ভারতের সঙ্গে কী গোপন চুক্তি করেছি তা প্রকাশ করম্নন- খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনার চ্যালেঞ্জ ।। সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্ব

বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারত সফরকালে কী গোপন চুক্তি করেছি তা জনসম্মুখে প্রকাশ করম্নন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, দেশের স্বার্থ ও জনগণের ইজ্জত রৰা করেই ভারত সফর করেছি।
সকল চুক্তিই হয়েছে প্রকাশ্যে, কোন গোপন চুক্তির প্রশ্নই ওঠে না। মিথ্যা ও অসত্য বক্তব্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রানত্ম করতে চাইছেন কেন?
বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তরপর্বে স্বতন্ত্র দলীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফজলুল আজিমের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ৰমতায় থাকতে ভারতপ্রীতি আর বিরোধী দলে গেলে ভারতবিরোধী_ এটাই বর্তমান বিরোধী দলের নীতি। '৯১ থেকে '৯৬ পর্যনত্ম ৰমতায় থাকার সময় ভারতে গিয়ে গঙ্গার পানি সমস্যা সমাধানের কথা বলতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভুলেই গিয়েছিলেন। আমাদের দেশপ্রেম এবং দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ রয়েছে বলেই ভারতে গিয়ে দেশের সমস্যাগুলো তুলে ধরতে ভুলে যাইনি। সকল ৰেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সন্ধানের ব্যাপারে আমরা ঐকমত্য হয়েছি।
গোপন চুক্তির বিরোধী দলের অভিযোগকে বল্গাহীন মিথ্যাচার উলেস্নখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "ভারত সফরকালে আমরা যে যৌথ ইশতেহারে স্বাৰর করেছি তা আগেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধানত্ম নিয়েছি। সেখানে সকল চুক্তিই প্রকাশ্য স্বাৰরিত হয়েছে। আমরা চুক্তি করলাম, নিজেরাই জানলাম না কী গোপন চুক্তি করলাম! অথচ বিরোধী দল জেনে গেল। বিরোধী দল যদি গোপন চুক্তির কথা জেনেই থাকে, তবে জনসম্মুখে তা প্রকাশ করছে না কেন? কী গোপন চুক্তি করলাম তা জনসম্মুখে প্রকাশ করম্নক। আমাদের দ্বিধা নেই। না পারলে এমন মিথ্যা ও অসত্য বক্তব্য দিয়ে জনগণকে কেন বিভ্রানত্ম করা হচ্ছে?
নির্ধারিত বিকেল ৩টায় স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরম্ন হয়। প্রশ্নোত্তরপর্বে প্রথম ৩০ মিনিট ছিল প্রধানমন্ত্রীর উত্তরদানের জন্য নির্ধারিত। প্রধানমন্ত্রীর উত্তরদানের জন্য নির্ধারিত পাঁচটি প্রশ্নের মধ্যে তিনটিই ছিল বিএনপি ও জামায়াত সংসদ সদস্যদের। সংসদে অনুপস্থিত থাকায় বিএনপির দু'জন ও জামায়াতের অপর সংসদ সদস্যদের লিখিত প্রশ্নটি উত্থাপন করা হলে প্রধানমন্ত্রী তাঁর উত্তর দেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর ৩০ মিনিট প্রশ্নোত্তরপর্বটিই ছিল তাঁর ভারত সফর নিয়ে।
সরকারী দলের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণৰমতার ৪০ ভাগ ও মংলা বন্দরের ধারণৰমতার ১০ ভাগও আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। এ দুটো বন্দর সংস্কারের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করার পর নেপাল, ভুটান ও ভারত ব্যবহার করলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, আর্থিকভাবে দেশ লাভবান হবে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। এ লৰ্যে দ্রম্নত ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যনত্ম মহাসড়ক ৪ লেন নির্মাণ করা হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যনত্ম রেললাইন ও নৌপথগুলো সচল করা হবে। এ বন্দর দু'টি থেকে বর্তমানে যে রাজস্ব আদায় হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশগুলো ব্যবহার করলে রাজস্ব আয় দ্বিগুণেরও বেশি হবে।
জাসদের মঈনউদ্দিন খান বাদলের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, এ দু'টি বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার আগে অবশ্যই এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হবে। ভারত এৰেত্রে সহযোগিতা করবে। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে থাকা সমস্যাগুলো সমাধানে নির্দিষ্ট কোন টাইমফ্রেম নির্ধারিত না হলেও কাজ ইতোমধ্যে শুরম্ন হয়ে গেছে। অতিদ্রম্নত যাতে সমাধান হয় সে উদ্যোগ নিচ্ছি।

