বাম দলের হরতালে জলকামান ও মরিচ গুঁড়োর ব্যবহার- অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত ॥ প্রতিবাদে আজ বিক্ষোভ সমাবেশ

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির তৎপরতা বন্ধে দুই বাম জোটের ডাকা অর্ধদিবস হরতাল সারাদেশে ঢিলেঢালাভাবে পালিত হয়েছে। দেশের কোথাও বড় ধরনের কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
নিরুত্তাপ হরতালে উত্তপ্ত ছিল জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে পুরানা পল্টন এলাকা। এখানে হারতাল আহ্বানকারী দল সিপিবি-বাসদ ও বামমোর্চার মিছিলে দফায় দফায় হামলা, মরিচের গুঁড়া মিশ্রিত পিপার স্প্রে, জলকামানের রঙিন পানি, টিয়ারশেল নিক্ষেপসহ লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। ঢাকাসহ সারাদেশে আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। কর্মরত সাংবাদিকরাও রেহাই পাননি পুলিশের মরিচের গুঁড়ো নিক্ষেপ থেকে। শান্তিপূর্ণ হরতাল কর্মসূচীতে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে আজ বিকেলে সারাদেশে প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচীর ডাক দিয়েছে সিপিবি-বাসদ জোট। ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে জাতীয় মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন জোটের নেতৃবৃন্দ।
এদিকে হরতাল সফল দাবি করেছেন দুই বাম জোটের নেতৃবৃন্দ। নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশি হমলার প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করেছেন তাঁরা। আন্দোলন দমনে পুলিশের নতুন হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত পিপার স্প্রে বন্ধের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। হরতাল ব্যর্থ দাবি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, হরতাল করার জন্য বাম দলগুলোর নৈতিক ভিত্তি নেই। এছাড়া পিপার স্প্রে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয় বলেও দাবি করেন তিনি। হরতাল চলাকালে রাজধানী থেকে দূরপাল্লার কোন পরিবহন ছেড়ে যায়নি। ট্রেন ও লঞ্চ চলাচল ছিল স্বাভাবিক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। বেশিরভাগ দোকানপাট ছিল খোলা। প্রাইভেটকার ছাড়া অন্যান্য পরিবহন চলাচল ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক। নিরুত্তাপ হরতাল উত্তাপ ছড়ায় অতি উৎসাহী পুলিশের মারমুখী আচরণের কারণে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহার, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা বন্ধের প্রতিবাদসহ ১৫ দফা দাবিতে হরতাল আহ্বান করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। এতে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, বাম দলের অঙ্গ সংগঠনগুলো নৈতিক সমর্থন জানায়। সর্বশেষ মঙ্গলবার রাতে হরতালে সমর্থন জানায় বিরোধী দল বিএনপি। যদিও বিএনপির সমর্থন নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন বাম নেতারা।
হরতালের সমর্থনে ভোর ৬টায় মিছিল নিয়ে তোপখানা রোডের রাস্তায় নামে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। বাম দলের নেতাকর্মীরা বাসসহ বিভিন্ন গণপরিবহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে এবং পরিবহন ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় বামমোর্চার মিছিলে পিপার স্প্রে ছোড়ে পুলিশ। এরপর ওই এলাকায় বাম মোর্চার পাশাপাশি সিপিবি ও বাসদ মিছিল করার চেষ্টা করলে স্প্রে ছাড়াও জলকামান ছোড়া হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। উভয়পক্ষের মধ্যে দেখা দেয় উত্তেজনা। পিকেটাররা গাড়ি ভাংচুরের চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠিচার্জসহ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত হরতালকারীদের মিছিলসহ সমাবেশে দফায় দফায় পুলিশি হামলা ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
