উদার গণতান্ত্রিক সরকার ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা- স্বদেশ রায়

বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এই কলামে অনেকবার লিখেছি, একটি উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে অন্তত কয়েক টার্মের জন্য ধারাবাহিক ক্ষমতায় থাকা প্রয়োজন।
কারণ, অনুদার বা রক্ষণশীল গণতান্ত্রিক দল ক্ষমতায় থাকলে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য উন্নয়ন কম হয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয়। এটা সারাবিশ্বে প্রমাণিত। বাংলাদেশে দরিদ্র ও সাধারাণ মানুষের সংখ্যা বেশি। এখানে উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তের সংখ্যা কম। তাই বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সব সময়ই একটি উদার গণতান্ত্রিক দল বেশি উপযোগী। যেমন বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা অনান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি তেমনি এখানে দরিদ্রের সংখ্যাও বেশি। এ ধরনের দেশে যদি নিজে থেকে খাদ্য উৎপাদন না করা যায় তাহলে একটি নীরব দুর্ভিক্ষ সব সময়ই চলবে। কারণ, গোটা পৃথিবীতে ক্রমাগত খাদ্যের দাম বাড়ছে। এবং এটা আরও বাড়বে। যেহেতু সবখানে মানুষের আয় বাড়ছে। মানুষ আগের থেকে বেশি খাবার খেতে সমর্থ হচ্ছে। তাই এ অবস্থায় বাংলাদেশের মতো একটি জনসংখ্যার দেশের পক্ষে খাদ্য আমদানি করে দেশের মানুষের খাবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। প্রথমত অত খাদ্য সময়মতো আমদানি করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত আমদানি করা খাদ্যের দাম যা দাঁড়াবে তাতে সাধারণ মানুষ কিনতে পারবে না।
দেশের মানুষ দেখেছে বিগত ২০০১ থেকে ২০০৬ অবধি ও ২০০৭ ও ২০০৮ জামায়াত-বিএনপি জোটের মতো অনুদার গণতান্ত্রিক দল ও তত্ত্বাবধায়ক আমলে জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিরা ক্ষমতায় ছিল। তারা কেউই ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফের অর্থনৈতিক নীতির অনেকখানি অস্বীকার করে দেশে কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে অধিক খাদ্য উৎপাদনের দিকে যায়নি। বরং ওই সময়ে বিএনপির দ্বিতীয় ব্যক্তি বলে পরিচিত সাইফুর রহমান বলেছিলেন, খাদ্য উৎপাদনের থেকে খাদ্য আমদানি লাভজনক। তাদের এই রক্ষণশীল ও ভুল অর্থনীতি অর্থাৎ কৃষিতে নানান পথে ভর্তুকি না দেয়া নীতি গ্রহণ করার ফলে জামায়াত-বিএনপি আমলে দেশ দ্রুত খাদ্যাভাবে পড়ে। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। যার রেশ আরও বড় হয়ে দেখা দেয় তত্ত্বাবধায়ক আমলে। দেশের মানুষের নিশ্চয়ই মনে আছে, জামায়াত-বিএনপি আমলে দেশের নিচু তলায় এক ধরনের নীরব দুর্ভিক্ষ ছিল। সে সময়ে সন্তানকে খেতে দিতে না পেরে সন্তানকে বিষ খাইয়ে মায়ের আত্মহত্যা, পরিবারের জন্য খাবার যোগাড় করতে না পেরে পরিবারপ্রধান আত্মহত্যা করেছে, অনেক প্রবীণ ব্যক্তি না খেয়ে মারা গেছে এ সব সংবাদ পত্র-পত্রিকায় কম বেশি ছাপা হয়েছে।
অনুদার গণতন্ত্রে আরো একটি বিষয় বড় হয়ে দেখা দেয় যে, এই সব ঘটনা খুব বেশি সামনে আসে না। আসতে পারে না। কারণ অনুদার গণতন্ত্রে মিডিয়া ওইভাবে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। জামায়াত-বিএনপি আমলে মিডিয়ার অবস্থা কী হয়েছিল তা হয়ত এখন অনেকে ভুলে গেছেন। আজ একুশে টিভির অবস্থান যেখানে হোক না কেন, জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় এসে এই টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়। জনকণ্ঠ পত্রিকার সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়। বেসরকারী প্রতিষ্ঠান যারা বিজ্ঞাপন দিত তাদের হুমকি দেয়া হয়, যাতে বিজ্ঞাপন না দেয়। এছাড়াও অনেক নির্যাতন চলে জনকণ্ঠের