মাননীয় সম্পাদক সমীপে

মাকসুদুল আলম: সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে কে কবে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে আসবে তার কোন লক্ষণ আপাতত নেই।
সামরিক কোন শত্রু না থাকা সত্তেও দেশের সামরিক নিরাপত্তা জোরদারের অজুহাতে ক্ষমতার শেষ বছরে এসে ক্ষমতাসীন সরকার যখন চড়া সুদে ঋণের টাকায় রাশিয়া থেকে এক বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সমরাস্ত্র কিনছে, তখন রাজধানী ঢাকার পুরানা পল্টন মোড়ে, অলিতে গলিতে আন্দোলনকারী শিক্ষক ও সাধারণ আমজনতার ওপর মরিচের গুঁড়া স্প্রে করছে দেশটির আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ। ময়লা আবর্জনা বহনকারী গাড়িতে ঢিল মারা মামলাসহ হুকুমের আসামি দেখিয়ে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে ৩৭টি মামলায় জড়ানো হলেও, জনস্বার্থে বল প্রয়োগের নামে পূর্ব কোন রোগ ছাড়া মরিচের গুঁড়া স্প্রেতে কোন ব্যক্তির মৃত্যুর আশঙ্কা নেই বলে দম্ভ করছেন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের হুকুমদাতা স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দেশটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের অন্যতম বন্ধুপ্রতিম আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংকের সহজ ঋণচুক্তিতে প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুকে গেল বছরে আস্ত গিলে ফেলা হয়েছে। শতকোটি ডলারের সামরিক সহযোগিতা চুক্তির নামে এবার চোখ পড়েছে সেই সর্বনাশা পদ্মা নদীর পাড়ের ধু ধু বালুচর রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার গোপন চুক্তিতে এবার যে তা সহজেই হজম হয়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? লাগামহীন আজব আমাদের এই দেশ। সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও টকশো ব্যক্তিত্ব এবিএম মূসা বিচিত্র এই দেশটির একজন প্রবীণ কলামিস্ট। সম্প্রতি প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেনের স্মরণসভায় জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি অভিযোগ করেছেন যে, আমাদের দেশের সাংবাদিকদের কেউ কেউ রাজনৈতিক মদদপুষ্ট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্বয়ং এই সাংবাদিকরাই। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের ওপর জেল-জুলুম ও নির্যাতন চালানো হলেও, নিজেদের মাঝে কোনা ঐক্য না থাকায় আজ তারা নৈতিক অধিকার নিয়ে কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছেন। স্মরণসভায় তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, তার সময়কালীন সাংবাদিকদের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ ছিল না। রাজনৈতিক ভেদাভেদ থাকায় এখন সাংবাদিকদের নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে হয়। সাগর-রুনির খুনের বিচার দাবিই তার বড় প্রমাণ। জনাব এবিএম মূসা খাস কথা বলেছেন। কোন বিতর্ক ছাড়াই আমি তার সঙ্গে পুরো একমত। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের চমৎকার একটি লেখা পড়লাম। তার লেখাতে জানতে পারলাম, সম্প্রতি তিনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই’র সংবাদ বিশ্লেষণধর্মী একটা টকশোতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইতিমধ্যে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদককে হয়রানি ও তার বিরুদ্ধে মামলা করা থেকে বিরত থাকতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে একথা আমাদের সবারই জানা। তারপরও এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন। অবরুদ্ধ সম্পাদকের প্রতি সহানুভূতি জানাতে এগিয়ে আসেননি দেশটির অন্য সব পত্রপত্রিকার দায়িত্বশীল সম্পাদকরাও। তাই ড. আসিফ নজরুল একজন সম্পাদক হিসেবে মতিউর রহমান চৌধুরীকে প্রশ্ন করেছিলেন কেন তারা আমার দেশ পত্রিকার অবরুদ্ধ সম্পাদক প্রসঙ্গে সামান্য একটা বিবৃতিও দিতে সক্ষম হলেন না। উত্তরে মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী নাকি সেদিন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন যে, ‘হীনমন্যতার কারণেই সম্পাদকরা এ কাজটি করছেন না’। আমার আজকের লেখার বিষয় মাননীয় সম্পাদকদের এই হীনমন্যতা। মূলত জাতি হিসেবে আমরা খুবই পরশ্রীকাতর। কেউ কোন পেশায় বা কাজে সুনাম অর্জন করে ফেলবে, এটা আমরা সহজেই মেনে নিতে পারি না। গুণীদের কদর দিতে জানি না আমরা। অন্যের ভাল আমাদের সহ্য হয় না। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক পেশাদার সাংবাদিক না হয়ে ভিন্ন কোন পেশা থেকে আসতে পারেন, তাতে কোন সমস্যা আছে আমার জানা নেই। তার সম্পাদিত পত্রিকা সত্য প্রকাশ করে নাকি মিথ্যা লিখে সেটিই হচ্ছে আসল ব্যাপার। নির্ভয়ে সত্য প্রকাশ করলে আজ না হোক একদিন না একদিন হলেও তা পাঠক জনপ্রিয়তা পাবেই। আর মিথ্যা লিখলে পাঠকই সেটি আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেবে, একদিন তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এতে কোন সন্দেহ নেই।

