উড়ল পতাকা, জিতলেন হামিদুল by মনিজা রহমান

উড়ল লাল-সবুজ পতাকা। বাজল 'আমার সোনার বাংলা'। জিতলেন হামিদুল ইসলাম। ১১তম এসএ গেমসের চতুর্থ দিনে এসে স্বাগতিকরা গর্বভরে গাইতে পারল, চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
এ বাঁশি বাজালেন গরিব ঘরের এক অদম্য যুবক। নাম তাঁর হামিদুল। দেশের সীমানত্মবর্তী শহর মেহেরপুরের গাংনিতে জন্ম নেয়া খেলোয়াড় শুধু চলতি আসরে বাংলাদেশকে প্রথম স্বর্ণ উপহার দিলেন না, শক্তির খেলা ভারোত্তোলনে এনে দিলেন স্বর্ণালি সাফল্য।
শৈশব থেকে বড় স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হবার। ফুটবল খেলতেন সেই সময়। তখন এলাকার এক বড় ভাই বললেন, তোমার স্বাস্থ্য ভাল। ভারোত্তোলন চর্চা করতে পার। সেই ভাইয়ের কথামতো স্থানীয় মোয়াজ্জেম জিমন্যাস্টিক্স কাবে ভর্তি হলেন হামিদুল। বড় ভাইয়ের দেখাদেখি ছোট দুই ভাই ভারোত্তোলন চর্চা শুরম্ন করলেন সেই জিমনেশিয়ামে। ছোট ভাই একরামুল হক রবিবার ভারোত্তোলনের প্রথম দিনে ৫৬ কেজিতে রৌপ্য জেতেন। আরেক ভাই আশরাফুল জাতীয় পর্যায়ে নিয়মিত খেললেও এসএ গেমসের মূল দলে আসতে পারেননি। আর সোমবার ১ ফেব্রম্নয়ারি ৭৭ কেজি ওজন শ্রেণীতে স্বর্ণজয়ী হামিদুল তো এখন ইতিহাস। দারিদ্র্যের এক ধরনের জেদ থাকে। যাতে থাকে টিকে থাকার আগুন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া স্বর্ণ জিতলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা শক্তি যুগিয়েছে হামিদুলকে। স্বর্ণ পদক গলায় ঝুলিয়ে বললেন, আমার শরীরই তো সঞ্চয়। আর তো কিছু নেই। ভারোত্তোলন খেলার সুবাদে সেনাবাহিনীতে ছোট চাকরি করি। ফেডারেশন থেকে মাসিক বৃত্তি পাই। কিন্তু সব টাকাই চলে যায় শরীর ঠিক রাখার জন্য অতিরিক্ত খাবারের খরচ হিসেবে।' এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ের তাৎণিক প্রতিক্রিয়াতে হামিদুল আরও বলেছেন, দেশকে স্বর্ণ এনে দিতে পেরে খুব ভাল লাগছে। এ সাফল্যে আমি স্রষ্টার কাছে দারম্নণ কৃতজ্ঞ।' এরপর নিজের অর্থকষ্টের কথা বলেছেন অবলীলায়। 'আমার কোন সঞ্চয় নেই। যা আয় করি, চলে যায় শরীর ঠিক রাখতেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুরস্কার ঘোষণা ও ব্যক্তিগত উৎসাহ বিরাট অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে'।
হামিদুলের এই সাফল্য হঠাৎ আলোর ঝলকানি নয়। দুই বার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে ওর তথা দেশবাসীর ও ভারোত্তোলন ফেডারেশনের। ২০০৪ সালে ইসলামাবাদ এসএ গেম স্ন্যাচে পরিষ্কার এগিয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু কিন এ্যান্ড জার্কের হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শুরম্ন হলো বমি। তাইতো কোনরকম রৌপ্য নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হলো। ২০০৬ সালে কলম্বো আসরে একই ইভেন্টে পেয়েছেন ব্রোঞ্জ। দান..দান তিনবার। অবশেষে তৃতীয়বারের চেষ্টায় সফল হলেন অধ্যবসায়ী হামিদুল। ছোটভাই একরামুল যে জায়গায় গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, হামিদুল ঠিক সেখানে অর্থাৎ কিন এ্যান্ড জার্কে অনেক ভাল করেছেন। সে কারণেই তাঁর স্বর্ণ জয়ে কোনই সমস্যা হয়নি। স্ন্যাচে ১১৭ কেজি তোলা হামিদুল ছিলেন দ্বিতীয়। আর জার্কে ১৪০ কেজি তুললে মোট ২৫৭ কেজি তুলে চলে যান সবার আগে।
