আনা ফ্রাংকের ডায়েরি ও মিয়েপ গাইজ by ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

গত জানুয়ারি ১১-এ ১০০ বছর বয়সে মিয়েপ গাইজ মারা গেছেন। মিয়েপ গাইজ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নাজিদের বর্বরতায় আমস্টার্ডামে দম আটকোনো এক ইহুদী কিশোরী আনা ফ্রাংকের দিনলিপি সারা পৃথিবীর জন্য রা করেছিলেন,
মানবতার মুক্তির আর্তিকে ক্রুর শক্তির অসভ্যতা দিয়ে ছড়ানো জীবনের ভীতির বাইরে টেনে এনে সকলের জীবনের অনুভূতি-আকাঙ্া অবয়বে দেশ থেকে দেশান্তরে লালনীয় ও অনুসরণীয় মূল্যবোধের আকারে পেঁৗছে দিয়েছিলেন। আনা ফ্রাংক নারী রূপে বিকশিত হওয়ার আগে ১৫ বছর ৯ মাস বয়সে নাজিদের বার্গেন-বেলসেন বন্দী শিবিরে প্রাণ হারিয়েছিলেন। তার বড় বোন ১৯ বছরের মার্গট মারা গিয়েছিলেন একই শিবিরে। তার মা এডিল মারা গিয়েছিলেন সেই কুখ্যাত অসউইজে। যুদ্ধের পর অসউইজ থেকে মুক্তি পেয়ে বাবা অটো ফ্রাংক আমস্টার্ডামে ফিরে এসে এদের কাউকে খুঁজে পাননি। অটো ছিলেন অস্ট্রিয়ান, জন্মেছিলেন ভিয়েনায়। যুদ্ধের অনেক আগে এসেছিলেন আমস্টার্ডামে। ব্যবসা করতেন। মিয়েপ গাইজ ছিলেন রোমান ক্যাথলিক, তার সচিব। ১৯৪০ সালের মে মাসে নাজিরা নেদারল্যান্ডস ও আমস্টার্ডাম দখল করে। ১৯৪২ সাল থেকে নাজিরা ডাচ ইহুদীদের ধরে বন্দী শিবিরে পাঠাতে শুরু করে। অত্যাচার ও বন্দিত্ব থেকে বাঁচার আশায় অটো ফ্রাংক, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে এবং ব্যবসায়ে সহযোগী ভ্যন পেলসের তিন সদস্যের পরিবার ও গাইজের দন্ত চিকিৎসক ফ্রিজ পেফেফার ফ্রাংকের অফিস ইমারতের উপরে গাইজের আশ্রয়ে চুপিসারে বাস করতে থাকেন। যুদ্ধের প্রায় ২৫ মাস ধরে মিয়েপ তার স্বামী সমাজ সেবক জান ও ৩ জন কর্মচারী ফ্রাংকের পরিবারসহ এই ৮ জন ইহুদীকে লুকিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন। তারা জানতেন ধরা পড়লে তাদের মেরে ফেলবে নাজিরা। তারা চুপিসারে তাদের জন্য নিজেদের খাবার দিয়েছেন, পড়ার বই এনেছেন, আবেগী সমর্থন যুগিয়েছেন। ১৯৪৪-এর ৪ আগস্ট নাজিরা এসব আশ্রিতদের ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বর্বর নাজিরা আনা ফ্রাংকের ছড়ানো পাতায় লেখা দিনলিপি দেখেনি, তাই নিয়ে যায়নি। মিয়েপ গাইজ সেই দিনলিপির পাতাগুলো কুড়িয়ে রেখে দেন, যদি কোন দিন আনা বা তার কেউ ফিরে আসেন, এই আশায়। যুদ্ধের ধ্বংস ও জাতি হত্যার বীভৎসতা থেকে ফিরতে পেরেছিলেন কেবল বাবা ফ্রাংক_ যার হাতে গাইজ তুলে দিয়েছিলেন আনার দিনলিপির বিবর্ণ অথচ অনুভূতিতে জীবন্ত পাতাগুলো।
আনার দিনলিপি প্রকাশিত হয় ১৯৪৭-এ। এর অনুবাদ আমি প্রথম পড়েছি ১৯৫৮-এ যখন আমি কলেজে পড়তাম। এর মধ্যে এক ডজন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই দিনলিপি, কোটি লোক পড়েছেন তা, মঞ্চে ও ছবিতে প্রাণ পেয়েছে উঠতি বয়সের সেই মেয়ে আনার কথা ও কাহিনী। পড়েছি, মনে গেঁথেছি, অনুভব করেছি আনার ছোট ছোট অলঙ্কার বিবর্জত কথা, দেয়াল দিয়ে ঘেরা মানুষের প্রাণের টুকরো টুকরো ছবি, বন্দী জীবনের মুক্তির আকুতি, সহ-আশ্রিত কিশোর পিটারের প্রতি কিশোরীর কোমল অনুভূতি ও প্রেমময় স্পন্দনের