ওপরে। অন্যদিকে অন্যান্য মিডিয়া আজ যা লিখতে পারে বা বলতে পারে সেদিন সেটা সম্ভব ছিল না। রক্ষণশীলরা মিডিয়ার মুখ বন্ধ করে তারা মনে করে তারা অনেক কিছু থেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন। বাস্তবে ওই মিডিয়ার মুখ বন্ধ করার ফলে দেশের উন্নয়নের ক্ষতি হয়। যেমন জামায়াত বিএনপি আমলে ক’ ঘণ্টার ভেতর কিভাবে ড্যান্ডি ডাইংয়ের ঋণ হয়েছিল বা সাইফুর রহমানের ছেলে নাসের কিভাবে ঋণ পেয়েছিল বা হাওয়া ভবনের কমিশন দিতে না পারার ফলে দেশে যে একটিও বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। দেশে পাঁচ বছর কোন বিদ্যুত উৎপাদন না হয়ে কেবল বিদ্যুতের পরিমাণ হ্রাস পায় এসব কথা কিন্তু মিডিয়াতে আসতে পারেনি। মিডিয়াকে যেমন রক্ষণশীলরা পূর্ণ স্বাধীনতা দেয় না তেমনি তারা বিরোধী দলকেও দেয় না মত প্রকাশ করতে। বিরোধী দল পারে না তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করতে। এমনকি তারা বিরোধী নেতাকে হত্যার চেষ্টাও করে। যা করেছিল জামায়াত-বিএনপি ২১ আগস্ট।
এর বিপরীতে উদার রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে মিডিয়া অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। কখনও কখনও আমাদের মতো অনুন্নত দেশে মিডিয়ার অনেক ব্যক্তির তার সাংবিধানিক অধিকার সম্পর্কে ধারণা না থাকার ফলে মিডিয়াকে সাংবিধানিক সীমারেখার বাইরেও নিয়ে যায়। সেখানেও দেখা যায় বিচার বিভাগ সজাগ হয়ে সে বিষয়ে কিছু না বললে উদার রাজনৈতিক দলগুলো তা নিয়েও কোন ব্যবস্থা নেয় না। অবশ্য এতে কিছুটা ক্ষতি হয়। অনেক ভাল কাজ সম্পর্কে দেশের মানুষের কাছে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। তারপরেও দেখা যায়, মিডিয়ার স্বাধীনতা থাকার ফলে দেশের উন্নয়নের কাজে অনেক ইতিবাচক ফল হয়। যেমন, বর্তমান সরকারের আমলে সোনালী ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা ও কয়েক ব্যবসায়ী মিলে সোনালী ব্যাংকসহ অন্য কয়েকটি ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করেছে। মিডিয়া বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হওয়াতে সরকার তাদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, মিডিয়ার সাপোর্ট থাকার ফলে জামায়াত-বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক আমলে গড়ে ওঠা ডেসটিনি গ্রুপের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এমনকি দেশের ইতিহাসে এই প্রথম একজন সাবেক মুক্তিযোদ্ধা সেনাপ্রধানকে গ্রেফতারও করেছে সে ঘটনায়। আর অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তো নিচ্ছেই। দুদক স্বাধীনভাবে সে কাজ করছে। অন্যদিকে উদার গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে রক্ষণশীল গণতান্ত্রিক সরকারের পার্থক্য এখানে যে, উদার গণতান্ত্রিক সরকার তাদের আমলে বা তাদের লোকজনও কোন দুর্নীতি বা অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। অন্যদিকে রক্ষণশীলরা নিজেদের লোকজন শুধু নয়, সার্বিক দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। যেমন তারেক কোকোর মানিলন্ডারিং মামলার তদন্ত করছে আমেরিকার এফবিআই। তারা এসে আমাদের কোর্টে সাক্ষী দিয়ে গেছে। সিঙ্গাপুরের আদালতের রায় অনুযায়ী কোকোর পাচার করা টাকা ফেরত এসেছে। অথচ বিএনপিপ্রধান বেগম জিয়া এটাকে অস্বীকার করে চলেছেন। এবং তার দলের সকলে একই কাজ করছেন। অন্যদিকে উদার গণতান্ত্রিক দলকে বাধ্য হতে হয় নিজেদের আমলের যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। যেমন বর্তমান সরকারের আমলে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। যার ফলে বর্তমান সরকার অভিযুক্ত সে মন্ত্রীকে পদত্যাগ করাতে বাধ্য করেছে দলের ভিতর থেকে দাবি ওঠার ফলে। ছুটিতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে অভিযুক্ত উপদেষ্টাকে। শুধু তাই নয় দুদক স্বাধীনভাবে ওই ঘটনার তদন্ত করছে। এবং একজন চাকরিরত সচিবকেও সে মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে, যা একটি ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে বেশ কঠিন কাজ। এছাড়াও বর্তমানের উদার গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রকাশ পাচ্ছে বিচার বিভাগের মাধ্যমে, যেমন জামায়াত বিএনপি সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে র্যাবকে একুশে আগস্ট হত্যাকা-ের ঘটনায় তদন্ত করতে পক্ষান্তরে নিষেধ করা হয়। সেদিন কিন্তু মিডিয়া এতটা স্বাধীন ছিল না যে, এই সত্য প্রকাশ করবে। সেদিন মিডিয়ার অনেকে এই খবর জানার পরেও কিন্তু প্রকাশ করতে সাহস পায়নি। ঠিক তেমনি দশ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র চালান আনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, কৃষিমন্ত্রী, এনএসআইপ্রধানসহ অনেকে জড়িত ছিলেন অথচ সেদিন মিডিয়া ওই দশ ট্রাক অবৈধ অস্ত্রের ঘটনার নেপথ্য খুঁজতে সাহসী হয়নি। কারণ, এ ধরনের কোন ঘটনার নেপথ্য খুঁজতে গেলেই তাকে মানিক সাহা বা হুমায়ুন কবির বালুর মতো দিনের বেলার বোমার আঘাতে প্রাণ দিতে হতো। এ কারণে দেখা যায়, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তুলনামূলক ভাল রাখতে এবং ক্রমান্বয়ে একটি ভাল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যেতে হলে, পাশাপাশি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার পথে এগুতে হলে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ধারাবাহিকতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের চার বছরের পূর্তি উপলক্ষে দেয়া ভাষণে দেশের জনগণের প্রতি তার সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য জনগণকে আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে বলেছেন। শেখ হাসিনার এই আহ্বানের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তাঁর সরকার যে উন্নয়ন কর্মকা-গুলো হাতে নিয়েছে এগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য। তিনি মনে করেন, তাঁর দল বা জোটের বদলে যদি কোন রক্ষণশীল দল ক্ষমতায় আসে তাহলে তিনি যে উন্নয়ন কর্মকা-গুলো হাতে নিয়েছেন বা ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছেন সেগুলো তারা বন্ধ করে দেবে। যার ফলে দেশ আবার পিছিয়ে যাবে। শেখ হাসিনার এই বক্তব্যকে ভোট চাওয়ার কৌশল হিসেবে কেউ কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেন। কিন্তু তথ্য ও উপাত্তের দিকে তাকালে দেখা যাবে শেখ হাসিনা এ দেশের অতীতের বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা বলেছেন। যেমন সামান্য কিছু তথ্য এখানে উল্লেখ করলে বোঝা যাবে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ অবধি ক্ষমতায় থাকার সময়ে আওয়ামী লীগ বা তৎকালীন ঐকমত্যের সরকার যে সকল জনগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটা কীহারে পরবর্তীতে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে বন্ধ করে দেয়। যেমন জনকণ্ঠে প্রকাশিত একটি খবরের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জামায়াত-বিএনপি সরকার ২০০১-এ ক্ষমতায় আসার পরে তাদের আগের সরকারের নেয়া জনগুরুত্বপূর্ণ ৯৯টি প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। যার প্রত্যেকটি প্রকল্প ছিল জনগুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকল্পগুলোর ব্যয় ছিল সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক ধাক্কাতেই জামায়াত-বিএনপি সরকার সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বন্ধ করে দেয়। এই ৯৯টি প্রকল্পের ভেতর ছিল বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে ৭টি, যুব ও ক্রীড়া উন্নয়নে ৬টি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়ে ২টি, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ২টি, সড়ক ও রেলপথের ২৪টি, মহিলা ও শিশু বিষয়ক ১টি, শিক্ষাবিষয়ক ৪টি, শিল্পবিষয়ক ৮টি, বিদ্যুতবিষয়ক ১টি (একটি হলেও এটা একটা সমন্বিত প্রকল্প এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত লিখছি) সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ৫টি, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ২টি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২টি, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ১টি, তার ও টেলি যোগাযোগের ৩টি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১৫টি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৪টি, অর্থ ১টি, জাতীয় সংসদ ১টি, ধর্ম ১টি, সমাজকল্যাণ ৪টি ও শ্রম-কর্মসংস্থানের ১টি।
এই প্রকল্পগুলোর ভেতর দেখা যায় ২০০০ সালে রাজধানী ঢাকাসহ তার আশপাশে সাধারণ মানুষের খাবার পানি সরবরাহের জন্য এক হাজার ছয় শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয় নারায়ণগঞ্জের পাগলায়। ওই প্রকল্পটির মাত্র ১০ ভাগ কাজ হয়েছিল। জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় এসে ওই প্রকল্পের ৩০ ভাগ কাজ হয়েছে দেখিয়ে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ একদিকে সুপেয় পানি সরবরাহের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বন্ধ করে। অন্যদিকে ৩০ ভাগ কাজ হয়েছে দেখিয়ে অর্থাৎ আরো ২০ ভাগ কাজ বেশি দেখিয়ে তারা প্রায় দু’শ’ কোটি টাকা লুটপাট করে। পরবর্তীতে এই প্রকল্প বর্তমান সরকারকে করতে হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত সেটা বন্ধ করে কেবল ২শ’ কোটি টাকা লুট করেছিল। বিদ্যুত খাতের গ্যাস চালিত ৮টি বিদ্যুতকেন্দ্রের কাজ নির্মাণাধীন অবস্থায় বন্ধ করে দেয়। এই ৮টি বিদ্যুতকেন্দ্রের মাধ্যমে নরসিংদী, হবিগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, ফেনী, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইলে পল্লী বিদ্যুত সমিতির মাধ্যমে ১৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুত বিতরণ সম্ভব হতো। এই কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিয়ে আঞ্চলিকভাবে প্রেরিত টাকাও সেদিন ভাগ বাটোয়ারা করে খাওয়া হয়। ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প বন্ধ করে সেখান থেকে জামায়াত-বিএনপির মন্ত্রী ও এমপিরা ৩১ কোটি টাকা ভাগ বাটোয়ার করে নেয়। এমনকি তারা দেশে খাদ্য গুদাম তৈরির প্রকল্পও বন্ধ করে দেয়। যার ফলে পরবর্তীতে ধান চাল সংগ্রহ করে রাখার ব্যবস্থায় সঙ্কট সৃষ্টি হয়। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় এসে আবার দেশের জন্য অনেক খাদ্যগুদাম তৈরি ও সংস্কারের কাজে হাত দিয়ে এ পর্যন্ত আরও ৩ লাখ টন খাদ্য মজুদ ক্ষমতা বাড়িয়েছে। এই সরকারের মেয়াদ শেষ হতে হতে এটা সাড়ে চার লাখ টনে পৌঁছাবে। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যে চুক্তি হতে যাচ্ছে তাতে আগামী মে থেকে খাদ্যগুদাম তৈরির ওই প্রকল্প শুরু হলে আরও দশ লাখ টন মজুদ ক্ষমতা বাড়বে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে এগুলো আবার একইভাবে মুখথুবড়ে পড়তে পারে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় ঐতিহ্য সংক্রান্ত সব প্রকল্প যেমন, মেহেরপুরের মুজিবনগরের ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র’, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ধরে রাখতে নেয়া ‘একুশে ভবন’, ‘মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ সকল প্রকল্প জামায়াত-বিএনপি বন্ধ করে দেয়।
