হারিছ চৌধুরী এখন কোথায়?- আত্মগোপনের ৬ বছর পরও খোঁজ নেই ॥ গৌছ উদ্দীনের পথে হাঁটছেন? by শরীফুল ইসলাম

এক সময়ের দুর্দর্শ প্রতাপশালী বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী লাপাত্তা হয়েছেন ৬ বছর আগে। এরই মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে ৫টি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে তাঁর অতীত কর্মকা- নিয়ে ব্যাপকভাবে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। সবার মনে একই প্রশ্ন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী এখন কোথায়? বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ওয়ান-ইলেভেনের পরই হারিছ চৌধুরী যৌথবাহিনীর হাতে গ্রেফতার এড়াতে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। তবে হারিছ চৌধুরীর বিদেশে অবস্থান নিয়েও রয়েছে নানা গুজব। কেউ বলেন তিনি ভারতের করিমগঞ্জে মামার বাড়িতে আছেন, কেউ বলেন লন্ডনে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে আছেন, আবার কেউ বলেন গ্রেফতার এড়াতে আত্মীয়-পরিজনের কাছে না থেকে তিনি অন্য কোথাও আছেন। হারিছ চৌধুরী এখন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা বা যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশের কোন একটিতে আছেন বলেও গুজব রয়েছে। আবার কেউ বলছেন ছদ্মনামের পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি কিছুদিন পর পর এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যান।
এদিকে দীর্ঘ ৬ বছর হারিছ চৌধুরীর হদিস না পেয়ে অনেকেই অনেক রকম মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ এমনও বলছেন দু’দশক ধরে ফাঁসির দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে থাকা জাতীয় পার্টির টিকেটে নির্বাচিত সিলেট-৬ আসনের সাবেক এমপি গৌছ উদ্দীনের পরিণতি কী বরণ করতে যাচ্ছেন এক সময়ের প্রভাবশালী বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী? আর কি দেশে ফিরবেন না তিনি?
জানা যায়, সিলেটের জাতীয় পার্টি নেতা গৌছ উদ্দীন এমপি থাকাবস্থায় ১৯৯০ সালে সিলেট নগরীর একটি আবাসিক হোটেলে নিজের পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন তাঁরই এক ব্যবসায়ী বন্ধুকে। এরপরই তিনি পালিয়ে যান ভারতে। এ হত্যা মামলায় গৌছ উদ্দীনকে ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত। আত্মগোপনের পর গত ২২ বছরেও খোঁজ মেলেনি গৌছ উদ্দীনের। তবে গৌছ উদ্দীন বর্তমানে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভিন্ন পরিচয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন বলে কেউ কেউ বলছেন।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় পাঁচ বছর দলের যুগ্ম মহাসচিব হারিছ চৌধুরী ছিলেন দেশের একজন দুর্দ- প্রতাপশালী ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হওয়ায় সে সময় তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও হাওয়া ভবনের কানেকটিং লিঙ্ক হিসেবে কাজ করতেন। তাই মন্ত্রী, এমপি ও আমলা থেকে শুরু করে সুবিধালোভী সর্বস্তরের মানুষ হারিছ চৌধুরীকে সমীহ করে চলতেন। এ সুযোগে তিনি অর্থের পাহাড় গড়ে তোলেন।
ওয়ান ইলেভেন আসার পর হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যান হারিছ ছৌধুরী। যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার এড়াতে ঢাকার গুলশানের আলিশান বাড়িসহ ১৮টি বাড়ি, কয়েকটি দামি গাড়ি, শখের হরিণসহ বিভিন্ন প্রজাতির বণ্য প্রাণী, বিষয়-সম্পত্তি সবকিছু ফেলে পালিয়ে যান তিনি। ছয় বছর পার হলেও তার কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপির কোন পর্যায়ের নেতাকর্মীই তাঁর খবর বলতে পারেন না। অথবা জানলেও বলতে চাচ্ছেন না। ক্ষমতায় থাকতে নানা রকমের তদ্বির করতে যাঁরা তাঁর পেছনে ঘুরঘুর করতেন দলের সেইসব নেতাকর্মী এখন হারিছ চৌধুরীর কথা শুনলে বিরক্ত হন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরী অবস্থা জারির পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যেসব নেতা আত্মগোপনে চলে যান তাঁদের অনেকেই পরে রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী।
হারিছ চৌধুরীর পৈত্রিক বাড়ি সিলেটের কানাইঘাটে। এ এলাকাটি ভারত সীমান্তে। তাই কেউ কেউ বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের পর তিনি মামারবাড়ি ভারতের করিমগঞ্জে চলে যান এবং এখনও সেখানেই আছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন হারিছ চৌধুরী বর্তমানে সপরিবারে লন্ডনে রয়েছেন। লন্ডনে চিকিৎসাধীন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ আছে। সময়মতো তিনি ঠিকই দেশে ফিরে আসবেন।