স্ফুরণ, অভাব, দুঃখ, বঞ্চনার মাঝেও মানব সন্তান হয়ে বেঁচে থাকা। মনে হয়েছে, আনা, কথা নয়, অবনীন্দ্র ঠাকুরের ভাষায় ছবি লিখেছেন, জীবনের অনাবিল মুহূর্তগুলোকে অন্তরের রং আর কল্পনার তুলি দিয়ে সকল উঠতি-বয়সের মানব সন্তানদের অস্তিত্ব, আশা-আকুতিকে বাঙ্ময়, স্নিগ্ধ ও আদরণীয় অবয়বে ফুটিয়ে তুলেছেন। পড়েছি আর ঘৃণা করতে শিখেছি, বন্দিত্ব, নির্যাতন, হানাহানি আর ধর্ম ও বর্ণের মানুষ-সৃষ্ট বৈষম্যকে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে চেয়েছি শাশ্বত মানবিক মূল্যবোধকে। আনার দিনলিপি আমার কলেজ জীবনে চিরায়ত মানবতাবোধকে আকড়িয়ে ধরে দুঃখ, কষ্ট, বঞ্চনা ও বৈষম্যের মাঝে, সভ্যতা-ভব্যতার দুবর্ৃত্ত-সৃষ্ট সীমাবদ্ধতার বেদনাকে ছাড়িয়ে মানবিক মূল্যবোধকে লালন করে অসীম আশা-আকাঙ্া ও প্রাপ্তির প্রত্যাশাকে অনুভবের বলয়ে নিয়ে এসেছে।
২০০২-এ খালেদা-নিজামী সরকারের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে স্ত্রী সিতারাসহ আমস্টার্ডামে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম সেই ছোট্ট ইমারতটি, যেখানে মিয়েপ গাইজ লুকিয়ে রেখেছিলেন ফ্রাংক ও পেলসের দুই পরিবার এবং পেফিফারকে। ইমারতটিকে অনেক আগেই জাদুঘর হিসাবে ডাচরা আনা ফ্রাংক যেভাবে সেখানে দিন কাটিয়েছেন সেভাবেই রা করে এসেছেন। দেখেছি, ঠেলে সরানো বইয়ের আলমারির পেছনে আনা ও তার বাবা মায়ের বন্দী জীবনের আশ্রয় স্থল দুই কুঠরি, ছড়ানো ছিটানো দু তিনটি আসবাব, চোখ না গলানো বাইরের মুক্ত জীবনের ঘুলঘুলি, দম বন্ধ করা চিলে কোঠা, জোর করে দেয়াল দিয়ে ঘেরা দাসত্বে ঠেলে দেয়া যাপিত জীবনের অসহ্য যন্ত্রণার নীরব দর্শক ছোটখাটো জিনিস পত্তর। শুনেছি কেমন করে মিয়েপ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদের দেখভাল করেছেন, আনার জীবনের প্রথম উচু হিলের জুতো দিয়েছিলেন, তাদের জন্য ছুটির দিনের কেক তৈরি করেছিলেন, স্বামী জানসহ একরাত সে ইমারতের চিলেকোঠায় তাদের সাথে কাটিয়ে ভীতি ও নির্যাতনকে উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন। শুনেছি সকল ভয় কাটিয়ে কেমন করে তিনি ও তার স্বামী তাদের এ্যাপার্টমেন্টে নাজিবিরোধী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে মুক্তি পাওয়ার এবং মানবিক মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের আশায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। জেনেছি, তার স্বামী জান নাজিদের প্রতিরোধে নিজকে কিভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গোপনে নিবেদন করেছিলেন, ডাচ মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হয়েছিলেন।
সিতারাসহ যখন মিয়েপ গাইজ ও আনা ফ্রাংকের আশ্রয়স্থল ২৬৩ প্রিন্সেনগ্রাকট, (যা এখন জাদুঘর) ধীর পায়ে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম তখন অজান্তেই চোখ ভিজে এসেছিল। আনা ও তার পরিবার, তার বন্ধু পিটার, মিয়েপ ও জান গাইজের কাহিনী টেনে নিয়ে এসেছিল আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের ছড়ানো ছিটানো স্মৃতি, গণতন্ত্রকে উপড়ে দেয়া স্বৈরতান্ত্রিকতার নির্যাতনের কথা, মানুষের চিরায়ত মুক্তির পথে দানবের অশুভ হাতছানির ঘটনা।