পাঠকের নিশ্চয় জানা আছে যে, মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রবাসী এক আইনজীবীর অনলাইন কথোপকথন বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর তা নিজ পত্রিকায় প্রকাশ করায়, বিচারকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা হয়। সেই মামলায় হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ উভয়পক্ষের আইনজীবীর দীর্ঘ শুনানি ও যুক্তিতর্ক শেষে বিষয়টি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিধায় কোন সিদ্ধান্ত না দিয়ে, আবেদনটি ফেরত দিয়ে দেয়। আমাদের দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। পৃথিবীর কোথাও এমন ঘটনা ঘটেছে বলেও জানা নেই। প্রসঙ্গক্রমে আওয়ামী লীগ সরকারের আগের আমলের দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে করা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাটি স্মরণ করা যেতে পারে। সরকারের অনুগত পুলিশ বাহিনী সেদিনও সুপ্রিমকোর্ট এলাকা ঘেরাও করে রেখেছিল। উভয়পক্ষের আইনজীবীর যুক্তিতর্ক ও শুনানি শেষে গভীর রাতে উচ্চ আদালতের সঠিক সিদ্ধান্তে সেদিন সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক ও প্রকাশক। সেই দিন কি আর আছে? ২০০০ সাল আর ২০১৩ সালও এক নয়। দেশে এখন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করতে সাধারণ আমজনতার ওপর এখন শুকনা মরিচের গুঁড়া স্প্রে করা হয়। ন্যায় বিচার চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদনকারী পত্রিকাটির সম্পাদককে এখন নিজ অফিসেই দিন-রাত কাটাতে হয়। পড়ন্ত বেলায় সাংবাদিকতার জগতে আসায় তাকে এখন বেশি করে সময় দিতে হয়। আর যাই হোক, অফিসের বাইরে বের হয়ে ইলিয়াস আলীর মতো ভাগ্য বরণ করতে চান না আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকের অনলাইন কথোপকথন ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগটি আদালতে বিচারাধীন। তাই এ নিয়ে মন্তব্য করা অন্য সব পত্রিকার দায়িত্বশীল সম্পাদকদের কাজ নয়। তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু মূলধারার একজন সম্পাদক উচ্চ আদালতে ন্যায় বিচার চেয়ে আবেদন করেও আইনের আশ্রয় পাবেন না, এটা কি করে মেনে নেয় অন্য সব পত্রিকার সম্পাদকরা? তাদের কাজ তো রাজনৈতিক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে থেকে অন্যায় ও অবিচারের প্রতিবাদ করা। তাদের এই সংকীর্ণতা কি পরোক্ষভাবে এমন অবিচারকে উস্কে দিচ্ছে না? মাননীয় সম্পাদকরা কেন এই অবিচারের প্রতিবাদ করছেন না? আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদকের মতো অবরুদ্ধ জীবন একদিন হয়তো তাদেরকেও বরণ করতে হতে পারে। তখন কি হবে?
লেখক: মাকসুদুল আলম (জাপান প্রবাসী কলাম লেখক)
১৭ই জানুয়ারি ২০১৩, টোকিও

No comments

Powered by Blogger.