ঢাকা মহানগরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৯৫টি মোট শিক্ষার্থী: ছয় লাখ ৯১ হাজার ৯২৮ জন  বালক: তিন লাখ ২৭ হাজার ৬১০  বালিকা: তিন লাখ ৩৪ হাজার ৩১৮  শিক্ষক: প্রধান শিক্ষক ২৯৫ জন, সহকারী শিক্ষক দুই হাজার ৭২ জন- জৌলুশের ঢাকায় ‘গরিবের স্কুল’

রাজধানীর মিরপুরের সরকারি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় সেনপাড়া পর্বতা। আড়াইতলার বর্গাকৃতির ভবনটির সামনে একটি খেলার মাঠও রয়েছে। রয়েছে ১৯ জন প্রশিক্ষিত শিক্ষক। কিন্তু এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ওয়াহিদুজ্জামান মিয়া আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন ‘আমার এত ভালো অবকাঠামো, এত দক্ষ শিক্ষক থাকার পরেও ১১০০ শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। শিক্ষিত লোকজন তাঁদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাতেই চান না।’
সেনপাড়ার মতোই একই অবস্থা ঢাকা মহানগরের ২৯৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। প্রথম আলোর ছয়জন প্রতিবেদক দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানীর ১২টি প্রশাসনিক থানার অধীনে সব কটি স্কুল সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। এতে দেখা গেছে, পুরান ঢাকার কয়েকটি স্কুল বাদে রাজধানীর বেশির ভাগ বিদ্যালয়েই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও লেখাপড়ার পরিবেশ রয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও রাজধানীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে টানতে পারছে না। এমনকি সরকারি স্কুলের শিক্ষকেরাও তাঁদের সন্তানদের কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি স্কুলে পড়ান। ফলে বস্তিবাসী আর দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েরাই এই স্কুলের শিক্ষার্থী। তাই এই বিদ্যালয়গুলো পরিচিতি পাচ্ছে ‘গরিবের বিদ্যালয়’ হিসেবে।
ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ইন্দু ভূষণ দেব বলেন, ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাত লাখের কাছাকাছি শিক্ষার্থী রয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যথেষ্ট যোগ্য। বিনা বেতনে পড়াশোনা হয় বলে অভিভাবকদের কেউ কেউ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে গরিবের স্কুল মনে করেন। অভিভাবকদের মানসিকতায় বড়সড় পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো তুলনামূলক ভালো হলেও পুরান ঢাকাসহ বেশ কিছু এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে উঠেছে বস্তি, দোকান ও আবাসিক ভবন। ফলে শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া অধিকাংশ স্কুলেই শ্রেণীকক্ষ-সংকট রয়েছে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মান তুলনামূলক ভালো হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও ছুটিতে থাকায় অনেক স্কুলেই রয়েছে শিক্ষকসংকট। ফলে একেকজন শিক্ষককে দিনে তিন থেকে পাঁচটি ক্লাসও নিতে হয়। এর ফলে শ্রেণীকক্ষে তাঁদের মনোযোগের অভাব থাকে।
রাজধানীর সূত্রাপুর ও কোতোয়ালির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সবচেয়ে বেহাল।
সূত্রাপুর থানার অধীনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪৮টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। শিক্ষক ৩১৯ জন। এখানকার শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া বাকি স্কুলগুলোতে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাই লেখাপড়া করে। এই এলাকার অনেকগুলো স্কুলের ভবনের বেহাল অবস্থা। এর মধ্যে রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মূল ভবনটি জরাজীর্ণ। এর পাশে দুই কক্ষবিশিষ্ট পিডিবির একটি নতুন ভবনে একই সঙ্গে ক্লাস ও দাপ্তরিক কাজ চলে।
সূত্রাপুরের আটটি স্কুলের সমস্যা ভিন্ন রকম। এই আটটি স্কুলের জন্য ভবন রয়েছে চারটি। এর মধ্যে ঢালকানগর বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ঢালকানগর বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একই ভবনে স্থাপিত। একইভাবে বিপণি রায় বালক ও বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শফিউল্লাহ বালিকা ও ফরাশগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এক্রামপুর বালিকা ও বানিয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো একই ভবনে স্থাপিত। বিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব কোনো খেলার বা সুন্দর পরিবেশ নেই। নেই স্কুলের আলামত। এসব স্কুলে শিক্ষার্থী দেখা যায়নি।
