এবার বাহাত্তরের সংবিধান _ ____________________________________________ *৫ম সংশোধনী মামলার লিভ টু আপীল খারিজ * বহাল রইল হাইকোর্টের দেয়া ৫ম সংশোধনী বাতিল রায় * দেশের সর্বোচ্চ আদালত মোশতাক-সায়েম-জিয়া সরকারকে অবৈধ হিসেবে রায় দিল _____________________________________________________ by বিকাশ দত্ত

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরম্নদ্ধে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও জামায়াতপন্থী তিন আইনজীবীর লিভ টু আপীল খারিজ করে দিয়েছে আপীল বিভাগ। এর ফলে দেশ এখন '৭২-এর সংবিধানের মূল নীতিতে ফিরে যাবে।
রায় ঘোষণার সময় কিছু পরিবর্তন থাকবে বলে কোর্ট জানিয়েছে। সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে এই লিভ টু আপীল খারিজ হয়ে যাবার ফলে বহাল থাকল হাইকোর্টের দেয়া ৫ম সংশোধনী বাতিল রায়। হাইকোর্টের এই রায় বহাল থাকার ফলে অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে ১৯৭৫ পরবতর্ী সামরিক সরকার এবং ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া সরকার। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ অবধি সরকার অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এবং আইনজ্ঞদের মতামত হচ্ছে, এ রায়ের ফলে দেশ ১৯৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাবে। এবং দেশে সামরিক শাসনের বৈধতা দেবার পথ রম্নদ্ধ হলো। এই রায়ের ফলে মোশতাক, সায়েম ও জিয়াউর রহমানের শাসনামল অবৈধ হিসেবে ঘোষিত হলো।
লিভ টু আপীল খারিজের পর আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, এ রায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় একটি মাইলফলক। আইন কমিশনের মতামত নিয়ে '৭২ সালের মূলনীতিতে ফিরতে প্রয়োজনীয় পদৰেপ নেবে সরকার। সাধারণ আইনজীবীদের মতামত, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী, মামলার রায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে যুগানত্মকারী ভূমিকা পালন করবে।
মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকেই ১ নম্বর বিচারকৰে আইনজীবী সাংবাদিকরা উপস্থিত হন। এ সময় সবার মধ্যে ছিল উত্তেজনা। ১০টা ১৫ মিনিটের সময় বিচারকৰে বিচারপতিরা উপস্থিত হন। ৫ সেকেন্ডের মধ্যে প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম পিনপতন নীরবতার মধ্যে আদেশ পড়ে শোনান। প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে অন্যান্য বিচারপতিদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি মোঃ ফজলুল করিম, বিচারপতি এম এ মতিন, বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি বিজন কুমার দাস ও বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। লিভ-টু-আপীলের আদেশ পাবার পর সরকার ও আপীলকারীর পৰের আইনজীবীরা পৃথক পৃথকভাবে সাংবাদিকদের ব্রিফিং প্রদান করেন। টিএইচ খান বলেছেন, সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেই লিভ টু আপীল গ্রহণ করেনি আদালত। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, এ রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিজয়।
সামরিক সরকারকে বৈধতা দিয়ে ১৯৭৭ সালের ৭ নবেম্বর মার্শাল ল রেগুলেশন (এমএলআর) চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেয়। সে দিনই রায় স্থগিতের আবেদন জানায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। বিচারপতি এবিএম খায়রম্নল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ বলে ঐতিহাসিক রায় দেয়। বর্তমান মহাজোট সরকার হাইকোর্টের রায় স্থগিতে আবেদন প্রত্যাহার করে নেয়। ৩ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সরকারের আপীল আবেদন প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করে। এরপর ৫ জানুয়ারি পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে চেম্বার জজের কাছে আবেদন করেন দেলোয়ার। তবে তিনি এ বিষয়ে কোন আদেশ না দিয়ে শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করে আবেদনটি আপীল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পাশাপাশি বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক তিন আইনজীবীর দু'টি আপীল আবেদন (লিভ টু আপীল) শুনানির জন্য ১৮ জানুয়ারি নির্ধারণ করেন। ৬ দিন শুনানি শেষে মঙ্গলবার আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আদেশ প্রদান করে। আদেশে আবেদনকারীদের লিভ টু আপীল খারিজ করে দেন। আপীল খারিজ হবার পর আইনজীবীরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
টিএইচ খান : বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের আইনজীবী টিএইচ খান তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেই আদালত লিভ টু আপীল গ্রহণ করেনি। তবু হতাশার মধ্যেও আলো দেখতে পাচ্ছি।
আদালত উচ্চারণ করেছে, সংশোধনীর কথা। এটা হতাশা থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছে। কী সংশোধন হবে জানি না। আমাদের যুক্তির যথার্থতা জোট বুঝতে পেরেছে। আশা করব আমাদের যুক্তিগুলো রায়ে প্রতিফলিত হবে।
মাহবুবে আলম : এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদেশের পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, এ রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিজয়। আপীল বিভাগ লিভ টু আপীল খারিজ করেছে। তাদের রায়ে কিছু সংশোধনী ও পর্যবেৰণ থাকবে বলে জানিয়েছেন। রায়ে সবচেয়ে বড় কথা ছিল সংবিধানে সামরিক সরকার বলতে কিছু নেই। পৃথিবীর সভ্য যে দেশগুলোতে মার্শাল ল নেই সেগুলোর কাতারে উঠতে পারলাম। এই রায় ভবিষ্যতে কোন অসংবিধানিকভাবে ৰমতা দখল প্রশমিত হবে। আশা করি আপীল বিভাগ তাদের আবেদন খারিজ করায় হাইকোর্টের রায়ই বহাল থাকবে। সংবিধানের চারটি সত্মম্ভ জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেৰতা ও সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে হাইকোর্ট বিভাগ যে জোরালোভাবে রায়ে বলেছে, আশা করি তা থাকবে।
ড. এম জহির : বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. এম জহির তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, এই আদেশের ফলে মূলত দেশ '৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাবে। আপীল বিভাগ আবেদনকারীদের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। আপীল বিভাগ দু'পৰের কথা বিশদভাবে শুনেছে। এরপর লিভ দেয়া উচিত হবে না। আমরা জানি আমরা কোথায় আছি। আশা করছি '৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাব। যদিও আপীল বিভাগ কিছু সংশোধন ও পর্যবেৰণের কথা বলেছে। রায়টা কতটুকু বদলিয়েছে না দেখে বলা যাবে না। তবে আমরা মূলত '৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাব।

ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম
বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এখন '৭২ সালের সংবিধানে ফিরতে কোন বাধা নেই। আমাদের সংবিধানের যে মূলনীতি এবং আদর্শ তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ৰেত্রে কোন বাধা বিদ্যমান নেই। আপীল বিভাগের আদেশের ফলে দেশে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তিনি বলেন, আলস্নাহর হাজার শুকুর নিজের চোখে এই আদেশ দেখতে পেলাম। সংবিধানকে যে অপমান করা হয়েছে এই রায়ের মাধ্যমে তা পরিশুদ্ধ করা হয়েছে। কোন অবস্থাতেই সংবিধান বহিভর্ূত কোন কাজ বৈধ হবে না। পঞ্চম সংশোধনী যে কারণে বাতিল হয়েছে, একইভাবে ৭ম সংশোধনীও বাতিল করতে হবে। আমি আশা করছি এই আদেশের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো অবৈধভাবে কেউ ৰমতা দখল করতে পারে না। আমি আদালতের কাছে কৃতজ্ঞ। আদালতের আদেশে পর্যবেৰণের কথা বলা হয়েছে। পর্যবেৰণ আমরা দেখব। সংবিধানের যে সমসত্ম ধারা উপ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন হলো তা দেখতে চাই দ্রম্নত। তিনি আরও বলেন, হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে এটা যথার্থ। এটা সংসদে যাবার প্রয়োজন নেই। মন্ত্রিপরিষদের সভায় সিদ্ধানত্ম হতে পারে। আপীল বিভাগ যখন আবেদনকারীদের আবেদন খারিজ করল তখন হাইকোর্টের রায়ই থাকল। সে কারণেই সংসদে না গিয়ে সংবিধান পুনমর্ুদ্রণ করা যাবে।

