সফল একাউনট্যান্ট থেকে বর্ণাঢ্য পলিটিশিয়ান by শফিক রেহমান

সাইফুর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল এপ্রিল ১৯৬৮-তে। টানা এগারো বছর লন্ডনে থাকার পর আমি ওই সময়ে ঢাকায় ফিরে এসে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল যেটি এখন শেরাটন হোটেল নামে পরিচিত, সেখানে চিফ একাউনট্যান্ট পদে যোগ দেই। সাইফুর রহমান তখন ছিলেন তদানীন্তন পাকিস্তানের এক নাম্বার অডিট ও একাউনট্যান্সি ফার্মের যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতার অন্যতম এবং সিনিয়র পার্টনার। এই ফার্ম, রহমান রহমান হক অ্যান্ড কোম্পানি, সংক্ষেপে যেটি আরআরএইচ নামে পরিচিত, তার ব্রাঞ্চ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানজুড়ে ছিল।


পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় চার্টার্ড একাউনট্যান্ট রূপে সাইফুর রহমান তখনই সুপরিচিত ছিলেন। তিনি এবং অপর যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা রেজাউর রহমান চেয়েছিলেন আমি যেন আরআরএইচে যোগ দেই। বিভিন্ন কারণে সেই সময়ে ওই ফার্মে যোগ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে পরে সাইফুর রহমান যখন রাষ্ট্রপতি জিয়া সরকারের সময় অর্থমন্ত্রী হিসেবে কাজ করছিলেন তখন, ১৯৭৯-তে আমি রেজাউর রহমানের (বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী) অনুরোধে আরআরএইচ-এ যোগ দেই। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত এই সাত বছর ফার্মের সিনিয়র পার্টনার রূপে কাজ করার সুবাদে সাইফুর রহমানের নৈকট্য লাভের সুযোগ আমার হয়। মার্চ ১৯৮২-তে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্যুর পরে সাইফুর রহমানকে বিনাবিচারে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেই কারাবাস তার পরিবারে আর্থিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়ার একজন সৎ মন্ত্রী রূপে তার আয় ছিল সীমিত এবং আরআরএইচ থেকে ছুটিতে থাকা পার্টনার রূপে তার আয় ছিল শূন্য। কিছুকাল পরে জেলমুক্ত হয়ে সাইফুর রহমান আবার ফিরে আসেন তার ফার্মে। তবে দুর্নীতির অভিযোগ এবং জেলে যাওয়ার শক তাকে উ??ান্ত ও নিষ্?িয় করে দিয়েছিল। কয়েক বছর ধরে মন্ত্রিত্ব করার পরে আবার অডিটিং ও একাউন্টিং করাটা তার জন্য ছিল একটি পশ্চাদপসরণ। তবুও তিনি এটা মেনে নিয়ে ফার্মের কাজে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে পর্যুদস্ত মানসিক অবস্থা একাউনট্যান্ট হিসেবে তার পুনর্বাসনের অনুকূলে ছিল না। তবুও তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। মজার কথা এই যে, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ইউকে কোয়ালিফাইড প্রথম সাতজন চার্টার্ড একাউনট্যান্টের (বাকি ছয়জন : রেজাউর রহমান, এমআর সিদ্দিকী, জামালউদ্দিন আহমদ, আলম, মশিউর রহমান ও কেজেড ইসলাম) একজন হলেও সাইফুর রহমান চার্টার্ড একাউনট্যান্ট সম্পর্কে মাঝেমধ্যে বিদ্রূপ করতেন। তিনি মনে করতেন শুধু একাউনট্যান্ট হলেই চলবে না, রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে হবে। আর এ কারণেই যদিও আকসিমক ও অপ্রত্যাশিতভাবে একাউনট্যান্সি ছেড়ে পলিটিক্স ও সরকারে যোগ দিয়েছিলেন, তবুও পলিটিশিয়ান রূপে তার দ্বিতীয় পরিচয়ে তিনি বেশি আগ্রহী ও আনন্দিত ছিলেন। সম্ভবত সে কারণেই জেলমুক্ত হওয়ার পর তিনি মতিঝিলে আমাদের অফিসে প্রায়ই তার রূমে আমাকে ডাকতেন অথবা তিনিই চলে আসতেন রাজনীতি বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। আমাকে তিনি একাউনট্যান্ট মনে করতেন না-কলামিসট-জার্নালিসট মনে করতেন। এর আগে মন্ত্রী থাকাকালে তিনি একবার একটি বেফাঁস মন্তব্য করেছিলেন, এ দেশের নিউজপেপার সব টয়লেট পেপার। পরে তিনি এই মত বদলেছিলেন এবং সাগ্রহে অপেক্ষা করতেন সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের