বাংলাদেশের সার্বভৌম মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন সংবিধান by মুনতাসীর মামুন

লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান যে নষ্টামির রাজনীতি শুরু করেছিলেন বাংলাদেশে তা সুচারূভাবে এগিয়ে নিয়েছিলেন সামরিক বাহিনীর আরেক প্রতিনিধি লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাদের রাজনীতির মূল ভিত্তি ছিল সামরিক বাহিনী।
সামরিক আইন জারি করে তারা ক্ষমতায় এসেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, জেনারেল জিয়া তো সামরিক আইন জারি করেননি। করেছেন মোশতাক। বুঝেও যারা না বোঝার ভান করে তারা ছাড়া আর কেউ এ কথা বিশ্বাস করবে না। সেই নষ্টামির রাজনীতির উত্তরাধিকার খালেদা জিয়া। জেনারেল মইন নামে আরেক অর্বাচীন সেই রাজনীতি আবার পুনর্প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন জোরেশোরে। তার সাঙ্গোপাঙ্গরা বন্দুক দেখিয়ে যথেষ্ট মালকড়ি কামিয়ে ছিলেন তারপর মানুষের তাড়া খেয়ে এদিকে সেদিক ছিটকে পড়েছেন। জেনারেল ও তার কিছু সঙ্গী আর দেশে ফিরতে পারেননি।
এই জেনারেলরা পাকিস্তান প্রত্যয়ে ছিলেন বিশ্বাসী। আইয়ুব খান ছিলেন এদের আদর্শ। আইয়ুব খান মারা গেছেন বটে কিন্তু তার জারজ পুত্ররা এখন বেঁচেবর্তে আছে, মাঝে মধ্যে তারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
জিয়া বাংলাদেশ দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন না। সেই জন্য সামরিক আইন জারি করে বাংলাদেশ প্রত্যয়ের মূল দর্শনই বদলে ফেলেছিলেন। আজকের বাংলাদেশে যে বিভক্তি, যে অস্থিতিশীলতা এর জন্য সম্পূর্ণভাবে জিয়া দায়ী। বাংলাদেশের এত ক্ষতি আর কেউ করতে পারে নি।
এসব বন্দুকধারীর একটি বৈধতা দরকার হয়। পৃথিবীর সব দেশ তো আর বাংলাদেশ নয়, যে দুর্বৃত্তদের খাতির-যত্ন করবে। ফলে প্রেসিডেন্ট হলে ইউনিফর্মটা ছাড়তে হয়। জিয়া-এরশাদের ভাগ্য ভাল। আমাদের কিছু জজ বা বিচারক এদের প্রাণ খুলে সাহায্যে করেছিলেন। এরা তাদের অধীনে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। আদালতে তাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। তারা বলেছেন, কাজে-কর্মে দেখিয়েছেন, মার্শাল ল বহুত উমদা চিজ হ্যায়। সেই থেকে বাংলাদেশে একটি প্রবচনের সৃষ্টি হয়েছিল। জেনারেল ও জজরা বাংলাদেশের সব নষ্টামির মূল। প্রথমজন বন্দুক উঁচিয়ে হত্যা করেন। দ্বিতীয়জন বলেন, সব ঠিক হ্যায়।
গত কয়েক বছরে অবস্থাটা বদলাচ্ছে এবং আমরা আশা করি আরও বদলাবে। বেশ কিছু বিচারক বাংলাদেশের মর্যাদা বিশেষ করে আদালতের মর্যাদা যথেষ্ট ফিরিয়ে এনেছেন। সাংবিধানিক ধারার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আমরা আবার বিচারকদের ওপর আস্থা ফিরে পাচ্ছি। জনস্বার্থের প্রতি তারা গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সাংবিধানিক ধারা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছেন বিচারপতি খায়রুল হক। তারপর বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী। তাদের দু’জনকে অনেকবার বিতর্কিত করার চেষ্টা হয়েছে। কারণ তারা সামরিক স্বার্থ ও জারজপুত্রদের স্বার্থে আঘাত হেনেছেন। তাদের অপসারণ চাওয়া হয়েছে। কয়েক দিন আগে বিএনপি- জামায়াত নেত্রী খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে বড় গলায় বলেছেন, খায়রুল হক ঘুষ খেয়েছেন। এ রকম একটা মিথ্যা অপবাদের প্রতিকার চেয়ে কেউ কোন কথা বলেননি, প্রতিবাদ করেননি। টেলিভিশনের মধ্যরাতের