ড. শাহদীন মালিক
বিশিষ্ট আইনবীদ ড. শাহদীন মালিক তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে জনকণ্ঠকে বলেছেন, সম্পূর্ণ রায়ে কিছু পরিবর্তন ও পর্যবেৰণ থাকবে। সেটা পেয়ে চূড়ানত্ম মূল্যায়ন করা যাবে। যেহেতুই আবেদনকারীদের সব আবেদন খারিজ হয়েছে, যেহেতু সাধারণভাবে নিঃসন্দেহে বলা যায় হাইকোর্টের রায় বহাল থাকল।
তিনি আরও বলেন, এর ফলে সামরিক আইন কোন ক্রমে কোন অবস্থাতেই বৈধ হতে পারে না। এবং সংসদও এর বৈধতা দিতে পারে না। সেটা এ রায়ে চূড়ানত্মভাবে বহাল হলো। আমার আশা থাকবে এর ফলে আমরা আর কখনও কোন অজুহাতে সামরিক আইনের কবলে পড়ল না। এবং বাংলাদেশ সব সময়ই গণতন্ত্র, সংবিধান ও আইনের শাসনের নিরিখে পরিচালিত হবে।

এ এফ হাসান আরীফ
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরীফ বলেছেন, যেহেতু সংশোধনী ও পর্যবেৰণে কথা বলা হয়েছে, সেহেতু রায় না দেখে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা যাবে না।

শ ম রেজাউল করিম
সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, এই রায় বিচার বিভাগের ইতিহাসে স্বর্ণালি অধ্যায়ের সূচনা করেছে। অবৈধভাবে ৰমতা দখল ও সংবিধান লঙ্ঘন করে ইচ্ছামাপিক আইন প্রণয়ন করে ৰমতায় টিকে থাকার স্বৈরাচারী প্রক্রিয়াকে বন্ধ করবে।

হাইকোর্টের রায় কেন ঐতিহাসিক
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বিচারপতি এবিএম খায়রম্নল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের দ্বৈত বেঞ্চ পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। হাইকোর্টের ঐ রায়ে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যনত্ম খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের শাসনকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। তবে আদালত ওই সময়ে জনস্বার্থে সরকারের বেশকিছু বেআইনী কাজকে মওকুফ করে দিয়েছিল। হাইকোর্ট আলোচিত রায়ে বলেছিল সামরিক আইন সামগ্রিকভাবে অবৈধ ও অসাংবিধানিক এবং সামরিক আইনের অধীনে করা সব কার্যক্রম আইন ও বিধিও অবৈধ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যনত্ম সরকার পরিবর্তন সংবিধান সম্মতভাবে হয়নি বলে হাইকোর্টের ওই রায়ে অভিমতে বলা হয়। হাইকোর্টের রায়ে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে সামরিক আইন বলে কোন আইন নেই। এবং সামরিক কতর্ৃপৰ বলতে কিছু নেই। সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি সামরিক আইন ঘোষণা করে সে প্রজাতন্ত্রের বিরম্নদ্ধে চরম রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে দাবি হবে। শুধু উর্ধতন কতর্ৃপৰের আদেশ মান্য কোন অজুহাত হবে না। অনুচ্ছেদ ১২ অনুযায়ী ধর্মনিরপেৰতা নীতি বাসত্মবায়নের জন্য ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা খ) রাষ্ট্র কতর্ৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যদা দান। গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধমর্ীয় অপব্যবহার ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হবে।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং তিন আইনজীবীর আবেদন খারিজ হবার পর দেশ এখন '৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাবে। ইতোমধ্যে আইনমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, আইন কমিশনের মতামত নিয়েই সংবিধান সংশোধন কিংবা সংসদের কাছে উপস্থাপন করার প্রয়োজন হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.