জানা যায়, হারিছ চৌধুরীর স্ত্রী জ্যোৎস্না আরা চৌধুরী ১৯৯৯ সাল থেকেই লন্ডনে বসবাস শুরু করেন। ছেলে নাঈম চৌধুরী জনিকে স্টুডেন্ট ভিসায় লন্ডনে ভর্তি করার পর তাঁর লেখাপড়া তদারকির জন্য লন্ডনে অবস্থান নেন তিনি। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় এলে হারিছ চৌধুরী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হিসেবে নিয়োগ পেলে দেশে নিয়মিত বসবাস করলেও মাঝে মধ্যে লন্ডনে যাতায়াত ছিল তাঁর। বর্তমানে বার এ্যাট ল’ সম্পন্ন করে ছেলে নাঈম চৌধুরী জনি নরওয়ে ভিত্তিক একটি তেল কোম্পানির লন্ডন অফিসে দায়িত্ব পালন করছেন। মেয়ে সামিরা তানজিম বাংলাদেশে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় বার এ্যাট ল’ সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনিও লন্ডনে অবস্থান করছেন। যুক্তরাজ্যে বিলাসবহুল একটি বাড়িরও মালিক হারিছের পরিবার। সূত্র জানিয়েছে, হারিছ চৌধুরীর স্থাবর সম্পত্তির বেশিরভাগই তাঁর ছেলেমেয়ের নামে।
হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ মোট ৫টি মামলা রয়েছে। দুদকে সম্পত্তির হিসাব না দেয়ার মামলায় ২০০৭ সালের ২২ মে তিন বছরের বিনাশ্রম কারাদ- দেন বিশেষ জজ আদালত। এটাই ছিল হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রথম রায়। ন্যাশনাল টি কোম্পানির গাড়ি জালিয়াতির মামলায় ২০০৭ সালের ৪ নবেম্বর ৫৯ বছর বিনাশ্রম কারাদ- এবং ২২ লাখ টাকা জরিমানা করেন ঢাকা মহানগর সিনিয়র বিশেষ জজ আদালত। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে দায়ের করা দুটি মামলার মধ্যে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সিলেটের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আদালত তাঁকে ৬ মাসের কারাদ- দেন।
২০১১ সালের ৯ আগস্ট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার পাশাপাশি হারিছ ছৌধুরীকে দ্বিতীয় আসামি করা হয়। গত মঙ্গলবার ওই মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালত চার্জশীট গ্রহণ করে। আর তাঁর সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় হারিছ চৌধুরী ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে সিলেটের জকিগঞ্জে একটি বেসরকারী কলেজে শিক্ষকতাও করেছেন কিছুদিন। এক সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাই শেখ কামালের হাত ধরে যুবলীগের রাজনীতিতেও সম্পৃক্ত হন তিনি। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যোগ দেন জাগদলে। পরে সিলেট জেলা বিএনপির প্রথম কমিটির সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় যুবদলের সহ-সভাপতিসহ বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম কানাইঘাট-জকিগঞ্জ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন তিনি। ৯১ সালেও বিএনপির প্রার্থী হিসেবে পরাজিত হন। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের পর দলের নতুন কমিটি গঠন করা হলে হারিছ চৌধুরীকে কোন পদেই রাখা হয়নি। তবে একটি সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ঘোষিত বিএনপির ৩৮৬ সদস্যের নির্বাহী কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যানের ১টি পদ শূন্য রাখা হয়। হারিছ ছৌধুরী দেশে ফিরে এলে তাঁকে এ পদটি দেয়া হতো।
জানা যায়, এক-এগারোর পর হারিছ চৌধুরী প্রথমে ভারতের করিমগঞ্জে মামা বাড়িতেই ছিলেন। করিমগঞ্জ সিলেটের জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট সীমান্তে কুশিয়ারা নদীর ওপারে অবস্থিত। করিমগঞ্জ শহরের মামাবাড়ি থেকে সীমান্ত পথে হারিছ চৌধুরীর কানাইঘাটের বাড়ির দূরত্ব মাত্র কয়েক কিলোমিটার। পরে ভারত থেকে ব্যাঙ্কক ও সিঙ্গাপুর হয়ে তিনি লন্ডনে চলে যান। গত ৬ বছরে তিনি মাঝে মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায়ও গিয়েছেন। তবে কোন সূত্রই নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি কোথায় আছেন?
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, হারিছ চৌধুরী কোথায় আছেন জানি না। বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই তাঁকে আর দেখছি না। তবে কেউ বলছে ভারতের করিমগঞ্জের মামাবাড়িতে আছেন, আবার কেউ বলছে আসামে আছেন আবার লন্ডনে আছেন বলেও কেউ কেউ বলছে। তবে সুনির্দিষ্ট কোন জায়গায় থেকে থাকলে এতদিন খবর হয়ে যেত এবং বিএনপির সিনিয়র নেতা হিসেবে আমরাও জানতাম।

No comments

Powered by Blogger.