জন্য। তিনি আরেকটি সাপ্তাহিক পড়তেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে। সেটি ছিল লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি গার্ডিয়ান পত্রিকার সাপ্তাহিক এয়ারমেইল সংস্করণ উইকলি গার্ডিয়ান। এই পত্রিকাটি তিনি নিয়মিত সাবসক্রাইব করতেন এবং আন্তর্জাতিক পলিটিক্স ও ইকোনমিক্স বিষয়ে নিজেকে আপটুডেট রাখতেন। তার পুরো নাম ছিল মোহাম্মদ সাইফুর রহমান। সংক্ষেপে তিনি পরিচিত ছিলেন এম সাইফুর রহমান নামে। তবে ফার্মে তার নাম আরো সংক্ষিপ্ত ছিল। তিনটি ইংরেজি আদ্যক্ষর গঝজ বা এমএসআর নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। আমি তাকে ডাকতাম সাইফভাই নামে। আর আমার আরেক পার্টনার কাজী আমিনুল হক তাকে অপ্রকাশ্যে ডাকতেন বড় সাহেব নামে। দীর্ঘদেহী (ছয় ফুট লম্বা) সাইফুর রহমানকে আড়ালে কেউ কেউ ছয়ফুট রহমান নামেও ডাকতেন। তার ইংরেজি ও বাংলা কথায় সিলেটি একসেন্ট নিয়ে কেউ কেউ টিপ্পনি কাটতেন। বহু বিয়ের আসর এবং রাজনৈতিক আড্ডায় সাইফুর রহমানের বাচনভঙ্গির অনুকরণ সবাইকে নির্মল আনন্দ দিত। এসবই তিনি জানতেন। কিন্তু একজন উদারমনা ব্যক্তি রূপে তিনি এসব সহজভাবে নিতেন। বস্তুত তার ঔদার্য, তার কাজেকর্মে এবং বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে পারসপরিক সম্পর্কে প্রতিফলিত হতো। রহমান রহমান হক ফার্মে আর্টিকলড ক্লার্ক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সটাফকে বেতন-বোনাস দেয়ার বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন উদার। আবার মন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশের অর্থনীতিতে উদারপন্হী ছিলেন। একদিকে মুক্তবাজারের সমর্থক হলেও তিনি সাধারণ মানুষের মঙ্গলার্থে যে সামাজিক দায়িত্ব তার পালন করা উচিত সে বিষয়েও তিনি খুব সচেতন ছিলেন। তাই একজন সফল চার্টার্ড একাউনট্যান্ট থেকে অতি স্বাভাবিকভাবে তার উত্তরণ ঘটছিল একজন বর্ণাঢ্য পলিটিশিয়ান রূপে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রথমে বাণিজ্য উপদেষ্টা ও পরে অর্থমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি সাত্তার এবং প্রধানমন্ত্রী ম্যাডাম খালেদা জিয়ার অর্থমন্ত্রী রূপে তিনি বিশাল গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। বলা যায়, তারই আমলে, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প নতুন গতিবেগ অর্জন করেছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ে সাইফুর রহমানের জন্য সবচেয়ে সঙ্কটময় সময়টি ছিল অক্টোবর ২০০১-এ যখন নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়ে এসে দেখতে পায় শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পাঁচ বছরের শেষে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ প্রায় শূন্য করে গিয়েছে। তদুপরি তারা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের বড় ধরনের বোঝা রেখে গিয়েছে। দেশের এই প্রায় নিঃস্ব অবস্থা থেকে সাইফুর রহমান আবার গড়ে তোলেন প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আরেকটি প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করা উচিত। ১৯৯৬-এ শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সটক এক্সচেঞ্জের এক বিরাট কেলেঙ্কারিতে বহু পুঁজি বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়েছিল। সাইফুর রহমান তাই সটক এক্সচেঞ্জের কর্মকান্ডের প্রতি সার্বক্ষণিক নজর রাখতেন। ফলে সাইফুর রহমানের অর্থমন্ত্রিত্বের সময়ে সটক এক্সচেঞ্জে কোনো বিপর্যয় ঘটেনি। তবে তার সমালোচনাও হয়েছিল অক্টোবর ২০০৬-এ। কেউ কেউ বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ না রেখে, সেই টাকার কিছু অংশ চাল কেনায় ভর্তুকি দিলে সাধারণ মানুষ কম দামে অন্ততপক্ষে মোটা চাল কিনতে