শফিউল্লাহ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ঝর্না রানী চক্রবর্তী জানান, এখানকার বিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীই দরিদ্র পরিবারের। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করতে হয় তাদের।
কোতোয়ালি থানার অধীনে ৩১টি সরকারি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছয় হাজার। শিক্ষক ১৮৬ জন। এখানকার সব কটি স্কুলেরই প্রধান সংকট অপ্রশস্ত ভবন। একটি বা দুটি শ্রেণীকক্ষেই এখানে ক্লাস চলে। অনেক জায়গায় স্কুলের ভেতরেই কমিউনিটি সেন্টার।
লালবাগ থানার অধীনে মোট ৩৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২২ হাজার। চার শরও বেশি শিক্ষক আছেন এখানে।
প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার আশাবাদী। তিনি মনে করেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মান বাড়ছে। একসময় নিশ্চয়ই অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের সরকারি স্কুলে পাঠাবেন।
এ ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব আছে বলে মনে করেন বকশীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন শেখ। ‘সরকারি স্কুল নিয়ে সাধারণ মানুষের যে ভ্রান্ত ধারণা আছে, সেটি দূর করতে পারলে শিক্ষিত লোকজনও তাঁদের সন্তানদের সরকারি স্কুলে পাঠাবেন।’
মিরপুর থানার অধীনে ৩৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, শ্রেণীকক্ষের অভাবই এখানকার প্রধান সংকট। শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে ক্লাস করতে হয়। অনেক বিদ্যালয়ের ভবনগুলো পুরোনো হয়ে গেছে। কিছু বিদ্যালয়ের ভবন সংস্কার খুবই জরুরি।
মনিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানালেন, ছয় মাস আগে ট্রাকের ধাক্কায় বিদ্যালয়ের সুরক্ষা দেয়াল ভেঙে গেছে। কিন্তু সেটি আর ঠিক করা হয়নি।
মিরপুরের থানা শিক্ষা কর্মকর্তা ইসরাত নাসিমা হাবিব বললেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই বস্তিবাসী ও দরিদ্র পরিবারের সন্তান।
ক্যান্টনমেন্ট থানার অধীনে মোট ১২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে সাত হাজার। শিক্ষক ১৫৮ জন। এখানকার শিশুমঙ্গল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম জানান, গত সাত বছরে এই বিদ্যালয়ে নতুন কোনো বেঞ্চ দেওয়া হয়নি। আগের অনেকগুলো বেঞ্চ ভেঙে গেছে এবং নড়বড়ে। তাই নতুন বেঞ্চ খুবই জরুরি।
লালসরাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আফজাল হোসেন বলেন, বিদ্যালয়ের দুটি ভবনের মধ্যে একটিতে ভবন অনেক জীর্ণ। ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। পুরোনো ভবনটি সংস্কার না করলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
ক্যান্টনমেন্ট থানা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাঈদা ইরানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক অভিভাবক গরিব ও বস্তিবাসী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে চান না। অনেকে আবার ষষ্ঠ শ্রেণীতে গিয়ে স্কুল বদলাতে হবে, এই কারণে ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে এমন স্কুলে পাঠান, যেখানে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়তে পারবে।’
ডেমরা এলাকার ৪৫টি সরকারি স্কুল রয়েছে। এখানকার শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। জুরাইন বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে স্কুলটির উন্নত পরিবেশ দেখা গেল। প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান বললেন, ‘কিন্ডারগার্টেনে ভালো শিক্ষক নেই, পড়াশোনার মান ভালো নয়। তার পরও সরকারি স্কুলে না পাঠিয়ে শিক্ষিত পরিবারের লোকজন সেখানেই তাঁদের সন্তানদের নিয়ে যাচ্ছেন।’
মাদারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হাসিনা আক্তার জানান, মসজিদ ও বাজারসংলগ্ন বলে স্কুলটির সামনে ময়লা-আবর্জনা বেশি থাকে। এই এলাকার আহম্মদবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনেই একটি ডোবা। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। এলাকাবাসী জানালেন, বৃষ্টি হলেই স্কুলের মাঠে পানি জমে যায়।
গোড়ানের আইডিয়াল মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভেতরেই ওয়াসার একটি পাম্প। ফলে ছেলেমেয়েদের খেলার জায়গা নেই। মালিবাগ চৌধুরীপাড়া বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মালিবাগ চৌধুরীপাড়া বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস চলে একই ভবনে।
প্রতিবেদনগুলো তৈরির জন্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন মহিউদ্দিন ফারুক, মোছাব্বের হোসেন, আহমেদ জায়িফ ও মুসা আহমেদ।
ছবিগুলো তুলেছেন হাসান রাজা

No comments

Powered by Blogger.