প্রাণ-প্রকৃতি-সুন্দরবন চেইনের গ্রন্থিগুলো আলগা করবেন না by জয়া ফারহানা

‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ যে নদীতে ডুবেছে, সেই শ্যালার মোহনায় দু’শ বছর আগে বিস্তর গণ্ডার চরে বেড়াত। ছিল অগণিত চিতা, গুলবাঘ, জলময়ূর, ষোলো লাখ জাতের পাখি, আরও কত কী! কল্পনা করুন তো সেই দৃশ্য! কল্পনা অতদূর পৌঁছায় না অবশ্য। আলকাতরার মতো ফার্নেস অয়েলের কারণে শ্বাসমূল আর ঠেসমূলের নিঃশ্বাস যেখানে বন্ধ হওয়ার জোগাড়, সেখানে কল্পনা অতদূর পৌঁছানোও মুশকিল। তবু সত্য এই যে, অবিরাম জোয়ার-ভাটায় তৈরি হওয়া ভিন্নরকম পলিমাটির এই জলাভূমিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদ পোহাতো কুমির। আর দূর থেকে কুমিরের এই মরার মতো পড়ে থাকা দেখে তাকে কাঠের টুকরো ভেবে কাছে এসে বোকা হরিণকে হতে হতো কুমিরের নাশতা। কেউ কেউ বলেন- সুন্দরবনের লয়, ক্ষয় নেই, সে নিজেই এক সয়ম্ভর ভূমি। নয়তো ১৭৩৭, ১৭৬২, ১৮১০, ১৮২১, ১৮৫২, ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের মতো ঝুঁকিপূর্ণ সব ভূমিকম্পকে মোকাবেলা করে সুন্দরবন নিজের মতোই টিকে আছে কীভাবে? এই বনের সর্বত্র মাটির নিচে রয়েছে বিস্তর জলের সঞ্চয়। গাছ সেই সঞ্চিত জল থেকে তার খাবারের রস নিয়ে নেয়। বছরের অধিকাংশ সময় এখানে জোয়ার থাকে, জমি নিজে থেকে না উঠলে কৃত্রিম উপায়ে তাকে উঠানো যায় না। বনের যে জায়গায় ভূমি নিচু, শত চেষ্টা করেও সেখানে জঙ্গল ধ্বংস করা যায় না। অরণ্য কেটে ফেললে জলের সাহায্য নিয়ে তা আবার জন্মায়। এটা হল সুন্দরবনের ভূমির নিজস্ব চরিত্র, যা অন্য আর সব অরণ্যের ভূমিচরিত্র থেকে আলাদা। দুর্ভাগ্য, ফার্নেস অয়েলের ট্যাংকারটি ডোবার পরে সুন্দরবন অতিক্রম করেছে একটি পূর্ণিমা। পূর্ণিমার সঙ্গে জোয়ার যুক্ত হওয়ায় বিপর্যয় ত্বরান্বিত হয়েছে। ফলে মূল শ্যালা নদী থেকে শাখা নদী এবং আশপাশের উদ্ভিদের শ্বাসমূল থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল তেল। যাহোক, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রতিদুর্ঘটনা, উপদুর্ঘটনা ঘটার আশংকা থাকে বলেই পরিবেশবিষয়ক চিন্তাবিদরা অনেকদিন থেকেই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সব ধরনের পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের নৌ-মন্ত্রণালয় চিরবিদ্রোহী বীর! তারা কারও কথা শুনবে কেন?
কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করার মতো দুর্বল নন তারা। এমনকি তা যদি হয় সুন্দরবন, তবু। ইতিমধ্যে নৌমন্ত্রী বলে ফেলেছেন, ‘এমন কোনো ক্ষতি সুন্দরবনের হয়নি!’ ক্ষতি কতটা হয়েছে বা হয়নি সেটা পরে, তার আগে বলা দরকার এমন মন্ত্রী থাকাটাই সুন্দরবনের জন্য এক ক্ষতি। ‘মানুষ বড় না সুন্দরবন বড়’ জাতীয় গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে মানুষের প্রতি তিনি তার অসীম দরদের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তবে তো এর আগে ঘটে যাওয়া ছোট-বড় হরেক কিসিমের নৌদুর্ঘটনার স্মৃতি আমাদের স্মরণে আনতেই হয়। সামান্য সতর্কতা গ্রহণ করলে যেখানে এসব দুর্ঘটনা এড়ানো যেত, সেখানে নৌদুর্ঘটনার শিকার অকাতর মানুষের মৃত্যু দেখে আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, নৌ-মন্ত্রণালয়ের কাছে মানুষের জীবন কী মহামূল্যবান! এমনতর