স্মৃতির পটে ভেসে এসেছিল, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঢাকায় ধানমণ্ডিতে বেগম মুজিব, অন্তঃসত্ত্বা হাসিনা ও তার স্বামী ওয়াজেদ, বোন রেহানা ও ভাই জামালের দখলদার পাকবাহিনীর হাতে বন্দী জীবন যাপনের খণ্ড খণ্ড ছবি। ছবিগুলো প্রাণ পেয়েছিল জননেত্রী শেখ হাসিনার কথায়। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত তাঁর সচিব হিসাবে কাজ করার সময় কাজের ফাঁকে ফাঁকে, তাঁর প্রিয় চা মুড়ি খাওয়ার ছেদে তিনি আনমনে তুলে ধরেছেন সেসব ছবি। দুঃখের শ্রান্তি ছাড়িয়ে প্রবল দৃঢ় সংকল্পের প্রতিফলন আর প্রতিধ্বনি ছিল সেসব কথায়। শুনেছিলাম, অশুভ-অসভ্য বর্বর পেশীশক্তি কেমন করে কুরে কুরে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের মুক্ত জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার স্বপ্ন ও জনগণের সাথে একাত্মবোধ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করতে অপচেষ্টা চালিয়েছিল; কেমন করে শেখ হাসিনা তার প্রথম সন্তানকে জন্ম দিয়েছিলেন বন্দীদশায়, মুক্তি ও বিজয়ের আর্তিতে তার নাম রেখেছিলেন জয়; কি অসীম সাহস ও গভীর দেশপ্রেমে তাড়িত হয়ে সেখান থেকে তাঁর ছোট ভাই জামাল পালিয়ে সেই বাড়ি থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। বড় ভাই কামাল তো '৭১-এর ২৫ মার্চেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশকে দখলদার বাহিনী থেকে মুক্তি দিতে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর তারা কেমন করে অস্ত্রবিহীনভাবে সশস্ত্র হানাদার পাক বাহিনীর বন্দিত্ব থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর পরিবার পরিজনকে। শ্রদ্ধায় মাথা নত করে শুনেছিলাম কি অসীম সাহস ও গভীর বিশ্বাসে বেগম মুজিব, সেই মহিয়সী মা, সকল সীমাবদ্ধতা, বন্দীত্বের হাজারো গ্লানি ছাড়িয়ে মুক্তির অপোয় দিন কাটিয়াছেন, সকলকে সাহস যুগিয়েছেন, এক মুহূর্তের জন্যও স্বাধীনতা প্রতীতি হারাননি। ১৯৪২-এ আনা ফ্রাংক ও তাঁর পরিবার এবং বন্ধুজনের নি্ে#৬৩৭৪৩;ষিত জীবনে মুক্তির আশার প্রতিফলন ১৯৭১-এ বেগম মুজিব, হাসিনা, রেহানা, জামাল ও ওয়াজেদের বন্দিত্বের নির্যাতন ছাড়িয়ে বিজয়ের অনুকূলে অবিচল বিশ্বাসের বিচ্ছুরণ, বাংলার আপামর জনগণের মুক্তির আর্তির স্পন্দনে মিলিয়ে-বিলিয়ে দেয়া সারথীর নিঃশ্বাস প্রশ্বাস পৃথিবীব্যাপী মুক্তিকামী মানবতার অবিনাশী আশাকে সর্বাত্মক দৃঢ়তায় আমাদের অনুভূতিতে প্রোথিত করে গেল যেন।
মনে এলো ১৯৭১-এ কি অদম্য সাহস ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক নিয়ে সরকারের ৭/৮ জন উপসচিব দেশের সকল জেলায় ছুটে যেয়ে জেলা প্রশাসকদের তাদের স্ব স্ব জেলার অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্রাদি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিতে বলেছিলেন। মনের পটে সুস্পষ্টভাবে ভেসে এলো, ফেনীর ছাগলনাইয়ার এক গ্রামে এক নবপরিণীতা যুবতী কেমন করে এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে নবেম্বরের এক রাতে নিজের সাথে একই লেপের নিচে শুইয়ে নিজের