আগের দিন একরামুলের যে পরিণতি হয়েছিল, সোমবার ৭৭ কেজি ওজন শ্রেণীতে একই পরিণতি হয়েছে বাংলাদেশেরই আরেক ওয়েটলিফটার মনোরঞ্জন রায়ের। স্ন্যাচে হামিদুলের চেয়ে ৩ কেজি ওজন বেশি তুলে প্রথম ছিলেন মনোরঞ্জন। কিন্তু জার্কে ১৩৫ কেজির বেশি তুলতে না পারায় ২৫৫তে থমকে দাঁড়ান। আর সে কারণেই শেষ পর্যনত্ম রৌপ্য পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আর আফগানিসত্মানের মোসত্মফা কামারা স্ন্যাচ (৯০) আর জার্ক (১১০) মিলে ২০০ কেজি তুলে পান ব্রোঞ্জ। ভারত্তোলন ফেডারেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার মতো শক্তিশালী দেশ এই ইভেন্টে এন্ট্রি দেয়নি। দুই বাংলাদেশী আর একজন আফগান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এই ইভেন্টের জন্য। আটটি ক্যাটাগরির ওয়েটে ছয় জন খেলোয়াড় অংশ নিতে পারবেন। সেেেত্র ভারত, পাকিসত্মান, শ্রীলঙ্কা ৭৭ কেজি ওজন শ্রেণী বাদ দিয়ে অন্য ক্যাটাগরিতে অংশ নিয়েছে।
ছেলেবেলায় এক দুর্ঘটনায় হামিদুল চোখে আঘাত পান। তারপর থেকে ডান চোখে কম দেখেন। তারপরও দমে যাননি তিনি। ভারোত্তোলনে হামিদুলের হাতেখড়ি যার কাছে সেই শিা গুরম্ন মোয়াজ্জেম হোসেন এসেছিলেন সোমবার জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জিমনেশিয়ামে। দেরিতে পেঁৗছানোর কারণে স্বামীর স্বর্ণজয় কাছ থেকে দেখতে পারেননি স্ত্রী রাহেলা। দুপুর দুইটায় দুই ছেলে রাসেল (১২) ও রোহানকে (৬) নিয়ে যখন পেঁৗছান তখন খেলা শেষ হয়ে গেছে। খেলা শেষে শিষ্যের কৃতিত্বে কেঁদে ফেলেন শিা গুরম্ন মোয়াজ্জেম হোসেন। সেই ১৯৮০ সাল থেকে ভারোত্তোলনে প্রশিণ দেন তিনি। এবার তাঁর এক ছাত্র স্বর্ণ জিতে নিলেন এসএ গেমসে। এত আনন্দ তিনি রাখবেন কোথায়? খুশিতে ঝলমল ভারোত্তোলন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক উইং কমান্ডার (অব) মহিউদ্দিন আহমেদ। তেমন আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলেও তিনি ভারোত্তোলকদের জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। আবেগে সিক্ত হামিদুলের আরেক কোচ ফারম্নক সরকার কাজলও। কারণ ১৯৯৫ সালে জাতীয় দলে যোগ দেবার পরে এই মানুষটিকে হামিদুল পেয়েছেন কোচ হিসেবে।
একজন ভারোত্তোলকের হাত ধরে পদক তালিকার বাংলাদেশের নামের পাশে প্রথম স্বর্ণপদক লেখা হলো সোমবার। সেই সঙ্গে কেটে গেছে গেমসের প্রথম তিন দিনের স্বর্ণ না জেতার হতাশা। যার সাফল্যের সুবাদে এত কিছু তাঁকে নিয়ে চলেছে খেলা শেষে বিসত্মর মাতামাতি। তাৎণিকভাবে বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন (বিওএ) মহাসচিব কুতুবউদ্দিন আহমেদ ফুলেল শুভেচ্ছায় অভিনন্দিত করেছেন হামিদুলকে। মুখে বলেছেন, 'অভিনন্দন হামিদুল। দেশের প্রতি তোমার দায়বদ্ধতা সবাইকে আনন্দিত করেছে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে আগামী এর চেয়ে বড় গেমসে আমরা সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পারবো।'
খেলা শেষে ক্যামেরার ফ্যাশ ঝলকে উঠছিল উপচে পড়া খুশীর মতো। চারিদিকে সাংবাদিকদের কত জিজ্ঞাসা হামিদুলকে ঘিরে। এমন এক বিকেলের স্বপ্ন ১৮ বছর ধরে মনের মধ্যে সাজিয়ে রেখেছিলেন হামিদুল। ১৯৯২ সালে ভারত্তোলন চর্চা শুরু করেন এই তরুন। তাইতো সোমবার আবেগভরে বলে ওঠেন,'আমি গরীব ঘরের ছেলে। সেভাবে লেখাপড়া করতে পারেনি। মনে আশা ছিল ভারত্তোলনের কারনে একদিন আমাকে সবাই চিনবে। পত্রিকায় লেখালেখি হবে। আমার কাছে এই স্বর্ণ জয়ের গুরুত্ব যে কত তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।' নিজেকে চেনানোর এমন গোপন বাসনা তাহলে এতদিন সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন হামিদুল মনের গোপন কুটিরে ? ছিল কি কোন আপে তার জন্য ? হামিদুল বলে ওঠেন, 'না না আমি জানতাম আমি জিততে পারলে আমাকে নিয়ে হৈ চৈ হবে। তাই তো খেলা থাকুক না থাকুক, অবিরাম পরিশ্রম করেছি এই দিনটির জন্য।'

No comments

Powered by Blogger.