আমরা ধারাবাহিক রাজনৈতিক শাসন চাই by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

লিবারেল গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরুর রাজনৈতিক অবস্থান কিভাবে বিবেচনা করব। লিবারেল গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুর রাজনৈতিক অবস্থান কিভাবে বিবেচনা করব। এসব নিবেচনার ভিত্তিতে আছে রাষ্ট্র ও সরকারের স্বরূপ।
সংখ্যাগুরুর রাজনৈতিক অবস্থান ও সংখ্যালঘুর রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তৈরি হয় লিবারেল গণতন্ত্র। লিবারেল গণতন্ত্রের অন্য নাম সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্র। পাঁচ বছর মেয়াদী সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্রের অর্থ সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতন নয়। সরকার গঠন ও সরকারের স্বরূপ এই প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত হয়। সংখ্যালঘুকে মেনে নিতে হয় এই প্রক্রিয়া উদ্ভূত সরকারের শাসন। সংখ্যালঘু ধৈর্য ধরে দেরি করতে থাকে নির্বাচনের। যদি নির্বাচনে সংখ্যালঘু জিতে আসে, তাহলেই সরকারের পরিবর্তন হয়। এই প্রক্রিয়ায় সরকারের পরিবর্তন, সংখ্যালঘুর সংখ্যাগুরু হওয়ার পরিবর্তন, পৃথিবী জোড়া লিবারেল গণতন্ত্রের ভিত্তি। অন্য প্রক্রিয়া গণতন্ত্রের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য নয়। গণতন্ত্রের শাসন এই অর্থে সংখ্যাগুরুর শাসন এবং সংখ্যালঘুর পাঁচ বছর মেয়াদী ধৈর্য ধরে অপেক্ষা। সংখ্যালঘু তার বক্তব্য সংখ্যাগুরুর ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না, চলতে পারে না : নির্বাচন করব না। নির্বাচন ছাড়া সরকার পরিবর্তনের অন্য কোন উপায় লিবারেল গণতন্ত্রে নেই। নির্বাচন বাদ দিয়ে সংখ্যাগুরু যেমন পাঁচ বছরের বেশি সময়কাল ধরে সরকারের কর্তৃত্ব পরিচালনা করতে পারে না, তেমনি সংখ্যালঘু নির্বাচন বাদ দিয়ে সরকারের কর্তৃত্ব দখল করতে পারে না। এই অর্থে সংখ্যাগুরুর রাজনৈতিক অবস্থান লিবারেল গণতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত এবং সংখ্যালঘুর রাজনৈতিক অবস্থান লিবারেল গণতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। নির্বাচন ছাড়া সংখ্যাগুরু অনন্তকাল ধরে শাসন চালাতে পারে না, তেমনি নির্বাচন ছাড়া সংখ্যালঘু চক্রান্ত করে ক্ষমতা দখল করতে পারে না। লিবারেল গণতন্ত্রে নির্বাচন হচ্ছে পরিবর্তনের বাহক।
নির্বাচন তো দল করে। দল বাদে নির্বাচন হয় না। পৃথিবীর যেসব দেশে লিবারেল গণতন্ত্র আছে, সেখানে নির্বাচন হচ্ছে সরকার বদলের প্রধান উপায়। ষড়যন্ত্র সরকার দখলের একটি উপায় হতে পারে, কিন্তু সরকার বদলের প্রধান উপায় বলে ষড়যন্ত্র গণতন্ত্রে কোথাও স্বীকৃত নয়। বাংলাদেশ, বোধহয় একমাত্র দেশ যেখানে গণতন্ত্রকে ভয় পায়, নির্বাচনকে ভয় পায়। দল চাই, আবার দল চাই না। দল নির্বাচন করবে, কিন্তু নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই, একে বলে সোনার পাথর বাটি। এত ভয়, চারপাশে এত ভয়, নির্বাচন এবং দল মানুষকে সাহসী করে, ভীতু করে না। নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা চাই, সেনাবাহিনী মোতায়েন চাই। সাধারণ মানুষ, অজস্র অজস্র সাধারণ মানুষের নির্বাচনে অংশগ্রহণে কি নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার বিকল্প নয়, অজস্র অজস্র সাধারণ মানুষের নির্বাচনে অংশগ্রহণে কি সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিকল্প নয়। মানুষকে ভয় করলে সাধারণ মানুষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাহস হয় না। সাহসই গণতন্ত্র।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে দল ক্ষমতার লড়াইকে শক্তিশালী করে তোলে, দলের সমর্থকদের বৈপ্লবিক এজেন্সি করে তোলে। নির্বাচনকালীন সরকার হয়ে ওঠে ভ্যানগার্ড সরকার, গণতন্ত্র রক্ষার সরকার : সংখ্যাগুরুর সরকার নয়, সংখ্যালঘুর সরকার নয়, বিশেষ স্বার্থ রক্ষার (সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষার) সরকার নয়। নির্বাচনে সাধারণ মানুষের বিশাল ব্যাপক অংশগ্রহণই নির্বাচনকালীন সরকারকে নিরপেক্ষ করে তোলে, দলের অংশগ্রহণেই নির্বাচনকালীন সরকারকে নিরপেক্ষ করে তোলে, সেজন্য নিরপেক্ষতা কোন ষড়যন্ত্রের অংশ নয়, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতাই নির্বাচনকালীন