সূচক বাড়ছে- * বিশ্ব মন্দা কেটে যাবার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে- * ব্যবসায়ীরা দারুণ উসাহিত- * খাতভিত্তিক সহযোগিতার সুফল পাওয়া যাচ্ছে by শাহ আলম খান

 বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা কেটে যেতে শুরম্ন করায় তার প্রভাব পড়তে শুরম্ন করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সব সূচকেরই আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হয়েছে বলে সরকার ও অর্থনৈতিক বিশেস্নষকরা দাবি করেছেন।
এ কারণে আশান্বিত হতে শুরম্ন করেছেন দেশের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরাও। অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে তাঁরাও নিচ্ছেন নানামুখী উদ্যোগ।
দেশীয় শিল্পের বিকাশ, বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠা, উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ, পণ্যের গুণগতমান বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণে ঐকমত্য, জাতীয় রফতানি বাণিজ্যের প্রসার ও আমদানি হ্রাস এবং শিল্পকারখানায় আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণসহ এ জাতীয় অর্থনৈতিক ইতিবাচক সূচকগুলোতে সম্প্রতি উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা দারম্নণ উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন।
এদিকে খাতভিত্তিক সরকারী সহায়তা ও কার্যকর নীতি গ্রহণের কথাও উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের আশ্বসত্ম করে তুলেছে। এর ফলে বৈশ্বিক মন্দাপরবতর্ী সমৃদ্ধি অর্জনে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে উদ্যোক্তারা। বর্তমানে দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ এবং ব্যবসা করার সুবর্ণ সময় বিবেচিত হওয়ায় তাঁদের এ উৎসাহের মাত্রা বহুগুণ বেড়েছে বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন।
এ লৰ্যে অর্থনৈতিক বিভিন্ন খাতে চলছে অগ্রগতি ও পুনর্গঠনমূলক কার্যক্রম। হচ্ছে সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম। আয়োজন করা হচ্ছে বিদেশী কারিগরি বিশেষজ্ঞের দ্বারা প্রশিৰণমূলক ব্যবস্থার। উপায় খোঁজা হচ্ছে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর। গভীর পর্যবেৰণে রাখা হচ্ছে বিশ্ববাণিজ্যের গতি-প্রকৃতির ওপর। এর সবকিছুর উদ্দেশ্যই হচ্ছে পরিবর্তনশীল বিশ্ববাণিজ্যের সঙ্গে দেশীয় বাণিজ্যের অসঙ্গতি কমিয়ে আনা।
এ ব্যাপারে দেশের অর্থনৈতিক বিশেস্নষকরা আগাম জানিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী মন্দার সুযোগ গ্রহণে বাংলাদেশী উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বিদেশী উদ্যোক্তারাও বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও রফতানিযোগ্য পণ্যসামগ্রী আমদানির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাই এ মুহূর্তে উদ্যোক্তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে গুণগতমান রৰা করে বিভিন্ন খাতের শিল্পকারখানার উৎপাদন বাড়ানো। ব্যবসায়ীদেরও উচিত বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, যেহেতু দেশে বর্তমানে খাদ্য ঘাটতি নেই। তাই রফতানি বাণিজ্যেরও ব্যাপক সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। তাই এখন কেবল উদ্যোগ গ্রহণই জরম্নরী। এৰেত্রে প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
সংশিস্নষ্ট সূত্র মতে, অর্থনৈতিক বিশেস্নষকদের এ আগাম ভবিষ্যদ্বাণীই উদ্যোক্তাদের সাহস যুগিয়েছে। শিল্পকারখানায় চলছে উৎপাদন বাড়ানোর প্রাণানত্মকর চেষ্টা। বৈশ্বিক বাজার ধরতে পণ্যের গুণগতমানও রৰার প্রতিযোগিতা শুরম্ন হয়েছে। মন্দাপরবতর্ী বাসত্মবতা অনত্মত তাই বলছে। এ লৰ্যে ইতোমধ্যে বহু শিল্পকারখানায় আধুনিক প্রযুক্তির মেশিনারিজ স্থাপনসহ কমপস্নায়েন্স সুযোগসুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পণ্যের প্রচার এবং প্রসারেও চলছে ব্যাপক তৎপরতা। হিড়িক পড়েছে খাতভিত্তিক আনত্মর্জাতিক মেলা আয়োজনের। প্রতিবছর খাতওয়ারী এ ধরনের আনত্মর্জাতিক মেলা অনুষ্ঠিত হলেও এ বছরের অনুষ্ঠিত বিভিন্ন মেলার গুরম্নত্ব সঙ্গত কারণেই দেশীয় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশী বায়ার ও আমদানিকারকদের মধ্যে অনেক বেশি বলে সংশিস্নষ্টরা মনে করছেন।
গত জানুয়ারি মাসেই অনুষ্ঠিত হয়েছে পাঁচটি আনত্মর্জাতিক মেলা। এর মধ্যে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে ১ জানুয়ারি থেকে শুরম্ন হয়েছে মাসব্যাপী আনত্মর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। এ মেলা শেষ হচ্ছে আজ রবিবার। ইতোমধ্যে রফতানি উন্নয়ন বু্যরো (ইপিবি) এবারের বাণিজ্যমেলা থেকে রেকর্ডসংখ্যক রফতানি অর্ডারের আশা করছে।
এরপরই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পমেলা, বস্ত্র ও প্রযুক্তিমেলা, গার্মেন্টস এবং আনত্মর্জাতিক পস্নাস্টিকমেলা। অনুষ্ঠিত হয়েছে আনত্মর্জাতিক টেক্সটাইল এ্যান্ড গার্মেন্টস যন্ত্রাংশ প্রদর্শনীরও। এর পূর্বে কৃষি কাঁচামালের প্রসার ও উৎপাদন বাড়ানোর লৰ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে কৃষি যন্ত্রপাতি মেলাও।
