ভূমি জরিপের কাজ চলে যাচ্ছে এনজিওদের হাতেঃ তুঘলকের আমল কি ফিরে এলো?

ভূমি জরিপ পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এনে কম্পিউটারাইজড ভূমি জরিপ চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও সার্কুলার ও চিঠি চালাচালি শুরু হয়ে গেছে। জরুরি অবস্থার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গৃহীত সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় চলমান এই উদ্যোগের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ভূমি জরিপ অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাদ দিয়ে এনজিওদের দেয়া হবে জরিপ পরিচালনার কাজ। অর্থ ও ভূমি মন্ত্রণালয় এই নতুন ব্যবস্থা চালু করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।


আমার দেশ গতকাল এ সম্পর্কে যে প্রতিবেদন ছেপেছে তাতে দেখা যায়, ইতোমধ্যে একটা এনজিওর সঙ্গে সরকার কথাবার্তাও সেরে ফেলেছে। ভাগ্যবান এনজিওটি তাদের কর্মীদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে। উদ্যোগটি কার্যকর হলে জরিপ কাজের জন্য এখন উপজেলা পর্যায়ে ১৯ জনের যে লোকবল আছে তাতে পরিবর্তন ঘটবে। উপজেলা পর্যায়ে লোকবল কমিয়ে ৭ জন করা হবে। এ ৭ জনের মধ্যে ৩ জনকে নিয়োগ দেয়া হবে ভাড়াটিয়া (আউট সোর্সিং) হিসেবে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে উপজেলা স্তরে বর্তমান যারা কর্মরত আছেন তাদের মধ্যে ৪ জনের চাকরি থাকলেও থাকতে পারে; বাকি ১৫ জনকে পত্রপাঠ বিদায় নিতে হবে। আবার ভাড়াটিয়া হিসেবে যাদের দিয়ে কাজ করানো হবে তাদের ব্যক্তিগতভাবে নিয়োগপত্র দেয়া হবে না। তারা যে প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) প্রতিনিধিত্ব করবেন চুক্তি হবে সেটির সঙ্গে। এ ব্যাপারে অর্থ ও ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয়েছে একাধিক সার্কুলার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, সেটেলমেন্টের মাঠ প্রশাসনের বেশ কয়েকটি পদ বিলুপ্ত করে ভূমি জরিপ, রেকর্ড প্রণয়নসহ যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে বাইরে থেকে এসব পদে জনবল ভাড়া করে আনা হবে। এর ফলে সার্ভেয়ার, পেশকার, কপিষ্ট, বেঞ্চ সহকারী, জাজ মোহরার, নাজির, ড্রাফটম্যান পদগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফলে সারাদেশে অন্তত ১০ হাজার সরকারি কর্মচারী চাকরি হারাবেন। এই লোকগুলো বেকার হয়ে কোথায় যাবেন, কী করবেন তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার ফুসরত নেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর নীতিনির্ধারকদের। ভূমি জরিপ একটি জটিল ও সপর্শকাতর বিষয়। বাংলাদেশে জমি কম মানুষ বেশি। ফলে জমি নিয়ে বিরোধও বেশি। বিভিন্ন আদালতে যত মামলা ঝুলে আছে তার ৬০ শতাংশের বেশি হচ্ছে জমি সংক্রান্ত। এছাড়া জমি নিয়ে হানাহানি, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি লেগেই আছে। এ পটভূমিতে সরকার যদি ভূমি ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও সততার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয় তবে ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা বাড়বে, মানুষ বেশি বেশি ভোগান্তির শিকার হবে। ভূমি জরিপ ভূমি ব্যবস্থাপনার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এখন ভূমি জরিপের কাজ যদি এনজিওদের হাতে তুলে দেয়া হয় তবে এক্ষেত্রে সরকারের কর্তৃত্ব হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি আস্থার সঙ্কট দেখা দেবে। সরকারি ভূমি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু সরকারি অফিসগুলো দুর্নীতিপরায়ণ আর এনজিওগুলো ধোয়া তুলসীপাতা-এই গল্প বাসি হয়ে গেছে অনেক আগেই। তাই এনজিওদের হাতে ভূমি জরিপের দায়িত্ব তুলে দিলে দুর্নীতি কমার পরিবর্তে বরং বাড়বে। তদুপরি দুর্নীতির সঙ্গে অদক্ষতা যুক্ত হয়ে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার। ভূমি ব্যবস্থাপনা অবশ্যই স্বচ্ছ হতে হবে। কিন্তু স্বচ্ছতার নামে এবং দ্রুত জরিপ কাজ শেষ করার অজুহাতে এক্ষেত্রে কোনো রকম এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ নেই। তাতে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। ১০ হাজার কর্মচারীর পেটে লাথি মেরে এনজিও দিয়ে জমি জরিপের বুদ্ধি আমাদের সম্রাট তুঘলকের পাগলামির কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা কথায় কথায় কম্পিউটারের কথা বলি। কিন্তু কম্পিউটারের সাহায্যে ডিজিটাল ভোটার তালিকা আর জাতীয় পরিচয়পত্র বানাতে গিয়ে তোলা ছবিতে অর্ধেকের বেশি মানুষের চেহারা যে কোলাব্যাঙের মতো হয়ে গেছে সে কথা বলি না। মানুষের চেহারা বিকৃত হলে তবুও সারে; কিন্তু জমির চেহারা বিকৃত হলে পরিণতিতে খুনোখুনি পর্যন্ত হতে পারে। তাই, এই তুঘলকি সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকার জন্য আমরা সরকারকে অনুরোধ করছি।

No comments

Powered by Blogger.