সরকারকে নিরপেক্ষ করে রাখে। যে দল সাধারণ মানুষের সাহস ভয় পায়, সে দলই গণতন্ত্রবিরোধী বহু ব্যবস্থা অর্থাৎ নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা, সেনাবাহিনী মোতায়েনের আওয়াজ তোলে। গণতন্ত্র প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটা ধারাবাহিকতা। এই ধারাবাহিকতার মধ্যে বিভাজন তোলা হয় নির্দলীয় সরকারের আওয়াজ তোলার মধ্য দিয়ে। নির্বাচনকালীন সরকারের আওয়াজ তোলার অর্থ মানুষকে, সাধারণ মানুষকে অপমান করা। সাধারণ মানুষ ভোট দিতে পারে, নির্বাচনউত্তর সরকার গঠন করতে পারে, শুধু নির্বাচন করতে পারে না। এমন অদ্ভুত যুক্তি, সাধারণ মানুষকে অপমান করার কৌশল কোথাও নেই। কোন দল আগে নির্দলীয় সরকারের আওয়াজ তুলেছেন, সেটা বড় কথা নয়। দল কখনো কখনো ভুল করতে পারে। ভুলকে মহাসত্য বলে সর্বকালের জন্য মেনে নেয়া হচ্ছে নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ। আমরা এই নির্বুদ্ধিতা থেকে উদ্ধার পেতে চাই।
এই যে বিভাজন, একদিকে কিছু জ্ঞানী ব্যক্তি, অন্যদিকে বিরাট সংখ্যক চাষাভুসো মানুষ, একদিকে একটি ‘এনলাইটেন্ড সরকার, অন্যদিকে বিরাট সংখ্যক ভোটার : এই বিভাজন সমাজকে অধঃপতিত করে, মর‌্যালি নষ্ট করে, সমাজ সংস্কারের সাহস ভ-ুল করে, থাকে শুধু প্রতারক ব্যক্তির কা-কারখানা (আমরা কি দেখিনি ইয়াজউদ্দিন-ফকরুদ্দীন-মইনউদ্দীনের কার্যকলাপ)। আমরা প্রতারিত হতে চাই না, বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের অপশাসন চাই না। সাধারণ মানুষকে যারা অধঃপতিত করেছে, তাদের বিদায় দিতে হলে গণতন্ত্রের ভোট দরকার, রাজনৈতিক ক্ষমতা দরকার, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিক রাজনৈতিক ক্ষমতা দরকার। রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে ছেদ তৈরি করে (তত্ত্বাবধায়ক সরকার), সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করে, (ব্যারাকমুক্ত সেনাবাহিনীর রুদ্ররূপে আবির্ভাব) সমাজ ও রাষ্ট্রকে কলুষিত করে, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে হৈ হৈ করে দুর্বৃত্তরা (দুর্বৃত্তদের প্রতিহত করতে পারে একমাত্র ভয়মুক্ত সাধারণ মানুষ (গণপিটুনি তাদের নিয়ন্ত্রণে সক্ষম)।
গণতন্ত্রের ধারাবাহিক রাজনৈতিক ক্ষমতাই সমাজকে অধঃপতন থেকে রক্ষা করে এবং একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে বৈপ্লবিক করে তোলে। তাছাড়া, সামাজিক অবস্থা : নির্যাতন ও অমানবিকরণকে বদলাতে হলে সাধারণ মানুষকে ভোট, সরকার গঠন, নির্বাচনের বিধিব্যবস্থা থেকে বদলে দেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। তাহলেই মানুষ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ভোটের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সরকার ব্যবস্থার ওপর কর্তৃত্ব আরোপ করতে সক্ষম হবে। পরিবর্তনের বাহক তারা কিছুতেই হতে পারবে না, যদি কিছু শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ও অজ্ঞ ব্যক্তির মধ্যে ফারাক তৈরি করা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও ভোটারদের মধ্যে তফাৎ তৈরি করা হয়। তফাৎ তৈরি হলেই ক্ষমতায় দুর্নীতি শুরু হয়। আমরা অন্য ধরনের মানুষের শাসন চাই না, আমরা ধারাবাহিক রাজনৈতিক শাসন চাই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভিত্তি সেজন্য লিবারেল গণতন্ত্র বিরোধী। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই প্রক্রিয়ায় হয়ে ওঠে শ্রেণী মতাদর্শ। এই তত্ত্বের ভিত্তি শ্রেণী বিভাজন : বুদ্ধিমান ব্যক্তি বনাম চাষাভুসো মানুষ। এই তত্ত্বের কোন এথিক্যাল অবস্থান নেই, সকল ব্যক্তির অবাধ, মুক্ত এবং সমতাসম্পন্ন পরিবুদ্ধির কোন অঙ্গীকার নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার এথিস্টিক মডেল। এই মডেলে শ্রেণীক্ষমতা বিধৃত এবং শ্রেণী সমাজে রাষ্ট্রের স্বরূপ উন্মিলিত। আমরা লড়াই করে বুঝেছি এই সরকার কেন বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রিয়। বিশেষ বিশেষ সময়ে এই সরকার হয়ে ওঠে পাবলিক প্রসিকিউটর। আমরা প্রবঞ্চিত হয়ে, লড়াই করে বুঝেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার শ্রেণী স্বার্থের সরকার। ভোটের লড়াই শ্রেণী ও শ্রেণী স্বার্থ সঙ্কুচিত করার, উচ্ছেদ করার লড়াই। এই লড়াইয়ে আমাদের জিততে হবে।

No comments

Powered by Blogger.