আঁতেল, সুজন সুশীল তাদের মুখপাত্র বিভিন্ন পত্রিকা, বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবী কেউ টুঁ শব্দটি করেননি। সাধারণ বিএনপিপন্থীরা এ ধরনের মন্তব্য করলে আওয়ামীপন্থীরা চিৎকার করেন। কিন্তু আদালতপাড়ায় আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের, তাদের সমর্থনকারী আইনজীবীদের কেউ একটি কথাও বলেননি। এমনকি খন্দকার মাহবুব, যিনি বারের প্রধান হয়ে বিভিন্নজনকে নৈতিকতার সবক দেন তিনিও নিশ্চুপ। এর অর্থ, এরা মূলত একই সূত্রে গাথা। এস্টাবলিশমেন্টের স্বার্থ। তবে সমাজ এসব কারণে তাদের ভালভাবে আরও চিনতে পারছে। এরাও কোন না কোনভাবে জিয়া-এরশাদ-খালেদার নষ্টামির ধারাটা বহন করছেন।
এত বড় ভূমিকা দিতে হলো, সম্প্রতি এই নষ্টামির ধারার বিরুদ্ধে আরেকটি রায়ের কথা প্রসঙ্গে এরশাদের সপ্তম সংশোধনী উদ্ভূত এই রায়টি গত এক মাসের ডামাডোলে উপেক্ষিত হয়েছিল। ডেইলি স্টার রায়টিকে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে পরপর দু’দিন শিরোনাম করেছে। সুজনদের সমর্থক হয়েও স্টার সম্পাদক যে কাজটি করতে পারলেন, বাংলা কাগজের সম্পাদকরা সে কাজটি করতে কেন ব্যর্থ হলেন তা বোধগম্য হলো না। রাষ্ট্রের কাঠামোর বুননের জন্য রায়টি গুরুত্বপূর্ণ।
যে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই রায়টি দেয়া হয়েছে তা সিদ্দিক আহমদ বনাম রাষ্ট্র। হাইকোর্ট বিভাগ ২০১০ সালে এ বিষয়ে যে রায় প্রদান করেছিল তা থেকে উদ্ভূত সিভিল আপীলের নিষ্পত্তি করেছেন সুপ্রীমকোর্টের সম্পূর্ণ বেঞ্চ। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক রায়টি লিখেছেন যার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছেন বেঞ্চের অন্য বিচারকরা। বিচারপতি খায়রুল হক এর আগে সামরিক আইন অবৈধ ঘোষণা করে পঞ্চম সংশোধনী সম্পর্কে রায় দিয়েছিলেন। সেই রায়ের নির্যাসের বিস্তৃতিকরণ এই রায়।
তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘হালিমা খাতুন বনাম বাংলাদেশ’ মামলা প্রথম, যেখানে সামরিক আইন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ১৯৭৮ সালে সেই রায়ে সুপ্রীমকোর্টের বিচারকরা দেশের শাসনতন্ত্র থেকে সামরিক আইনকে উপরে তুলে ধরে ছিলেন। বিচারপতি হক বলেছেন, বিচারকরা সম্পূর্ণ ভুল কাজটি করেছেন। ওই মামলার রায় দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এবি মাহমুদ হোসাইন, বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন এবং বিচারক ফজলে মুনিম। তারা বলেছিলেন, সংবিধানের ৭ম অনুচ্ছেদে সংবিধানের যে ‘সুপ্রিমেসি’ তুলে ধরা হয়েছে তা ‘নো লংগার আন কোয়ালিফাইড’। ওই বিচারকদের রায়ের ভিত্তি ছিল পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি মুনিরের রায়, যে রায়ে তিনি সামরিক আইনের বৈধতা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ওই বিচারকদের রায় প্রসঙ্গে বিচারপতি খায়রুল হক লিখেছেন, তাদের ওই সব পর্যবেক্ষণ অদ্ভুত। কারণ এটি পরিষ্কার সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। তাঁর ভাষায়, “These observations are preposterous. Let it be unquestionably declared that the supremacy of the constitution was unqualified, it is unqualified and it shall remain unqualified for all time to come.” এত চমৎকার কিন্তু কঠোরভাবে পূর্বতন বিচারকদের রায়ের সমালোচনা কোন বিচারক করেননি এবং সংবিধানের সার্বভৌমত্বও তুলে ধরেননি। সংবিধান কেন সবার উপরে?