এছাড়া প্রথম আলোর ২০০৪-এর ২২ সেপ্টেম্বরের প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, এডিপি থেকে তারা ৫৩টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দেয়। যার ভেতর ৪২টিই সড়ক ও সেতু নির্মাণের। এছাড়া ২১০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন সিদ্ধিরগঞ্জের তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র ও ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্পও তারা বন্ধ করে দেয়। প্রথম আলো সেদিন এই খবরের শিরোনাম দেয়, ‘আ’ লীগ সরকারের প্রকল্প বলেই কি?’ এছাড়া জাপান সরকারের সাহায্যে তৈরির কাজ শুরু হওয়া সার কারখানা সেদিন বন্ধ করে দেয়ায় জাপানের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনও হয়েছিল জামায়াত-বিএনপি সরকারের। জাপান রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যে বিবৃতিও দিয়েছিলেন। এছাড়া ঢাকার কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প বাতিল হয়। যেটা শেষ করা হয় তাও মূল পরিকল্পনার বদলে ছোট করে।
বর্তমান সরকারের তথ্য বিভাগ যদি দেশের মানুষের জন্য একটি তথ্যনির্ভর পুস্তিকা তৈরি করে তাহলে দেখা যাবে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ অবধি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের নেয়া কত উন্নয়ন প্রকল্প সেদিন বাতিল করা হয়েছিল। এবং যদি দেশের প্রকৃত অর্থনীতিবিদদের দিয়ে তার একটা মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে দেশের মানুষ বুঝতে পারবে দেশের উন্নয়নের জন্য কত ক্ষতি সেদিন ওই সরকার করেছে। তার ফলে দেশের মানুষ আরও বুঝতে পারবে উদার গণতান্ত্রিক সরকারের ধারবাহিকতা উন্নয়নের জন্য কেন দরকার। পাশাপাশি মৌলবাদী ও রক্ষণশীলরা ক্ষমতায় এলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা কতটা নষ্ট হয়। দেশ তাতে কতখানি পিছিয়ে পড়ে। এবং তাতে দেশের কত ক্ষতি হয়।
বাস্তবে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ একটি দ্রুতগতির উন্নয়ন ট্রেনের স্টেশনে পৌঁছেছে মাত্র। এই ট্রেনটিতে তাকে উঠতেই হবে। এই ট্রেন মিস করলে এর পরে উন্নয়নের আর কোন ট্রেন আসবে না। কেন আসবে না সেটা বিশ্লেষণ করতে গেলে এই লেখার কলেবর দিগুণ হবে। তবে এটা সত্য, এই কিন্তু আমাদের দেশের জন্য শেষ ট্রেন। তাই এখন আবার ওই স্টেশন থেকে পিছিয়ে আসার সময় আমাদের নেই। এ কারণে শেখ হাসিনার আহ্বান যেমন সত্য তার থেকে অনেক বড় হলো দেশের মানুষের উপলব্ধি। মানুষকে এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প এখন নেই। শুধু একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করে বিষয়টির গুরুত্ব কিছুটা অনুমান করা যাবে, জামায়াত-বিএনপি বলছে তারা ক্ষমতায় এলে কুইক রেন্টাল বা রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ করে দেবে। এর ফলে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ফলে কত কলকারখানা গড়ে উঠেছে। কত পরিবার বিদ্যুত নিয়েছে। এগুলো সব বন্ধ হয়ে যাবে। ওই কলকারখানা বন্ধ হলে শুধু যে উৎপাদনের ক্ষতি হবে তা নয়, কত হাজার লোক বেকার হবে? তার ফলে কত পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কত লাখ লোক অসহায় হবে পড়বে। বর্তমান সরকারের বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের উচিত হবে অর্থনীতিবিদদের মাধ্যমে এ নিয়ে গবেষণাপত্র তৈরি করে তার একটি সারসংক্ষেপ জনগণের কাছে প্রচার করা। মনে রাখা দরকার জনগণকে সঠিক তথ্য দেয়া ও বোঝানোর দায়িত্ব সরকারের। সরকার যদি সঠিক তথ্য জানাতে ও বোঝাতে সমর্থ না নয়, আর তার জন্য যদি জনগণ ভুল করে তাহলে সরকার ও তার দল সে দায় এড়াতে পারে না।

swadeshroy@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.