পদ্মা সেতু ॥ দুর্নীতি ॥ হোসেন হাসান আসামি?- ০ বর্তমানের প্রধান আসামি মোশাররফ হোসেন ভূইয়া সাময়িক বরখাস্ত- ০ দুই-এক দিনের মধ্যে কানাডা সরকারের কাছে যাচ্ছে আবেদনপত্র by মহিউদ্দিন আহমেদ

 পদ্মা সেতু পরামর্শক যাচাইতে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় আরও আসামি আসছেন। নয়া আসামিদের মধ্যে জড়িয়ে যেতে পারেন এজাহারের গর্ভে থাকা সন্দেহভাজন দু’জন।
এদিকে মামলার প্রধান আসামি দুদকের হাতে গ্রেফতার থাকা মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের উদ্বেগ দূর করতে স্বচ্ছ তদন্তের জন্য রমেশের ডায়েরির জন্য কানাডা সরকারের কাছে প্রেরণ করতে চূড়ান্ত করা হয়েছে আবেদনপত্র। কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী তিনটি প্রশ্নের জবাবসহ দু-এক দিনের মধ্যে কানাডায় পাঠানো হবে। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চিঠির ব্যাখ্যার উত্তর ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সুবিধাজনক সময়ে সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধির মাধ্যমে ব্যাখ্যা প্রেরণ করা হবে প্যানেল সদস্যদের কাছে। খবর দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এদিকে মামলার তদন্ত এবং বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক প্যানেল প্রধানের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে বুধবার দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, তাদের বিশ্বাস দুদকের তদন্ত শেষ হলে বিশ্বব্যাংকের সকল উদ্বেগ, আশঙ্কা কেটে যাবে। তিনি বলেন, অনুসন্ধান পর্যায়ে যাদের আসামি করা যায়নি তাদের তদন্তে আসামি করার সুযোগ আছে। ওই আসামিদের বলা হয় তদন্তে আগত আসামি।
পদ্মা সেতু পরামর্শক যাচাইতে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ১৭ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক মামলা দায়েরের পর মামলার অভিযোগপত্র প্রেরণ করা হয় বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞ প্যানেলের কাছে। মামলা দায়েরের দুদিন পর সংস্থাটি একটি বিবৃতি প্রদান করে। ওই বিবৃতিতে তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে। এর মধ্যে মামলা দায়েরের পরের দিন দুদক ছয় সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করে তদন্ত কাজ শুরু করে। দুদক মামলার প্রধান দুই আসামি মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবং কাজী ফেরদাউসকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এছাড়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও প্রধান আসামির কম্পিউটার জব্দ করে। এমন অবস্থায় চলতি মাসের ৯ তারিখে বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলপ্রধান ওকাম্পোর লিখিত আকারে তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সেখানে তাঁরা মামলার এজাহারের উল্লেখ থাকা সন্দেহভাজন আসামিদের ভূমিকা স্পষ্ট করাসহ কয়েকটি ব্যাখ্যা চেয়েছেন। এছাড়া তদন্তে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার পাশাপাশি কিছু পরামর্শ প্রদান করে দুদককে। সর্ব শেষ মঙ্গলবার রাতে বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের প্যানেলপ্রধান ওকাম্পোর সংক্ষিপ্ত একটি বিবৃতি প্রদান করেন। ওই বিবৃতিতে ঢাকা সফরের সময় দুদকের সঙ্গে প্যানেল সদস্যদের খোলামেলা আলোচনার প্রশংসা করে দুদকের মামলার এজহারকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে মন্তব্য করেন তিনি। তবে এজাহারটি পর্যালোচনা করে প্যানেল তদন্তের পরিধির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। দুদক ইতোমধ্যে ৯ জানুয়ারি প্রেরণ করা চিঠিতে যেসব বিষয়ে প্যানেল ব্যাখ্যা চেয়েছে সেই সব ব্যাখ্যা প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। কিছু অফিসিয়াল কাজ বাকি রয়েছে। তা সম্পন্ন হলে বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি এ্যালেন গোল্ডস্টেইন পাশাপাশি প্যানেলপ্রধানের কাছে ব্যাখ্যা প্রেরণ করবে। রমেশ সাহা ও ইসমাইলের ডায়েরি এবং তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কানাডিয়ান পুলিশের মামলার এজাহার পাওয়ার জন্য কানাডায় দুদক টিম যেতে হলে কয়েকটি শর্ত মেনে যেতে হবে। সে অনুযায়ী দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দায়ের করা মামলার কপি, তথ্য সংগ্রহের জন্য দুদকের টিম কানাডায় গিয়ে কি কি কাজ করবে তার একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি সম্পন্ন করেছে তদন্ত টিম। এছাড়া বিদেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের নথি কোন আইনের আওতায় গ্রহণ করা হবে সেই আইনের ধারাও সংগ্রহ করেছে দুদক। আগামী দুই/এক কার্য দিবসের মধ্যে তা প্রেরণ করা হবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। মামলার তদন্ত এবং বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক প্যানেল প্রধানের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে বুধবার দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান আরও বলেন, ওরা চায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত। আমরাও তা চাই। যাতে কোন নিরপরাধ ব্যক্তি জড়িয়ে না যায়। আবার কোন অপরাধী যেন বাদ না পড়ে। এই ক্ষেত্রে উভয়ের লক্ষ্য অভিন্ন। ওদের দেশের এবং আমাদের দেশের নিয়ম ভিন্ন। তাদের দেশে অনুসন্ধান পর্যায়ে যা করা যায়, আমাদের দেশে তা করা যায় না। এই দেশে আইন অনুযায়ী যুক্তি, সাক্ষ্যগ্রহণ করে এফআইআর করা হয়। তদন্তে দেখায় যায় কেউ বাদ পড়ে আবার কেউ তদন্তে অন্তর্ভুক্ত হয়। এদের বলা হয় তদন্তে আগত আসামি। তিনি বলেন, তাঁরা আশা করেন তাঁদের (বিশ্বব্যাংকের) সকল আশঙ্কা, উদ্বেগ দূর করতে পারবে দুদক।
দুদকের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জনকণ্ঠকে বলেন, অনুসন্ধান পর্যায়ে আবুল হোসেন ও আবুল হাসানকে আসামি করার মতো তথ্যের আইনী ভিত্তি দুর্বল থাকায় সন্দেহভাজন রাখা হয়। কিন্তু তদন্তে তাদের বিষয়ে কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। আইনী দিক পর্যালোচনা শেষে তাদের নাম চার্জশীটভুক্ত করা হতে পারে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সরকার। এর আগে তাঁকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছিল। বুধবার জনপ্রাশসন মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে বলা হয়, যেহেতু মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে বনানী থানার মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন, সেহেতু বিধি অনুযায়ী গ্রেফতার হওয়ার তারিখ থেকে সরকারী চাকরি থেকে তাঁকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হলো।
হাইকোর্ট জামিন আবেদন ফিরিয়ে দেয়ার পর মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গত ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রিমান্ডে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনকে পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দিতে ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে গত ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে মোশাররফকে প্রধান আসামি করা হয়।
মামলার পর এই সচিবকে ওএসডি করা হয়। এর আগে অবশ্য তাকে সেতু বিভাগ থেকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে বদলি করা হয়েছিল।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা পারস্পারিক যোগসাজসে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের তদারকি পরামর্শকের কাজ এর অন্যতম দরদাতা এসএনসি লাভালিন ইন্টারন্যাশনালকে পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে। এর মধ্য দিয়ে তারা দ-বিধির ১৬১ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে অপরাধ করেছেন, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসএনসি লাভালিন ওই কার্যাদেশ পেলে ‘ঘুষ লেনদেন সম্পন্ন হতো’ বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২৯১ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। দুদক এরপর তদন্ত শুরু করলেও সরকারের সঙ্গে মতভেদ না কাটায় গত জুন মাসে ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এরপর সরকারের নানামুখী তৎপরতায় বিশ্বব্যাংক সিদ্ধান্ত বদলায়।
তাদের দেয়া শর্ত অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রসিকিউটর লুইস গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্যানেল দুদকের তদন্ত পর্যবেক্ষণ করছে।

No comments

Powered by Blogger.