের ওপর এমন চড়াও হয়েছিল প্রশাসন। এই ঘটনায় সরকারের ফ্যাসিষ্ট চরিত্র ও বিদেশি প্রভুর সেবার মনোবৃত্তি-দুটোই একই সঙ্গে উন্মোচিত হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.