ভারত সফরে দেশের স্বার্থরৰা
ভারত সফরে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রৰা হয়েছে_ জামায়াতের অনুপস্থিত সংসদ সদস্য এএইচএম হামিদুর রহমানের আযাদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, এ সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ৰেত্রে নতুন দিগনত্মের সূচনা হয়েছে। এ সফরের বিশেষ দিক হচ্ছে, এ অঞ্চলের দেশগুলোর ভৌত ও অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং যোগাযোগ ৰেত্রে কার্যকর সংযোগ স্থাপন। এ সংযোগ নেপাল-ভুটান-ভারতের সঙ্গে যেমন, তেমনি মিয়ানমারের সঙ্গেও এবং আর সম্প্রসারিত অর্থে দৰিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সঙ্গে রচিত হবে। তিনি বলেন, সফরের পুরো সময়ে উভয় দেশের পারস্পরিক শ্রদ্ধার প্রকাশ ও সৎ প্রতিবেশী হিসেবে সমতা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ছিল লৰণীয়।
তিনি বলেন, এ সফরে সহযোগিতার যে সকল ৰেত্র চিহ্নিত হয়েছে এবং বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে যে সিদ্ধানত্ম হয়েছে তা বাসত্মবায়ন করলে উভয় দেশের জনগণ উপকৃত হবে। উভয় দেশের জনগণের কল্যাণে এ সহযোগিতার ধারা অব্যাহত থাকবে এবং এর মাধ্যমে দৰিণ এশিয়া অচিরেই একটি সমৃিদ্ধশালী অঞ্চলে পরিণত হবে।
তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ভাষা ও সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠতার কারণে আমাদের সম্পর্ক প্রগাঢ়। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন সহায়তা ও স্বাধীনতাপরবতর্ীকালে সহযোগিতা এ বন্ধুত্বকে বিশিষ্টতা প্রদান করেছে। তিনি বলেন, দণি এশিয়ার এ বৃহত্তম প্রতিবেশী অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত েেত্র ইতোমধ্যেই প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছে। এ সফরের সময় আনুষ্ঠানিক আলোচনা ও বৈঠককালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সকল দিক বিসত্মারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। বহুদিনের আলোচিত ও অমীমাংসিত অধিকাংশ বিষয়ে আমরা সিদ্ধানত্ম নিতে পেরেছি। সকল েেত্র আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সন্ধানের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে।

বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক
ভারত সফরকালে সম্পাদিত দ্বিপাৰিক বিভিন্ন চুক্তি, সমঝোতা স্মারকের বিসত্মারিত উলেস্নখ করে শেখ হাসিনা জানান, ভারত সফরকালে তিসত্মা ও অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। অতি শীঘ্রই যৌথ নদী কমিশনের মন্ত্রী পযর্ায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের নদীগুলোর নাব্য বৃদ্ধির জন্য নদী খননের উদ্দেশ্যে ভারত ড্রেজার সরবরাহের মাধ্যমে সহায়তা করার অঙ্গীকার করেছে। টিপাইমুখে বাঁধ প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আবারও আশ্বাস দিয়েছেন, বাংলাদেশের জন্য ৰতিকর কোন কার্যক্রম ভারত গ্রহণ করবে না।
তিনি জানান, বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বাস, রেল-ইঞ্জিন ও রেল-কোচ ক্রয়, সৈয়দপুর রেল ওয়ার্কশপের উন্নয়ন, নদী খনন কাজসহ নানাবিধ প্রকল্পের জন্য ভারত এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদু্যত দেবে। এজন্য গ্রিড সংযোগের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কার্যক্রম ইতোমধ্যেই শুরম্ন হয়েছে। তিন বিঘা করিডোরের মাধ্যমে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বিদু্যত সরবরাহের জন্য কার্যক্রম শুরম্ন হয়েছে।