সংশিস্নষ্টরা জানান, প্রতিটি মেলাতেই রেকর্ডসংখ্যক বিদেশী উৎপাদক প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এসব মেলা পরিদর্শনে এসে বিদেশী বায়ার ও আমদানিকারকরা দেশীয় পণ্য ও সরঞ্জাম সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছেন। এসব প্রদর্শনীতে উৎসাহিত হয়ে দেশীয় উদ্যোক্তারা যেমন উন্নত বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটাতে মরিয়া রয়েছেন, তেমনি বিদেশী উদ্যোক্তারাও বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহী হচ্ছেন। সংশিস্নষ্টরা মনে করছেন নিঃসন্দেহে অচিরেই অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে শুরম্ন করবে।
অন্যদিকে রফতানির প্রসার, ব্যবসায় গতি ও খাতভিত্তিক উৎপাদন বাড়ানোকে উৎসাহিত করতে বাড়ানো হয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের কার্যনির্বাহী সদস্য সংখ্যাও। ইতোমধ্যে শিল্প ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে চেম্বার অব কমার্সের কার্যক্রম শুরম্ন হয়েছে। এফবিসিসিআই ব্যবসায়ী নেতারাও বিভিন্ন দেশের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দ্বিপাৰিক ও বহুপাৰিক আলোচনায় বসছেন। তাঁরা বিদেশী উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশের অবকাঠামো, প্রকৌশল ও প্রযুৃক্তি, ব্যাংকিং ও ইন্সু্যরেন্স, শিৰা ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং পর্যটন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে বস্ত্র, সুতা, পিভিসি পাইপ ও পস্নাস্টিকসামগ্রী, ওষুধ, তৈরি পোশাক, চিংড়ি ও চামড়াজাত দ্রব্য আমদানির অনুরোধ করছেন।
উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা জানান, বিশ্বমন্দায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের রফতানির পরিমাণ কমেছে। তবে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। প্রায় সব খাতেই নতুন শিল্পায়ন এবং বিদ্যমান শিল্পকারখানাগুলোতেও প্রসার ঘটানো হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের।
এফবিসিসিআই সভাপতি আনিসুল হক এ ব্যাপারে বলেন, শিল্পায়ন হলে কর্মসংস্থান বাড়ে; অর্থনীতি বড় হয়। কিন্তু দেশে মৌলভিত্তির পর্যাপ্ত শিল্পায়ন, শিল্পের অবকঠামোগত উন্নয়ন এবং আনুষঙ্গিক সুযোগসুবিধার সম্প্রসারণ না হওয়ায় কাঙ্ৰিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে না। এৰেত্রে উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের নানামুখী প্রচেষ্টার সঙ্গে সরকারের সামান্যতম সহায়তা যোগ হলে অচিরেই ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
বিজিএমএইর সিনিয়র সহ-সভাপতি ফারম্নক হাসান বলেন, মন্দায় তৈরি পোশাক শিল্পের রফতানি আয় কমে যাওয়ায় আমাদের চোখ খুলে গেছে। ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারছেন যে, পণ্যের ও বাজার বহুমুখীকরণের কোন বিকল্প নেই। আর এজন্য উন্নত প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা চলছে।
বিকেএমইএ'র সিনিয়র সহ-সভাপতি এমএ বাছেদ জানান, পণ্যের গুণগতমান বজায় রাখতে না পারলে আনত্মর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। আর গুণগত মানের জন্যই দরকার আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার।
ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প সমিতির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, শিল্পোদ্যোক্তারা টাকা নিয়ে বিনিয়োগের জন্য বসে আছেন। কিন্তু দরকার বিনিয়োগের সার্বিক অনুকূল পরিবেশ। এৰেত্রে সরকার দেশে যত বেশি শিল্পবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে শিল্পের বিকাশ ও উৎপাদন ততই বাড়বে। যা রফতানি খাতকেই সমৃদ্ধ করে তুলবে।
তবে বাংলাদেশ টেক্সটাইলস মিলস এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি আব্দুল হাই জানালেন ভিন্ন কথা। তাঁর মতে, কাঙ্ৰিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে দরকার কার্যকর নীতিনির্ধারণী সিদ্ধানত্ম গ্রহণের। বর্তমান সরকারও সেই শিল্পবান্ধব নীতিতেই পথ চলার চেষ্টা করছেন। অবশ্য তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, কাঙ্ৰিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সরকার ও উদ্যোক্তাদের যৌথ প্রচেষ্টার সবই বিফলে যাবে যদি না শিল্পকারখানায় গ্যাস ও বিদু্যতের সঙ্কট শীঘ্রই দূরীভূত হয়।
বিশ্ববাণিজ্যের সম্পর্কোন্নয়ন ও অভ্যনত্মরীণ উৎপাদন বাড়ানোর ব্যাপারে এ সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি অনন্য দৃষ্টানত্ম বলেই দাবি করছেন উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা।
তাঁরা জানান, এর পূর্বে দেশীয় উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ ধরনের আশাব্যঞ্জক তৎপরতা কখনই চোখে পড়েনি। কিন্তু বিশ্বমন্দার পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ এবং গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশই তাদের এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে। বছরের শুরম্ন থেকেই তাঁদের এ সাহসী তৎপরতার সুফল অচিরেই জাতীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলবে। এ ব্যাপারে উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা গৃহীত এসব কার্যকর উদ্যোগ ধরে রাখতে সরকারী সমর্থন ও সহায়তা অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.