চলে গেলেন সোনালি স্বপ্নের বিজ্ঞানী

পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনকারী বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম আর নেই। বাংলাদেশ সময় রোববার ভোরে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে কুইনস মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। মাকসুদুল লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন। শেষ দিকে লিভারের সঙ্গে তার ফুসফুসও ঠিকমতো কাজ করছিল না। তার ছোট ভাই জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের পরিচালক মাহবুবুল আলম বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বাংলাদেশ সময় রোববার ভোরে তার মৃত্যু হয়। বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানোয়ার ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের অধীনে কলেজ অব ন্যাচারাল সায়েন্সেসে জিনোমিক্স, প্রোটিওমিক্স ও বায়োইনফরমেটিকস বিভাগের পরিচালক পদে কাজ করে আসছিলেন। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মাকসুদুলকে হাওয়াইয়ের মেমোরিয়াল পার্কে দাফন করা হবে। পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনকারী বিজ্ঞানী মাকসুদুলের মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করে তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। বাংলাদেশের  কৃষি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় ২০১০ সালে  তরুণ একদল বিজ্ঞানীকে নিয়ে তোষা পাটের জিন নকশা উন্মোচন করে প্রথম আলোচনায় আসেন মাকসুদুল আলম। ওই বছর ১৬ই জুন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে দেশবাসীকে সেই সুখবর জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও খবরটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার হয়। এ কারণে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনকারী মাকসুদুল ও তার সহকর্মীদের কল্যাণে আরেকটি সাফল্যের খবর দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১২ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর তিনি জানান, মাকসুদুল ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা নামের এক ছত্রাকের জিন-নকশা উন্মোচন করেছেন, যা পাটসহ প্রায় ৫০০ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়। গত বছর ১৮ই আগস্ট মাকসুদুলকে পাশে নিয়েই বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের আরেকটি বড় সাফল্যের খবর জানান প্রধানমন্ত্রী। এবার আসে দেশী পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের খবর। জিনোম হলো প্রাণী বা উদ্ভিদের জিনেটিক বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। এই নকশার ওপরই নির্ভর করবে ওই প্রাণী বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য। এর আগে ২০০৮ সালে হাওয়াইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পেঁপে এবং মালয়েশিয়া সরকারের হয়ে রাবার গাছের জীবনরহস্য উন্মোচনেও নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশের এই বিজ্ঞানী। পেঁপে নিয়ে তার কাজের খবর বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হয়। ওই প্রতিবেদনে মাকসুদুলকে পরিচয়  করিয়ে দেয়া হয় ‘বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবক’ হিসেবে।  মাকসুদুল আলম ১৯৫৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা দলিলউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (বর্তমান বিজিবি) একজন কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন মাকসুদুল আলম। পরে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) চলে  যান। ১৯৭৯ সালে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি অণুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮২ সালে একই  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অণুপ্রাণবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন মাকসুদুল। এর   পাঁচ বছর পর জার্মানির ম্যাক্স-প্লাংক ইনস্টিটিউট অব বায়োকেমিস্ট্রি থেকে প্রাণরসায়নেও তিনি পিএইচডি করেন। ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়েতে যোগ  দেয়ার আগে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি, রাশিয়ার বিজ্ঞান একাডেমি, ম্যাক্স-প্লাংক ইনস্টিটিউট এবং ওয়াশিংটন স্টেট   ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। অণুপ্রাণবিজ্ঞানের গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে  এনআইএইচ শ্যানান অ্যাওয়ার্ড পান মাকসুদুল আলম। ২০০১ সালে  একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোর্ড অব রিজেন্টস এক্সেলেন্স অব রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.