মানবদরদি মন্ত্রীর পক্ষেই তো সম্ভব, মানুষ বড় না সুন্দরবন বড় সেই প্রশ্নকে গুরুতর করে তোলা। আবার ট্যাংকারডুবির ১০ ঘণ্টা পর যিনি দুর্ঘটনার সংবাদ পান, তাকে বনদরদি না বলে উপায়ই বা কী! নৌ-মন্ত্রণালয়ের ধারণা অবশ্য সব মুশকিল আসানের জন্য ‘নির্ভীক’ আর ‘প্রত্যয়’ তো আছেই। সেজন্য তারা খুব বেশি চিন্তা করেনি। তাদের ধারণা, নৌপথে এমন কোনো সমস্যা নেই যা ‘নির্ভীক’ আর ‘প্রত্যয়’ সমাধান করতে পারে না। যথারীতি এবারও তাই পাঠানো হয়েছিল ‘নির্ভীক’ আর ‘প্রত্যয়’কে। অন্যান্য নৌদুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যেমন, তেলের ট্যাংকারডুবির ঘটনাতেও তেমন ‘নির্ভীক’ আর ‘প্রত্যয়’ তাদের অসামান্য পারফরম্যান্স দেখিয়ে এসেছে।
মানুষ বড় না সুন্দরবন- এ প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই নৌমন্ত্রীর অজানা নয়। প্রকৃতি ও প্রাণ দুয়ে মিলেই তো একটা চেইন। সুন্দরবনজুড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করতে হয়- প্রাণ, প্রকৃতি ও সুন্দরবন এই চেইনের গ্রন্থিগুলো আলগা হচ্ছে কার দোষে? ইকোসিস্টেম জানা-বোঝা মানুষকে নতুন করে ইকোসিস্টেম বোঝানোর দরকার নেই। মুশকিল এই যে, নিজেকে বেশি বুঝদার মনে করেন যিনি, তার হাতেই সর্বনাশ ঘটানোর ক্ষমতা থাকে বেশি। সুন্দরবনের নৌরুট দিয়ে চলাচলকারী তেলবাহী জাহাজগুলো বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, এই সাবধানবাণী আন্তর্জাতিক মহল থেকেও (ইউনেপ, এসকাপ, সাসেফ) বহুবার বহুভাবে উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু নৌ-মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। আগেই বলেছি নৌ-মন্ত্রণালয়ের অজানা কিছুই নেই। যেহেতু তারা সব জানে (জল, স্থল, অন্তরীক্ষ), তাই অন্যের পরামর্শ শোনার প্রয়োজন নেই তাদের।
তেলবাহী ট্যাংকার ডুবলে তা যে কেবল পরিবেশের মধ্যেই সীমিত থাকবে না, আক্রান্ত হবে মানুষও, ছিল সেই সতর্কবার্তাও। মানুষ আর প্রকৃতি আলাদা নয় বলেই ক্ষতিটাও একটা চেইন। এক ক্ষতি আরেক ক্ষতিকে কীভাবে ডেকে আনে, লক্ষ্য করুন। বলা হল, স্থানীয় উপায়ে জাল ভাসিয়ে তেল তোলা হোক। ভাসানো হল জাল। অপরিশোধিত তেলের ভারে জাল গেল ছিঁড়ে। শরীরে তেল লেগেছে, তাই স্থানীয়রা এখন নানা রকম শারীরিক সমস্যা মোকাবেলা করছেন। প্রকৃতির সঙ্গে প্রাণের সম্পর্ক আলাদা করে ভাবার সুযোগ কোথায়? ক্যাম্পেইন করে সুন্দরবনকে আমরা সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় আনতে পারিনি, সেই হতাশা ছিল অন্তরে। এবার দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছি। সুন্দরবনের মধ্যে তেল ট্যাংকারডুবির ঘটনায় বিশ্ববাসীর কাছে ‘বিস্ময়ের বিস্ময়’ হয়েছি আমরা। সুন্দরবনকে সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় রাখতে পারিনি, তাতে কী? সুন্দরবন বিষয়ে আমাদের উদাসীনতা দেখিয়ে তো বিশ্ববাসীকে ভড়কে দিয়েছি! অরণ্যকে কেন্দ্র করে এমন আশ্চর্য মানসিকতাও কি বিশ্ববাসী দেখেছে কখনও? ঘটনাটি কাকতালীয়। ডিএল রয়, তখন খুলনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। এই সুন্দরবনেই বসে লিখেছিলেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’ সব সম্ভবের এমন দেশ কোথায়ই বা আছে? জয়তু ডিএল রয়।
জয়া ফারহানা : লেখিকা

No comments

Powered by Blogger.