মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর...

ড. মাহফুজ পারভেজ: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, বিলাত প্রবাসী গোলাম মুরশিদ ‘মুক্তিযুদ্ধ তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন বেশ ক’বছর আগে। ইতিহাস একেবারেই নিরপেক্ষ হয় না; কারণ যারা ইতিহাস লেখেন তারাও নিজের অবস্থান ও চিন্তার জায়গাটি পুরোপুরি বর্জন করতে পারেন না লেখার মধ্যে। ফলে লেখকের মানসছায়া যে কোন রচনায় অল্প-বিস্তর থাকতে বাধ্য। তথাপি মাইকেল মধুসূদনের বিখ্যাত জীবনী ‘আশার ছলনে ভুলি’-র লেখকের হাতে বাংলাদেশের ইতিহাস, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেননা তিনি লেখেন প্রাঞ্জল ভাষায়, যুক্তিনিষ্ঠভাবে। বইটির বিশেষ গুণ হলো, বিবরণ আর তথ্য। বিশ্লেষণ একজন সাহিত্যের লেখকের কাছে বহুমাত্রিক হতে পারে না। সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের নানা মাত্রাকে স্পর্শ করতে পারে না। যেমন পেরেছে ভ্যান সেনডালের ‘হিস্টরি অব বাংলাদেশ’। মনে রাখা ভাল, আজকাল ইতিহাস ও রাজনৈতিক বিষয়ের আলোচনায় সমাজতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান, নারী, প্রান্তিক জনগণসহ সকলের কথাই বলতে হয়। মধ্যযুগীয় রাজবিবরণ আর বীরত্ব কাহিনী হাল আমলে ইতিহাস নামে পরিচিত হতে পারছে না। মোরশেদের গ্রন্থ আধুনিক ইতিহাসকে বয়ান করতে গিয়ে বিস্তৃত ক্যানভাসের সাহায্য নিয়েছে। কালক্রমিক বিবরণ দিয়েছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তিনি এনেছেন। সেটা হলো ‘হিন্দুদের দেশত্যাগ’। তিনি কয়েক বারই (পৃ. ৫৩, ৫৭ দ্রষ্টব্য) হিন্দুদের দেশান্তরী হওয়া এবং সামপ্রদায়িক দাঙ্গার কথা লিখেছেন। কিন্তু কেন তারা দেশ ছেড়েছেন, সেটার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দেননি। এখানে রয়েছে অসম্পূর্ণতা। সামপ্রদায়িকতার সমাজতাত্ত্বিক ও আর্থ-সামাজিক কারণ এখানে প্রাসঙ্গিক ছিল। রাজনৈতিক দিক থেকে বইটি ইতিহাসের বহু উপাদানকে জড়ো করেছে। কিন্তু ‘তারপর’ বলতে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আলোকপাতের জায়গাটিতে এসে তিনি বিশ্বায়ন আর একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভবিষ্যৎমুখী একটি রূপকল্প উপস্থাপনের সময় থমকে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কথা তিনি লিখেছেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের সম্পর্কের স্বরূপ কিরূপ হওয়া উচিত, সেটার কোন রূপরেখা নেই। আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিশীলতা ও ডাইনামিক্সের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রভাবনার ভারসাম্য রচনা করাই পরের দাবি। সে দাবি পূরণে জাতীয় নেতৃত্বকে ন্যাশনালিটির অনুসরণ করতে হয়। সেটা বাংলাদেশে কতটুকু হয়েছে কিংবা আদৌ হচ্ছে কি-না, সেটা উহ্য রেখে মুক্তিযুদ্ধে সমকালীন ইতিহাস পরিপূর্ণ হয় না। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অমীমাংসিত বহু বিষয়ের ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক-আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ রচনার প্রয়াস নিতে হবে। মুরশিদের গ্রন্থ সে প্রয়াসকে কিছুটা হলেও প্রণোদনা জাগাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.