দশ কোটি টাকায় ক্রয় অকেজো জাহাজ

সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে অয়েল ট্যাংকার ডুবে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনায় বন্দরে বসে থাকা বে-ক্লিনার-২ জাহাজ কেন পাঠানো হল না তা নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র চার বছর আগে ১০ কোটিরও বেশি টাকায় কেনা এ জাহাজটি জাতীয় দুর্যোগের মতো এত ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও জেন কাজে লাগানো হয়নি এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী নিজেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে জরুরি ফ্যাক্সবার্তা পাঠিয়ে এর রহস্য উদঘাটনের দাবি জানিয়েছেন। ওই চিঠি পাঠানোর পর চট্টগ্রাম বন্দরেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বন্দর কর্মকর্তারা বলছেন, নদী দূষণ রোধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব নিকটস্থ বন্দরের। মংলা বন্দরের আওতায় ঘটেছে ওই দুর্ঘটনা। তাছাড়া মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা বিভাগ যদি এ ধরনের দুর্যোগে চট্টগ্রাম বন্দরের সহযোগিতা না চায় তবে তারা কেন স্বপ্রণোদিত হয়ে জাহাজ পাঠাবেন? টিভির স্ক্রল দেখে, মন্ত্রণালয়ের মৌখিক অনুমতি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কাণ্ডারী-১০ জাহাজ পাঠালেও সেটিও কাজে লাগানো হয়নি বলে উল্টো অভিযোগ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে বন্দর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলেছে, মূলত বে-ক্লিনার-২ জাহাজটি কেনা হলেও সেটি বর্তমানে অকেজো অবস্থায় রয়েছে। মাত্র চার বছর আগে কেনা জাহাজ অকেজো হয়ে পড়া বা ‘পুরনো’ জাহাজ কিনে বন্দরে নতুন হিসেবে গছিয়ে দেয়ার গোমর ফাঁস হয়ে যাবে- এমন আশংকা থেকেই বে-ক্লিনার-২ জাহাজটি সুন্দরবনে পাঠানো হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালে প্রায় ৪৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের আওতায় বন্দরের বহির্নোঙরে বিদেশী জাহাজের ছড়িয়ে দেয়া তেল নদীর পানি থেকে শুষে নেয়া এবং ভাসমান বর্জ্য পরিষ্কার করার জন্য কেনা হয় দুটি জাহাজ- বে-ক্লিনার-১ ও বে-ক্লিনার-২। বে- ক্লিনার-১ এর কাজ হচ্ছে আউটারে নদীর পানিতে ভাসমান বস্তু তুলে নিয়ে তা নির্দিষ্ট ডাম্পিং স্টেশনে ডাম্পিং করা। বে-ক্লিনার-২ নদীতে ছড়িয়ে পড়া বা জাহাজের ভেতর থেকে যাওয়া তেল শুষে নেয়ার কাজ করে। জাহাজে থাকা এক ধরনের ফোম দিয়ে বে-ক্লিনার-২ নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়া রোধ করে নির্ধারিত স্থান থেকে তেল শুষে নিতে সক্ষম। এক সঙ্গে ৭০ হাজার লিটার তেল বা পানি শুষে নেয়ার ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ওই জাহাজের।
বন্দর সূত্র আরও জানায়, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) নীতিমালা অনুযায়ী বিশ্বের প্রতিটি বন্দরেই নদীকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে এ ধরনের বে-ক্লিনার জাহাজ থাকার বিধান রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরও সেই নীতিমালা মানতে বে-ক্লিনার জাহাজ দুটি কিনেছে। বে-ক্লিনার-১ তুর্কির তৈরি। এটি সরবরাহ করে জাহানারা এন্টারপ্রাইজ নামে মাহফুজুর রহমানের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। বে-ক্লিনার-২ জাহাজটি সরবরাহের আন্তর্জাতিক টেন্ডার পায় ফিনল্যান্ড। তাদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে এটি তৈরি ও সরবরাহ করে চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের পরিচালক (টেকনিক্যাল) মোহাম্মদ আবদুল মোবিন তাদের সরবরাহ করা জাহাজ বে-ক্লিনার-২ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ‘বিশেষায়িত এই জাহাজ নদীতে ছড়িয়ে পড়া তেল অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে পরিবেশ সম্মতভাবে শুষে নিতে সক্ষম। ওই জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা দেশী-বিদেশী জাহাজ বা মাদার ভেসেল থেকে বের হয়ে যাওয়া বা নিঃসরিত তেল নদী থেকে শুষে নেয়। তেল যাতে ছড়িয়ে না পরে সে জন্য নদীতে ফোম ছেড়ে দেয়। ওই ফোমের বাইরে তেল ছড়াতে পারে না। এই ফোম পানির সঙ্গে মিশ্রিত তেল বিশেষ কায়দায় শুষে নিয়ে জাহাজের নির্ধারিত স্থানে রাখে। পরে তা তীরে নিয়ে আসা হয়। আমি যতটুক জানি এই জাহাজটি বন্দরে তেল শোষণকাজে নিয়োজিত বা অপারেশনে আছে।’ এই জাহাজটি চাইলে সুন্দরবনে পাঠানো যেত কীনা, বন্দরের বাইরে যাওয়ার পারমিশন ছিল কিনা, থাকলে কেন পাঠানো হয়নি সে বিষয়টি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবে বলে জানান তিনি।
বে-ক্লিনার-২ জাহাজ সুন্দরবনে না পাঠানো প্রসঙ্গে নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেছেন, ‘মূলত বন্দর কর্তৃপক্ষ ৪০ কোটি টাকায় দুটি বে-ক্লিনার জাহাজ কিনলেও সেগুলো ছিল রিকন্ডিশন বা পুরনো। কেনার পর এগুলো উল্লেখযোগ্য কোনো অপারেশনে যায়নি। আবার অপারেশনে না গেলেও এগুলো মেরামতের নামে গত ৫ বছরে খরচ করা হয়েছে ৮ কোটি টাকা!’ বন্দরের অর্থ লোপাটের জন্যই এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। দুটি জাহাজের বিষয়েও ইতিপূর্বে সুনির্দ্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।’ বে-ক্লিনার জাহাজ সুন্দরবনে পরিবেশ বিপর্যয়রোধে না পাঠানোর রহস্য উদঘাটন এবং এজন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী বরাবর জরুরি ফ্যাক্সবার্তাটি পাঠিয়েছেন।
এদিকে মহিউদ্দিন চৌধুরীর এমন ফ্যাক্সবার্তা ও বে-ক্লিনার জাহাজ-২ সুন্দরবনে না পাঠানো প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার অ্যান্ড মেরিন) কমডোর এম শাহজাহান যুগান্তরকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় বা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর আমাদের কাছে এই জাহাজ চায়নি। আমরা কেন স্বপ্রণোদিত হয়ে জাহাজ পাঠাবো। এরপরও টিভি স্ক্রল দেখে আমরা মন্ত্রণালয়ের মৌখিক অনুমতি নিয়ে বন্দরের উদ্ধারকারী জাহাজ কাণ্ডারী-১০ পাঠিয়েছি। কিন্তু সেটিকেও ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। অথচ সেটি ব্যবহার করলে, যথাসময়ে ডুবে যাওয়া অয়েল ট্যাংকারটি টেনে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা হলে শ্যালা নদীর ৫০০ মিটারের মধ্যে দূষণ সীমাবদ্ধ রাখা যেত। ৩৫০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে এভাবে দূষণ ছড়াতো না। ঘটতো না পরিবেশ বিপর্যয়।’
বন্দরের ওই সদস্য আরও বলেন, ‘কাণ্ডারী-১০ জাহাজের মাধ্যমে দূষণ রোধে বিশেষ কেমিক্যাল দুর্ঘটনাস্থলে তথা নদীর পানিতে ছিটালে এবং পাম্পিং করে দূষিত পানি চাখ করে নেয়া হলে এমন পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতো না। অথচ বে-ক্লিনার-২ জাহাজের চেয়েও দূষণ রোধে অধিকতর সক্ষম সেই জাহাজটি কেন ব্যবহার করতে দেয়া হল না সে প্রশ্নটি কেউই করছে না। ’ তিনি এ দুর্ঘটনার জন্য তেল পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড তথা এর টার্মিনাল অপারেটরকে দায়ী করে বলেন, ‘তাদের পাঠানো সেই অয়েল ট্যাংকার ‘সাউদার্ন স্টার-৭’ ডুবে যাওয়ার পর এ ঘটনাটি ৪৮ ঘণ্টা গোপন রাখে তারা। যে কারণে তেল বের হয়ে দূষণ ছড়িয়েছে আরও বেশি।’ বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরীর পাঠানো চিঠিতে বে-ক্লিনার-১ ও বে-ক্লিনার-২ জাহাজের কথা বলা হলেও বে-ক্লিনার-১ জাহাজটি নদীর পানিতে ভাসতে থাকা বিভিন্ন বস্তু তুলে নিয়ে ডাম্পিং করে। দূষিত পানি পরিষ্কার করে না। কেবল বে-ক্লিনার-২ জাহাজটিই নদীর দূষিত পানি শোষণ করে পরিবেশ সম্মতভাবে। এই জাহাজের ধারণ ক্ষমতাও অনেক কম।’ বে-ক্লিনার-২ জাহাজ কোথায় কী অবস্থায় আছে এমন প্রশ্নের জবাবে মেম্বার হারবার বলেন, ‘এই জাহাজটির মেইনটেইনেন্স কাজ চলছে।’

No comments

Powered by Blogger.