অসুস্থ স্বামী হিসাবে পরিচয় দিয়ে পাকিস্তানী দুবর্ৃত্ত সৈন্য ও তাদের অসভ্য দোসরদের হাত থেকে রা করেছিলেন; ডিসেম্বরের ১০ ও ১১-এ কি অদম্য সাহস ও ঝুঁকি নিয়ে কয়েকজন তরুণ তখনও দখলী ঢাকায় সরকারী কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিদিগকে গবর্নর মালিক আহূত সরকারী ভবনের সভায় যেতে নিষেধ করে তাদেরকে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন; মুক্তির আগমনকে সহায়তা করার ল্যে কিরকম দৃঢ়তা নিয়ে আমাদের মা-মেয়েরা দাউদকান্দির প্রত্যন্ত গ্রামে, মতলবের কালির বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের সন্তান ও ভাইয়ের মতো আশ্রয় দিয়েছিলেন, খাবার যুগিয়েছিলেন। অবচেতন মনে জানতে চাইলাম, এতদসত্ত্বেও কি লাভের আশায় জেনারেল জিয়া এই বাংলাদেশেই ১৯৭৫-৭৭-এ হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকিয়েছিলেন। মনে এলো যশোর কেন্দ্রীয় জেলে ১৯৭৬-এ অন্যদের মধ্যে মিজানুর রহমান চৌধুরী, আ.স.ম আব্দুর রব, জিয়াউদ্দীন সহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে রাজবন্দী রূপে অন্তরীণ দেখে জেলা প্রশাসক হিসাবে কিভাবে লজ্জায় মাথা নত করেছিলাম আমি। মনে এলো ২০০১-এর সেই তামাসার নির্বাচনে জয়ী হয়ে খালেদা নিজামীর দোসররা পশুর মানসিকতা নিয়ে কিভাবে চাঁদপুরের কচুয়ার কোয়া গ্রামে হিন্দু বোন রাখী রানীকে ধর্ষণ করে খুন করেছিল এবং সেই খুনের দায় তার স্বামী ব্রজগোপালের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল এবং শত খুনের কেদ নিয়ে কেমন করে ১৯৭৫-এর পরে নিজামীরা বাংলাদেশের পতাকা তাদের ধর্মান্ধতার মোকামে উড়িয়েছিল। জানতে চেয়েছিলাম পশুত্বের কোন পর্যায়ে নেমে নিজামীর দোসররা ১৯৭১-এর হানাদার পাক বাহিনীর ক্যাম্পে তাদেরই যুবতী মা-বোনদের ঠেলে দিয়ে না মরেই ইহকালে বেহেশত লাভের কোশেশ করেছিল।
জাদুঘরে তুলে রাখা তথ্য ঘেঁটে জেনেছি, মিয়েপের জন্ম হয়েছিল ১৯০৯ এর ফেব্রুয়ারি ১৫-এ, ভিয়েনাতে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর অস্ট্রিয়ায় চরম খাদ্যাভাব তাকে নেদারল্যান্ডসের লিডেনে এসে এক ডাচ পরিবারের সাথে তাদের দত্তক হিসাবে বড় হতে হয়। তেরো বছর বয়সে সেই পরিবারের সাথে তিনি আমস্টার্ডামে আসেন। ১৯৩৩-এ তিনি আনার বাবা অটো ফ্রাংকের সচিব হন। এর আগে নাজিদের নির্যাতন এড়াতে অটো ফ্রাংক জার্মানি থেকে আমস্টার্ডামে পালিয়ে আসেন। ১৯৪১ সালে মিয়েপ ডাচ সমাজকর্মী জান গাইজকে বিয়ে করেন। আনা ফ্রাংকের দিনলিপি প্রকাশিত হওয়ার অনেক বছর পর আলীসন ল্যাসলি গোল্ড নামক এক আমেরিকান লেখিকা মিয়েপকে তার কাহিনী বলতে ও প্রকাশিত করতে উৎসাহিত করেন। আনাদের গ্রেফতারের সময় রোমান ক্যাথলিক বলে তিনি গ্রেফতার ও নির্যাতন থেকে বেঁচে যান। গ্রেফতার থেকে বাঁচার পরও তিনি আনাসহ আটজনকে মুক্ত করতে আমস্টার্ডামের গেস্টাপো সদরে যান, নিদারুণ অপমান সত্ত্বেও গেস্টাপো প্রধানকে ঘুষ দিয়ে ওদেরকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেন। গাইজের জীবনের এই ঘটনার পটে ২০০৭ থেকে ২০০৮-এ ইয়াজউদ্দিন, ফখরুদ্দীন ও মইন উদ্দীনের স্বৈরতান্ত্রিকতায় দুনর্ীতির মিথ্যা দায় থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ নাগরিকদের ঘুষ দেয়া ও তাদের উপর লেলিয়ে দেয়া হিংস্র হায়েনাদের সেসব ঘুষ নেয়ার কথা জাতিগত দায় হিসাবে ভেসে এলো স্মৃতির পাতায়। তীব্র ঘৃণা ও অপরিসীম লজ্জায় মনে এলো এদেশের সেনা-গোয়েন্দাদের জার্মানির নাজি গেস্টাপোর অমানবিক ঐতিহ্য অনুসরণ করে নিজের দেশের মানবতাকে নির্যাতন ও অপমান করার শত কাহিনী_ কথা।
