বিদেশে উচ্চশিক্ষার নামে প্রতারণা by রিয়াদুল করিম

লেখাপড়া করতে ফ্রান্সে যাওয়ার জন্য রাজধানীর বিজয়নগরের সিয়েরা-২১ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মৌলভীবাজারের দৌলতপুর গ্রামের তারেক হাসান। ভিসার জন্য সাত লাখ টাকা দিতে হবে এমন জানায় প্রতিষ্ঠানটি। এ ব্যাপারে ১৫০ টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তি হয় গত বছরের ১২ আগস্ট। চুক্তি অনুসারে দুটি চেকের মাধ্যমে দুই লাখ ৮০ হাজার এবং নগদ ২০ হাজার টাকা প্রতিষ্ঠানটিকে দেন তারেক। কথা ছিল, তিন মাসের মধ্যে ভিসার কাজ শেষ করবে প্রতিষ্ঠানটি, অন্যথায় টাকা ফেরত।
কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে ভিসা করতে ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি। ভিসা করে দিতে না পেরে টাকা ফেরত দিতে অনেক টালবাহানা করে। একপর্যায়ে তারা তারেককে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকার একটি চেক (সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড) দেয়। কিন্তু তারেক ব্যাংকে গিয়ে জানতে পারেন, ওই চেকের বিপরীতে হিসাব নম্বরে টাকা নেই। এরপর সিয়েরা-২১ নামের প্রতিষ্ঠানটি তিনি বন্ধ দেখতে পান। সঙ্গে লাপাত্তা হন প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ঐশ্বর্য তাপসী ইলেম তাবস্সুম চৌধুরী।
তারেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাই, অনেক আশা করেছিলাম, বিদেশে গিয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি চাকরি করে জীবন সাজাব। কিন্তু সবই হারালাম।’ বিদেশে পড়তে আগ্রহী অনেক শিক্ষার্থী এভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
তারেকের মতো অন্তত ৪০ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন ঐশ্বর্য, গুটিয়ে নিয়েছেন সিয়েরা-২১ নামের প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম। প্রতারণার অভিযোগে ঐশ্বর্যের বিরুদ্ধে রমনা থানায় একাধিক মামলা হয়েছে। পুলিশ ঐশ্বর্যকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
একইভাবে সাইপ্রাসে নিয়ে যাওয়ার নাম করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে ইউরোভিশন ও ইউনাইটেড ফরেন অ্যাডমিশন নামের অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান।
এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বীকৃত প্রতিনিধি এ দেশ থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়ার কাজ করতে পারেন। কিন্তু তথাকথিত কিছু কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক এজেন্ট অনুমতি ছাড়া এ ধরনের কাজ করছে। মূলত তারাই প্রতারণা করে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘ক্রস বর্ডার অ্যাডুকেশন’ নীতিমালার খসড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন। এটি চূড়ান্ত হলে এ ধরনের প্রতারণা বন্ধ হবে।
সিয়েরা-২১ প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে রমনা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আলতাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির মালিক ঐশ্বর্য তাপসী ইলেম তাবস্সুম চৌধুরীর বিরুদ্ধে রমনা থানায় প্রতারণার অভিযোগে আটটি মামলা আছে। এ ছাড়া লিখিত অভিযোগ করেছেন অন্তত ৪০ জন শিক্ষার্থী। আলতাফ হোসেন তিনটি মামলা তদন্ত করছেন। তিনি জানান, গত মাসের শেষের দিকে একটি মামলায় ঐশ্বর্যের মা ও বাবাকে ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। তবে ঐশ্বর্যের খোঁজ পাননি।
সিয়েরা-২১কে টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, টাকা ফেরত চাওয়ার সময় ঐশ্বর্য র‌্যাবের সদস্য দিয়ে তাঁদের শায়েস্তা করার হুমকি দিতেন। র‌্যাব-৩-এর সদস্য তরিকুল ইসলাম ঐশ্বর্যের পক্ষ হয়ে তাঁদের হুমকিও দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে তাঁরা র‌্যাব-৩-এর পরিচালক বরাবর অভিযোগও করেন।
এ ব্যাপারে র‌্যাব-৩-এর পরিচালক রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মেজর তরিকুল বিষয়টি তদন্ত করছিলেন। তিনি এখন র‌্যাবে নেই। যে নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি যে প্রতারক এটি ঠিক। তবে তরিকুলের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা যে অভিযোগ করেছেন, তা একটু বাড়াবাড়ি।
ইউরোভিশন: সাইপ্রাসের ইন্টার কলেজে পড়তে যাওয়ার জন্য আমিরুল ইসলাম টাকা দিয়েছিলেন পান্থপথের ইউরোভিশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু আমিরুলের সাইপ্রাস যাওয়া হয়নি। টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি এখন লাপাত্তা। প্রতারণার শিকার আমিরুল ইসলাম মতিঝিল থানায় ইউরোভিশন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
আমিরুল প্রথম আলোকে বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে তিনি সাইপ্রাসে যাওয়ার জন্য পশ্চিম পান্থপথের ইউরোভিশন নামের প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আবুল হাসান আমিরুলকে বলেছিলেন, ইউরোভিশন সাইপ্রাসের ইন্টার কলেজে ছাত্র পাঠায়। তিনি আমিরুলসহ বেশ কয়েকজনের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিভিন্ন কাগজপত্র নেন। এর কিছুদিন পর শিক্ষার্থীদের তিনি ‘অফার লেটার’ (প্রস্তাবপত্র) দেন। এরপর তিনি প্রত্যেককে সাইপ্রাসের টিউশন ফি দেওয়ার কথা বলেন। তখন আমিরুল গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে মোট তিন লাখ ২০ হাজার টাকা (তিন হাজার ২০০ ইউরো) ইন্টারকলেজের নামে একটি অ্যাকাউন্টে পাঠান।
এসব শিক্ষার্থীকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সাইপ্রাসে পাঠানোর কথা ছিল। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে আমিরুল জানতে পারেন যে তাঁদের ভিসা হচ্ছে না। ইউরোভিশনের কার্যালয়ে এসে দেখেন সেটি বন্ধ। তারা কার্যালয়টি ছেড়ে দিয়েছে। অনেক চেষ্টার পর তিনি ইউরোভিশনের ব্যবস্থাপক হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমর্থ হন। তিনি টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেননি।
আমিরুল জানান, এ ঘটনার পর প্রতারণার শিকার শিক্ষার্থীরা ইন্টার কলেজে ও ঢাকায় সাইপ্রাসের দূতাবাসে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু তারাও কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না। এসব উল্লেখ করে আমিরুল মতিঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। একই অভিযোগে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী থানায়ও একটি ডায়েরি করেছেন প্রতারণার শিকার মুক্তার হোসেন নামের এক শিক্ষার্থী। তাঁরা জানিয়েছেন, অন্তত ৩৫ জন শিক্ষার্থী একসঙ্গে টাকা জমা দিয়েছিলেন।
প্রতারণার শিকার একাধিক শিক্ষার্থী আবুল হাসান ও তাঁর সহযোগীদের নামে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। আবুল হাসানরা যেসব মুঠোফোন ব্যবহার করতেন, তা বন্ধ।
এর আগে গত ডিসেম্বরে ইউনাইটেড ফরেন অ্যাডমিশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে একই ধরনের প্রতারণা করেছিল।

No comments

Powered by Blogger.