নিরাপত্তা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী জানান, দুই দেশের জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য বাংলাদেশ ও ভারত পরস্পরকে সহযোগিতা করতে একমত হয়েছে। নিরাপত্তার ৰেত্রে দুই দেশই সব ধরনের সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা, জঙ্গীবাদ দমনে একে অপরকে সাহায্য করার জন্য দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। তিনি বলেন, এক দেশের ভূখ- ব্যবহার করে বিদেশী কোন সন্ত্রাসী বা জঙ্গী সংগঠনকে কোন কার্যক্রম পরিচালনা না করতে দেয়ার ব্যাপারও পরস্পরকে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এতে দৰিণ এশিয়ার আস্থার পরিবেশ যেমন সৃষ্টি হবে, তেমনি সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম ও সন্ত্রাস নিমর্ূলে অধিকতর সাফল্য লাভ করা যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
সীমানত্ম সমস্যা সমাধান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী সংসদকে জানান, ১৯৭৪ সালে ভারতের সঙ্গে স্বাৰরিত ঐতিহাসিক ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির আলোকে সব সীমানত্ম সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে ঐকমত্য পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে শীঘ্রই কর্মকর্তা পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াতের সুযোগ সৃষ্টি ও ভারতীয় জনগণের চলাচলের জন্য ভারত শীঘ্রই তিন বিঘায় একটি ফাইওভার তৈরির কাজ শুরম্ন করবে। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকরাও করিডোর ব্যবহার করতে পারবে। তিনি জানান, সীমানত্মে প্রাণহানি রোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়েও আলোচনায় উলেস্নখ করা হয়েছে।
বাণিজ্য বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দু'দেশের বাণিজ্য প্রসারে সকল প্রকার শুল্ক, অশুল্ক বাধা দূরীকরণের ব্যবস্থাসহ ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য আরও অধিকহারে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। ত্রিপুরা-বাংলাদেশ সীমানত্মে রামগড়-সাবরম্নম ও মিজোরাম-বাংলাদেশ সীমানত্মে দেমাগিরি-তেগামুখ শুল্ক বন্দর চালু করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ভারত সরকার ভুটান-নেপালের পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশ সীমানত্মের দু'শ' মিটার অভ্যনত্মরে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে।
সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জানান, সমুদ্রসীমা নির্ধারণে উভয়পৰ আলোচনা ও জাতিসংঘ সমুদ্র আইন কনভেনশনের বিধানের আলোকে সালিশের মীমাংসায় পৌঁছানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে বলে দু'দেশই সম্মত হয়েছে।

গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ
সরকারী দলের সামশুল হক চৌধুরীর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে কম্পিউটারাইজড কন্ট্রেনার টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা সিটিএমএস এ বছরের মধ্যেই চালু করার ব্যবস্থা নেবে সরকার। এটা চালুর ফলে ম্যানুয়্যালের পরিবর্তে সবকিছুই ডিজিটালাইজড হবে। ফলে কন্ট্রেনার খালাশ হবে দ্রম্নত, জ্যাম থাকবে না, দুনর্ীতিও হবে না।
মূল প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা জানান, বাংলাদেশের সুবিধাজনক স্থানে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই পরিচালনা করা হয়েছে। জাপানভিত্তিক আনত্মর্জাতিক একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এটা করেছে। তিনি জানান, রিপোর্টের ভিত্তিতে সোনাদিয়া দ্বীপকে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের স্থান নির্ধারণ করেছে অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি। এছাড়াও দেশের অর্থনীতির গতি ত্বরান্বিত করতে দেশের সকল অভ্যনত্মরীণ নৌ-বন্দরগুলোর সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
বেগম নূর আফরোজ আলীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, একই প্রশ্নপত্রে দেশব্যাপী প্রাথমিক পর্যায়ে সমাপনী পরীৰা গ্রহণ করা হয়েছে এবং বিনামূল্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সত্মরের পাঠ্যপুসত্মকে বিতরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বিনামূল্যের পাঠ্যপুসত্মক যথাসময়ে মুদ্রণ করে বিতরণ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.