সকালে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে বাম মোর্চার নেতাকর্মীদের তোপখানা রোডের অফিসের গলিতে গিয়ে মিছিল করতে দেখা যায়। এ সময় পুলিশ গলির মুখে অবস্থান নেয়। এদিকে সিপিবি কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে কমিউনিস্ট পার্টি ও বাসদ নেতাকর্মীরা। সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তাদের ঘিরে রাখে পুলিশ। মিছিল সমাবেশ করতে না দেয়ায় পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীদের কয়েক দফা বাগ্বিত-া হয়। হরতালকে কেন্দ্র করে রাজধানীজুড়েই ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক নজরদারি। ভোর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল পরিমাণ সদস্য মোতায়েন করা হয় প্রেসক্লাব থেকে দৈনিক বাংলা মোড় পর্যন্ত। আনা হয় জলকামান, প্রিজন ভ্যানসহ নানা সরঞ্জাম।
বুধবারের হরতালে নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের জলকামান ও পিপার স্প্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে দেখা গেছে। বাসদের সাধারণ সম্পাদক কমিউনিস্ট নেতা খালেকুজ্জামানের গায়ে কয়েক দফা স্প্রে করেছে পুলিশ। পুলিশি হামলায় তিনিসহ বাম মোর্চার সাইফুল হক ও মোশরেফা মিশু, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সংবাদকর্মীসহ কয়েকজন আহত হন। সাদা পোশাকে পুলিশ পল্টন এলাকার বিভিন্ন অলি গলিতে অবস্থান নেয়। কাউকে সন্দেহ হলেই গায়ে পিপার স্প্রে করতে দেখা যায়। গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার অফিসে সাদা পোশাকের পুলিশ ঢুকে পিপারে স্প্রে করেছে।
সকাল সাড়ে ১০টার পর পুলিশ পাহারায় মিছিল বের করে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। সাড়ে ১১টায় মুক্তি ভবনের সামনে সিপিবি-বাসদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হঠাৎ করেই হামলা করে পুলিশ। এ নিয়ে দেখা দেয় তীব্র উত্তেজনা। টিয়ারশেল, জলকামানের মুখে দলীয় কর্মীরা লাঠি ছুড়তে থাকে পুলিশের দিকে। এক পর্যায়ে সিপিবি সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ পুলিশের সামনে এসে বলেন আমাকে গ্রেফতার করুন। থানায় নিয়ে যান। তবুও আমার নিরপরাধ নেতাকর্মীদের মারবেন না। আমরা কোন অন্যায় করিনি। কার নির্দেশে আপনারা বার বার আমাদের ওপর হামলা করছেন। হামলার প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবে সিপিবি-বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা প্রতিবাদ সমাবেশ করে। পিপার স্প্রের ঝাঁজ থেকে মুক্তি পেতে দলীয় নেতাকর্মীসহ সাংবাদিকদের আগুনে তাপ নিতে দেখা যায়।
১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় মহাসমাবেশ ॥ হরতাল শেষে চলমান আন্দোলনের নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করেছে দুই বাম রাজনৈতিক জোট। শান্তিপূর্ণ হরতাল কর্মসূচীতে পুলিশি হামলাসহ দাবি দাওয়া বাস্তবায়নে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) আজ সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করবে। কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানীতে আজ বিকেল চারটায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আছে। এছাড়া ১৫ দফা বাস্তবায়নসহ জোট-মহাজোটের বাইরে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প রাজনৈতিক বলয় গড়ে তুলতে ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে জাতীয় মহাসমাবেশ করবে সিপিবি-বাসদ। এর আগে ৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের স্পীকারের কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হবে। ওই দিন জাতীয় প্রেসক্লাবে সমাবেশ শেষে জাতীয় সংসদ অভিমুখে পদযাত্রা করে স্পীকারের কাছে স্মারকলিপি দেয়া হবে। ২৮ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্মারকলিপি দেয়া হবে সারাদেশের সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে। বিভিন্ন কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠনের সমন্বয়ে এ স্মারকলিপি পেশ করা হবে।
পিপার স্প্রে নিষিদ্ধের দাবি ॥ মরিচের গুঁড়া মিশ্রিত ‘পিপার স্প্রে’ নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সাংবাদিকরা। সম্প্রতি রাজপথে বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্যে বুধবারের দুই বাম জোটের হরতাল কর্মসূচীতে সবচেয়ে বেশি পিপার স্প্রে ব্যবহার করেছে পুলিশ। কারণে-অকারণে এই স্প্রে ব্যবহার করতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। হরতালের সমর্থনে মিছিল সমাবেশ থেকে শুরু করে কাউকে পিকেটার বলে সন্দেহ হলেই পিঠে অথবা মুখে সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যদের এই স্প্রে ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.