দ্রব্যমূল্যের সাতকাহন! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

'এইটা ডিসির গোস্ত, আর এইটা গরুর গোস্ত।' চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দীন বাজারে জনৈক গরুর মাংস বিক্রেতা। [১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একদিন] 'মরিচ কিনবেন না, হাত দিয়েন না। মরিচের ঝাঁজেও হাত পোড়ে।' [২০০৪ সালে হাতিরপুল বাজারে জনৈক কাঁচামরিচ বিক্রেতা। জুন মাসের কোনো একদিন। 'সিটি কর্পোরেশনকে মাল দিতে বলুন। তা হলে তাদের দামে মাল বিক্রি করব।' [২০০৯ সালের আগষ্ট মাসে ঢাকার নয়া বাজারে জনৈক দোকানি]।


উপরে উল্লিখিত তিনটি বাক্য যে তিন মহাজনের মুখনিঃসৃত তারা ক্ষণজন্মা কোনো পুরুষ নন; কিন্তু অবস্থার বৈগুণ্যে ত্রয়ী এই এবং তাদের স্বগোত্রীরা সংবাদের বিষয় হয়ে যান প্রায়শ। টিভি ক্যামেরা তাদের পেছনে দৌড়ায়। তারা নির্বিকার চিত্তে তাদের কথা বলে যান। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরে তারা এমনভাবে কথা বলেন যেন ঝানু কোনো বাজার বিশেষজ্ঞ কথা বলছেন। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি প্রায় বছরই পুরো জাতিকে বিপাকে ফেলে দেয়। বিশেষ করে রোজার মাসে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের এটাই যেন বাজারের মোটামুটি সিনারিও। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বোধগম্য কারণে যে অভাব অনুভূত হওয়ার কথা ছিল, হয়েছে তার অনেক বেশি। দ্রব্যমূল্যের লাগাম ছাড়া ঊর্ধ্বগতিতে প্রশাসন দিশেহারা। দফায় দফায় মিটিং আর হুমকি-ধমকি দিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছিল না। তবে তখন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন রকমের গা-জ্বালা করা বক্তৃতা শুনতে হতো না ইলেকট্রনিক মিডিয়া হিসেবে শুধুমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশন আর বাংলাদেশ বেতারের একক অস্তিত্বের কারণে। সরকারের গুণগান ভজনকীর্তন করার জন্য যেন এই দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম। কট্টর রাজতন্ত্রে যেমন প্রচলিত নিয়ম হলো, 'কিং ক্যান ডু নো রঙ'- রাজার কোনো ভুল নেই- এই মতে অন্ধ আস্থা স্থাপন, তেমনি আমাদের সরকারি ইলেকট্রনিক মাধ্যমদ্বয়ের নীতিও হলো, গভর্নমেন্ট ইন পাওয়ার ক্যান ডু নো রং-এই মতবাদের অন্ধ আনুগত্য। ফলে সেই আমলে দ্রব্যমূল্য নিয়ে হইচই যা হওয়ার হতো বাজারে অর্থাৎ অকুস্থলে আর সংবাদপত্রের পাতায়। সংবাদপত্রের পাতায় হইচই হয় নীরবে। কালো অক্ষরের লেখাগুলো পাঠকের মনোজগতে হইচই ফেলে। সামগ্রিকভাবে এক লহমায় সমাজের সবাই তো এই হইচই-এ শামিল হন না কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের কারণে। যেমনটি হন টেলিভিশনের তাৎক্ষণিকতার কারণে। ১৯৭৪-এর পূর্ব ও পরবর্তী আকালের কথা স্মরণ করার মতো মানুষ সমাজে কম নেই। চট্টগ্রামবাসীর প্রিয় গোমাংসের দাম তখন আঠারো টাকার কাছাকাছি। ন্যায্য দামের কয়েকগুণ বেশি। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়ল যখন নগরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সোচ্চার হলেন। ডিসি মহোদয় মিটিং করে গোমাংসের দাম বেঁধে দিলেন। নির্ধারিত দামে গোমাংস যাতে বিক্রি হয় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পড়লো জেলা প্রশাসন আর পৌর কর্তৃপক্ষের ওপর। এখন যেমন ঢাকায় সিটি কর্পোরেশনের মূল্য তালিকা দোকানে দোকানে ঝুলিয়ে রাখার কথা শোনা যায়, তখন এমন ঢোল-শহরত হইচই হতো না বটে, তবে মাইকে, লিফলেটে এত্তেলা দেয়া হতো দোকানদারদের। মাংস বিক্রেতা কিংবা যাদেরকে আমরা কসাই বলি তাদের কাজটি নির্মম প্রকৃতির হলেও অন্তরে লোকগুলো খুবই রসিক ধরনের। তাদের রসবোধ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানারকম রসালো গল্প শোনা যায়। রিয়াজউদ্দীন বাজারের কসাইরা দুই শ্রেণীর গোমাংস বিক্রির ব্যবস্থা রেখেছিলেন সেইসব দিনে! এক শ্রেণীতে নির্ভেজাল গোমাংস। অন্য শ্রেণীতে নানা রকম উচ্ছিষ্ট, বর্জে্যর সমাহারে গোমাংস। এই শ্রেণীর নাম তারা দিয়েছিল 'ডিসির মাংস।' ডিসি তথা জেলা প্রশাসন নির্ধারিত দামে এই মাংস বিক্রির জন্য রাখা ছিল। বলা বাহুল্য, এই মাংস বাজার করতে আসা বিত্তবানদের থলেতে ওঠেনি। এই মাংস যারা অভাবের কারণে অমৃতজ্ঞানে খায়, তারা এই দামেও মাংস কিনতে অক্ষম। সুতরাং ডিসির মাংস অবিক্রীত থাকত। খবরটা জেলা প্রশাসকের গোচরীভূত হয়েছিল। জেলা প্রশাসক স্মিতহাস্যে নীরব থেকে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছিলেন। বাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ যে অসম্ভব এমন কথা তখনও শোনা যেত, এখনও শোনা যায়। লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.