বন্ধুর জন্য by মুশতাক মুকুল

গলায় প্লাকার্ড ঝুলিয়ে এবার আর শীতার্ত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র তুলতে দেখা যাবে না ইউসুফকে। তাই ওর তাগাদা পেয়ে ভ্যানগাড়ি নিয়ে বস্ত্র সংগ্রহের জন্য সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ার তাড়াও নেই। তবুও ভোরের কুয়াশা ভেদ করে সূর্য ওঠার আগেই আমরা কয়েক বন্ধু নেমে পড়ি রাস্তায়। শুধু আমাদের সঙ্গে ইউসুফ নেই। ওর ছবিসমেত কয়েকটা পোস্টার অবশ্য আমাদের সঙ্গে আছে। তবু আজকের শীতের সকালটা অনেক বেশি অচেনা মনে হয়। মাস দুয়েক আগে ও বলেছিল, দোস্ত এবার কিন্তু শীতের শুরুতেই কাজে নামতে হবে। এবার আমরা যাব কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মঙ্গাপীড়িত কোনো মানুষকে শীতে আমরা মরতে দেব না ইনশাআল্লাহ্। এ কথা বলার সময় ওর চোয়াল দুটো শক্ত হয়। আমরা ওর এমন রূপের সঙ্গে পূর্বপরিচিত। কোনো বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে ওর চোয়াল জোড়া আপনাআপনি শক্ত হয়ে যায়। হয়তো সব শক্তি-স্পৃহা এসে মাংসপেশিগুলোকে সজোরে আঁকড়ে ধরে, যেন কোনো বোমা বিস্ফোরণের ঠিক আগমুহূর্ত। আমরা ওর কথায় সম্মতি জানাই। ওর কথায় কেউ দ্বিমত পোষণ করবে, তার সাধ্য অবশ্য আমাদের কারোরই নেই। আমরা ওকে আমাদের নেতাই মেনে নিয়েছি বলা যায়। কারও পড়ার সমস্যা? ইউসুফ আছে। নোট-সাজেশন দরকার? ইউসুফ থাকতে চিন্তা কী! টিউশনি পাচ্ছে না, ইউসুফ জোগাড় করে দেবে। কারও ব্লাড লাগবে? ইউসুফকে ফোন দাও। বন্ধুদের সব সমস্যার সমাধান- ব্যাংক যেন ইউসুফ। সঙ্গে বিনয়ী গুণের সঙ্গে ভুবন ভোলানো হাসি পাখির পালকের মতো ওর ব্যক্তিত্বে বাড়তি শোভা যোগ করেছে। এতসব গুণের কারণেই অনার্সের প্রথম বর্ষ থেকেই আমরা স্বজ্ঞানেই হয়তো ওর বশ্যতা মেনে নিয়েছিলাম। তাইতো শীতের হিমেল হাওয়ায় অন্ধকার ভেদ করে দিবাকর জেগে ওঠার আগেই ওর ডাকে আমরা বেরিয়ে পড়তে পিছপা হই না। একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান কেবল মেধা আর নিজস্ব গুণাবলী দিয়ে কীভাবে যে অন্যদের প্রভাবিত করে, ইউসুফ হয়তো তার যথার্থ প্রমাণ। তাইতো মাস্টার্স শেষবর্ষে এসেও আমরা ওকে অনুসরণ করি। ওর নির্দেশ পালন করি । কিন্তু ওর জন্য আজ যে আমাদের রাস্তায় নামতে হবে তাইবা কে ভেবেছিলাম! আমাদের প্রিয় বন্ধুর যে আজ বড় বিপদ। সারা দিনের খাটুনি তাইতো আমাদের এতটুকুও ক্লান্ত করতে পারে না। বিকালে সব বন্ধু মিলে ছুটে চলি ইউসুফকে দেখতে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের ৯০১ নম্বর রুমের ২৩ নম্বর বেডে শুয়ে আছে আমাদের প্রিয় ইউসুফ। সুঠাম দেহের করুণ পরিণতি- কংকালসার ভগ্নদেহ, ঘুমিয়ে আছে। মাথার পাশে বসে থাকা মায়ের নয়নে অশ্র“, চোখের নিচের কালি দেখে বোঝাই যায় ভীত মা কয়েক রাত ঘুমাননি। উনি ইউসুফের সঙ্গে ঢাকা শহর দেখতে আসতে চেয়েছিলেন। শুধু অপেক্ষায় ছিলেন ছেলের একটা ভালো চাকরি পাওয়ার। কিন্তু তিনি ছেলের জন্য এভাবে তো আসতে চাননি। আমি ওর মা-বাবার মনের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করি। এমন সময় ইউসুফের ঘুম ভাঙে, আমাদের দেখে ওঠে বসতে চায়। আহা একদম ওঠবি না- বলে ওঠে বন্ধু রিনা। সারাক্ষণ প্রাণোচ্ছল ইউসুফের ওষ্ঠ জোড়া সজোরে বিকশিত হয়, ঘরজুড়ে হাসির জোয়ার তোলে। আমি এগিয়ে যাই। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলে, দোস্ত, এবার মনে হয় যেতে পারবো নারে। তা কতগুলো পোশাক উঠল? ওর কথার উত্তর দিতে পারি না। আমাদের সবার চোখ ছলছল করে ওঠে। ছেলেটা আসলে কী যে! ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ইউসুফের চোখের কোনাও কি ভিজে ওঠে? নাকি ক্যান্সারের নীল যন্ত্রণায় ওর চোখ দুটোকে ঘোলাটে দেখায়। আমার দিকে অপলক চেয়ে থাকে। ওর অসহায় দরিদ্র বাবা-মা গুমরে কেঁদে ওঠেন। ওদের স্বপ্নের প্রদীপ চোখের সামনে একটু একটু করে নিভে যাচ্ছে। আমি আর দাঁড়াতে পারি না। ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসি। চোখ বন্ধ করি। আমার ভেতর থেকে কে যেন নাড়া দিয়ে ওঠে। ইউসুফকে যেভাবেই হোক বাঁচাতে হবে। আমরা ওর চিকিৎসার টাকা জোগাড় করব। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্য চাইব। দেশবাসীর কাছে হাত পাতব। রাস্তায় নামব। সারা বাংলাদেশ ওর পাশে দাঁড়াবে। আমাদের ইউসুফ বাঁচবে। ওকে যে বাঁচতেই হবে। আমার চোয়াল জোড়াও কি এবার শক্ত হয়ে ওঠে? আমার পিঠে কার যেন একটা হাত এসে পড়ে। ফিরে দেখি ফরহাদ, মানিক, খালেদা, সনিসহ সব বন্ধু আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওরা সবাই যেন আমার মনের কথা পড়ে নিয়েছে।
সরকারি তিতুমীর কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স শেষবর্ষের মেধাবী ছাত্র মো. ইউসুফ শিকদার ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। উন্নত চিকৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেয়া একান্ত প্রয়োজন। সবার সহযোগিতা পেলে সে হয়তো আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবে। সহায়তার হাত বাড়িয়ে তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। আর্থিক সাহায্য পাঠানোর ঠিকানা : সঞ্চয়ী হিসাব নং : ১০০১০৪৭৬, মো. : হেলালউদ্দিন শিকদার, সোনালী ব্যাংক, কুর্মিটোলা শাখা, ঢাকা। বিকাশ অ্যাকাউন্ট (পার্সোনাল) : ০১৯১২৩৬৯৯৬০ (ইউসুফ)।
মুসতাক মুকুল : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.