মস্কোয় এসেছি পুতিনকে সঙ্গে নিয়ে বন্ধুত্বের বীজ বপন করতে- বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী

মস্কোয় এসেছি বন্ধুত্বের বীজ বপন করতে। এর ফল দু’দেশের আগামী প্রজন্ম ভোগ করবে, ১৯৭৫ এরপর দু’দেশের সম্পর্ক থেমে যায়, এখন আমরা আবার নতুন করে শুরু করলাম।
’ রাশিয়া সফরের শেষ দিনে বুধবার বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিজড়িত মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার সহযোগিতার প্রেক্ষাপট নিয়ে দেয়া বক্তৃতায় এ আবেগঘন বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর রাশিয়া সফরের সময় একই বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তব্য রেখেছিলেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে রাশিয়ার অপরিসীম সহযোগিতার কথা তুলে ধরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। পিতার ওই সফরের ৪০ বছর পর রাশিয়া-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সফরে সরকারপ্রধান হিসেবে প্রথম রাশিয়া সফরে গেলেন শেখ হাসিনা।
স্থানীয় সময় সকালে মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী। স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছলে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর ভিক্তর আস্তোনোভিচ সাদোভনিচি। প্রথমে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস জাদুঘর পরিদর্শন করেন শেখ হাসিনা। পরে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন।
বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমাদের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও উদ্দেশ্যগুলো যখন একবিন্দুতে মিলিত হবে, আমাদের বন্ধুত্বও আরও শক্ত ভিত্তি পাবে। তাতে সুফল আসবে, দু’দেশের মানুষের জীবনে আসবে সমৃদ্ধি।’
তিনি বলেন, ‘আমি আজ মস্কোয় এসেছি, প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে সঙ্গে নিয়ে সেই বন্ধুত্ব আর সহযোগিতার বীজ বুনতে, যার ফল হয়ত আগামীতে আপনারা ভোগ করবেন।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সূচনা এবং তার পরের সরকারগুলোর সময় তা থমকে যাওয়ার বিষয়গুলোও উঠে আসে শেখ হাসিনার বক্তৃতায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫ এরপর দু’দেশের সম্পর্ক থেমে যায়। এখন আমরা আবার নতুন করে শুরু করলাম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের অধিকারের দাবি তুললে পাকিস্তানের দখলদার তাদের ওপর গণহত্যা চালায়। নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ হয়, আড়াই লাখ নারী সম্ভ্রম হারান, বাস্তুচ্যুত হয় এক কোটি মানুষ। সেই দুর্দিনের সময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতা লাভের আগ পর্যন্ত ওই রক্তাক্ত সংগ্রামে তারা আমাদের পাশে ছিল।’
স্বাধীনতার পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনেও রাশিয়ার সহযোগিতা ও দু’দেশের সম্পর্কের ঐতিহাসিক ও আবেগ-অনুভূতির কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘সব সময় আমাদের এই বন্ধুদের আমরা মনে রেখেছি। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্য অনেক রুশ নাগরিককে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দিয়েছে।’
বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সত্তরের দশকে আমাদের দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ছিল। আজ তা মাত্র আধা বিলিয়নে এসে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়ায় আমরা যে পরিমাণ রফতানি করি তার দ্বিগুণ পরিমাণ পণ্য বাংলাদেশে রফতানি করে রাশিয়া।’
রাশিয়া, কাজাখস্তান ও বেলারুশের ১৮ কোটি মানুষের সমন্বিত বাজার কাস্টমস ইউনিয়নেও বাংলাদেশী পণ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। রাশিয়া ও কাস্টমস ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর চাহিদা পূরণের জন্য বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ারও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি বাংলাদেশে বিনিয়োগবান্ধব সব ধরনের সুযোগ ও পরিবেশ রয়েছে উল্লেখ করে রুশ বিনিয়োগকারীদের এদেশে বিনিয়োগে আহ্বান জানান।
বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে দু’দেশের সহযোগিতার বিস্তৃত ক্ষেত্র রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জানান, সত্তরের দশকে রাশিয়ার সহযোগিতায় বাংলাদেশে গড়ে তোলা বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এগুলোর সংস্কারের পাশাপাশি নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনসহ এ খাতে অগ্রগতিতে রাশিয়াকে আরও ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে কৃষিতেও দু’দেশের সহযোগিতার অনেক সুযোগ রয়েছে বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী। মঙ্গলবার দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের কথা উল্লেখ করেন তিনি বলেন, এগুলো দু’দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য। আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। রাশিয়া আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। এই সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।
বক্তৃতার পর মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর ভিক্তর আস্তোনোভিচ সাদোভনিচি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফর অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং যুদ্ধ-পরবর্তী দেশ পুনর্গঠনে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তার কথাও উল্লেখ করেন আস্তোনোভিচ।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে একটি ডিপ্লোমা এবং মস্কোর একটি পেইন্টিং তুলে দেয়া হয়। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীও সুন্দরবনের একটি ছবি ও বই উপহার দেন রেক্টরকে। এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগ্নি আজমিনা সিদ্দিক।
স্থানীয় সময় বুধবার দুপুরে রাশিয়ার আণবিক শক্তি কর্পোরেশন রোসাটমের মহাপরিচালক সের্গেই কিরিয়েনকোর সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। পরে তিনি ক্রেমলিন জাদুঘর ও গ্যাজপ্রম কার্যালয় পরিদর্শন করেন।
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি যৌথ কমিশন গঠনের বিষয়ে দুই শীর্ষ নেতা একমত হন। পরে শেখ হাসিনা চলতি বছর রুশ প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। রুশ প্রেসিডেন্ট সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.