পারত-যেমনটা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার করছে। সাইফুর রহমান মনে করতেন, ওই রকম ভর্তুকি দিলে কৃষকদের আয় কমে যাবে এবং তারা ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হবে। অর্থমন্ত্রী রূপে সাইফুর রহমান চেষ্টা করেছিলেন চাষী এবং ভোক্তা উভয়ের স্বার্থে একটা ব্যালান্স বা সমতা রাখতে। এই কাজটি তিনি সফলভাবে করেছিলেন বলে অনেকে রায় দেন। আর এজন্যই বিএনপির সবকটি শাসন আমল চিহ্নিত হয়ে আছে (আওয়ামী লীগের তুলনায়) গুড ইকোনমিক ম্যানেজমেন্টের সময় হিসেবে। এই কাজে সাইফুর রহমান একটি বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন ভ্যাট প্রবর্তনের সময়ে। তিনি যথেষ্ট সমালোচিত হলেও ভ্যাট আদায় পদ্ধতি চালু রাখেন। দুঃখের বিষয় গত সেনাসমর্থিত সরকারের সময়ে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা থেকে সাইফুর রহমান সম্পর্কে গুজব রটানো হয় যে তিনি নিজেই ইনকাম ট্যাক্স কম দিয়েছেন। এই অভিযোগের বিরুদ্ধে সাইফুর রহমান তার বক্তব্য রাখার সুযোগ পাননি। কারণ ইতোমধ্যেই তারই বাড়িতে সেই বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী অক্টোবর ২০০৭-এ গভীর রাতে বিএনপি নেতাদের একটি বৈঠক বসিয়েছিল। সাইফুর রহমানকে তারা জিম্মি করে ফেলেছিল। পারিবারিকভাবেও সাইফুর রহমানের ওপর অনেক চাপ তৈরি করা হয়েছিল তার দুই পুত্র এবং কন্যাকে কেন্দ্র করে। এছাড়া তিনি কিছুকাল ধরে প্রসেটটের রোগে ভুগছিলেন। এসব কারণে সাইফুর রহমানের মনোজগতে বড় পরিবর্তন ঘটতে থাকে। রাজনীতিতে নীতির বদলে আত্মরক্ষাই প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। জেলবন্দি ম্যাডাম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপির শীর্ষ নেতা হওয়ার সুযোগ তাকে হাতছানি দেয়। একাউনট্যান্ট সাইফুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনের শেষপ্রান্তে এসে পলিটিক্যাল একাউনট্যান্সিতে ভুল করে ফেলেন। এসব সীমাবদ্ধতা বুঝেই ম্যাডাম খালেদা জিয়া জেলমুক্ত হওয়ার পর সাইফুর রহমানকে পার্টিতে এবং সট্যান্ডিং কমিটিতে ফিরিয়ে নেন। ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে দুটি স্থানে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়ন দেন। সাইফুর রহমান দুটি স্থানেই পরাজিত হন। এটা ছিল তার জন্য অপ্রত্যাশিত। কারণ অনেকেরই মতে সিলেট-মৌলভীবাজার এলাকায় বিশাল উন্নয়নের মূল কৃতিত্ব ছিল তারই। গত নির্বাচনের আগে ম্যাডাম খালেদা জিয়ার নির্দেশে আমি সিলেটে গিয়েছিলাম সাইফুর রহমানের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য দু'তিনটি জনসমাবেশ করতে। আমরা একই ফার্মের পার্টনার ছিলাম বলে নয়-আমি মনে করেছিলাম বিএনপির জন্য সবচেয়ে যোগ্য অর্থমন্ত্রী হতে পারেন তিনিই। গত নির্বাচনের পর থেকে সাইফুর রহমান মানসিক ও শারীরিক কারণে রাজনীতি থেকে দূরে চলে যান। দুর্ঘটনায় আকসিমক মৃত্যু তাকে রাজনীতি থেকে চিরবিদায় দিল। সাইফুর রহমানের প্রিয় ছিল ব্র্যান্ড সুট (অসিটন রিড), টাই (ক্রিশ্চিয়ান ডিওর), রিসটওয়াচ (রোলেক্স) ও জুতা (ব্যালি)। সাইফুর রহমান ভালোবাসতেন তার পরিবারকে। তার অসীম পুত্রস্নেহ তাকে শেষ জীবনে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। একাউনট্যান্টদের প্রতি তার ধারণা তির্যক হলেও তিনিই ইনষ্টিটিউট অফ চার্টার্ড একাউনট্যান্টস অফ বাংলাদেশ ভবন বা আইক্যাব ভবন প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করেন। এজন্য বাংলাদেশের প্রতিটি চার্টার্ড একাউনট্যান্ট তাকে অবশ্যই চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে সমরণ করবে। বিএনপির জন্য সাইফুর রহমানের সবচেয়ে স্থায়ী অবদান সম্ভবত তার অর্থমন্ত্রিত্বের আমলে একটি দক্ষ ও স্থিতিশীল ফাইন্যানশিয়াল ম্যানেজমেন্টের উজ্জ্বল ইমেজ।

No comments

Powered by Blogger.