এর কারণও তিনি তুলে ধরেছেন। সংবিধান বাংলাদেশের সার্বভৌম মানুষের ইচ্ছার প্রকাশ যে কারণে তা পবিত্র এবং প্রজাতন্ত্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি সংবিধান। সবদিক থেকে এটি সবার ওপরে। সামরিক আইনবিধি তা কখনই চ্যালেঞ্জ বা লুপ্ত করতে পারে না। তার ভাষায়, “Let it be unhesitatingly declared that the constitution being the solemn expression of the will of sovereign people of Bangladesh is sacrosanct and immutable and all organs of the republic are its existence to the constitution. It is supreme all respect. The martial law proclamations, regulations and orders are non est before it.”
আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন তাহলো, সংসদ সদস্য সার্বভৌম মানুষের প্রতিনিধি, সে কারণে সংসদ বা তার ভাষায়, ‘হাউস অব নেশন এজ এ হোল ইজ সুপ্রিম।’ এবং অন্তিমে সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব সাধারণ মানুষের, অন্য কারও নয়।
এতদিন সামরিক শাসন আইনী বৈধতা পেয়েছিল। এখন তা সম্পূর্ণভাবে নাকচ করা হলো। এই রায় যেসব দেশে সামরিক আইন আছে বা হবে সেখানে নজির হিসেবে তুলে ধরা হবে। এটি সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ও উচ্চ আদালতের জন্য একটি অর্জন। এই রায়ের ফলে আবার প্রমাণিত হলো জিয়া এবং এরশাদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল ও ভোগ করেছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীতে যারা এ ধরনের কাজ করবে তা যেন অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
এ রায় আমাদের ইতিহাসের ন্যারেটিভেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক পালন করবে। আইনী বৈধতা থাকায় ডিসকোর্সে এই রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল। মানুষ জানে সামরিক আইন অবৈধ। কিন্তু আদালত বলছে বৈধ। জনমানুষের সঙ্গে আদালতের দ্বৈরথ এখন শেষ হলো। মনোজগতের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন বিস্তারেও এই রায় সহায়ক হবে। মাঝে মাঝে মনে হয়, জনস্বার্থমূলক এবং ন্যায্য এ রকম একটি রায় দিতে আদালতের ৩৫ বছর লাগল। বিচারপতি খায়রুল হক এর আগেও জনস্বার্থে মাইলফলক কয়েকটি রায় দিয়েছেন। যার মধ্যে এটি অন্যতম। এই রায় নবীন বিচারকদের প্রণোদনা যোগাবে জনস্বার্থকে সবার ওপরে, মানুষের ইচ্চাকে সবার ওপরে স্থান দিতে। কারণ বাংলাদেশের মানুষ সার্বভৌম সুতরাং তার ইচ্ছাই সার্বভৌম যা প্রতিফলিত হবে সংসদ সদস্যদের দ্বারা সংবিধানে ও সংসদে।

No comments

Powered by Blogger.