তার কাহিনী প্রকাশিত হওয়ার পর গাইজ দেশ বিদেশে আনা ফ্রাংকের সাথে জীবন্ত সংশ্রবের প্রতিফলক হয়ে ঘুরেন, আনার কথা, বাঁচার কথা, মুক্তির কথা, নাজিদের নির্যাতনের কথা, নির্যাতন ছাড়িয়ে মানবতার সংগ্রাম ও জয়ের কথা বলতে থাকেন। আনার বাবা অটো ফ্রাংক মহাযুদ্ধের পর গাইজদের সাথে থেকেছেন অনেকদিন। তিনি মারা যান ১৯৮০ তে। মিয়েপের স্বামী জান মারা যান ১৯৯৩-এ। আনা ফ্রাংক ও অন্যদের আশ্রয় দিতে ও বাঁচাতে যারা গাইজদের সহযোগিতা করেছিলেন, তারা, কিমান, কুগলার ও ভসকুইজল, আগেই মারা গিয়েছিলেন। মিয়েপের মৃতু্যর সাথে আনা ফ্রাংকের সেই জীবন, মুক্তির আর্তি, বন্দিত্বের বেদনার সাথে প্রত্য সংশ্রবে থাকা শেষ ব্যক্তিটি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ১৯৪৪ সালের ৮ মে আনা তার দিনলিপিতে ছোট্ট করে লিখেছিলেন, 'আমরা মিয়েপের ভাবনা থেকে কখনই দূরে থাকিনিম্ব। আনার এই 'আমরাম্বর মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে বর্ণ, ধর্ম, জাতি, নির্বিশেষে সকল মানুষের জীবন বোধ, মুক্ত জীবনের আর্তি, বিকশিত হওয়ার প্রেরণা, প্রেমার্থী তারুণ্যের কোমলতা, সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রাণ-স্পন্দন। মিয়েপ আনার দিনলিপি প্রকাশিত হওয়ার পরে বলেছিলেন, আনার কণ্ঠ এখন আর হারিয়ে যাবে না। বলেছেন, তার তরুণী বন্ধু সারা পৃথিবীর জন্য এক তাৎপর্যমূলক ঐতিহ্য রেখে গেছেন। আনা ফ্রাংকের জাদুঘর থেকে নিচে নেমে শহরের কোলাহলে আবারও হারিয়ে যাওয়ার আগে মনে হলো, ঐ ঐতিহ্য হলো সকল মানুষের বাঁচার আর্তির একাত্মতা, তারুণ্যের দিন বদলে দেয়ার আত্মিক অনুভূতি, প্রেমার্থী মানবতার বিকাশের অধিকার, এবং মানবিক মূল্যবোধের জয়। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সোনালী সময়ে, স্বৈরতান্ত্রিকতা প্রতিরোধ আন্দোলনের জনপথ কাঁপানো বছরগুলোতে আমাদের মুক্তির পথে চলা তারুণ্যকে যারা আশ্রয় দিয়েছিলেন, সন্দীপন করেছিলেন, তারা তো হাজারো মিয়েপ গাইজের ভূমিকায় স্নেহ ও মমতার শক্তি নিয়ে প্রোজ্জ্বল ছিলেন। ১৯৭১ সালে বেগম মুজিব, হাসিনা, রেহানা, ওয়াজেদ ও কামালদের বন্দীদশায় দেশের কথা, সাধারণ মানুষের সংগ্রামে লীন হওয়ার আর্তি, দখলদার পাক সেনাদের নির্যাতনের চিত্রগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য উপকরণ, মানবতার বিপর্যয় সত্ত্বেও স্বাধীনতার আর্তির খণ্ড খণ্ড প্রতীতি-জাগানিয়া ছবি। এসব ছবি অাঁকার, এদের কথা বলার, লেখার এবং অপরিমেয় অনুভূতিকে প্রাণে গাঁথার, তাদের ত্যাগ ও আর্তির তাৎপর্য সামনের প্রজন্মের জন্য তুলে ধরে রাখার এই তো সময়।
লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য

No comments

Powered by Blogger.