চীনের নয়া নেতৃত্বের সামনে অগ্নিপরীক্ষা

চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৭৬ সালের পর থেকে সবচেয়ে আলোড়নময় ও কৌতূহলোদ্দীপক বছরটি পার করেছে গত বছর। ১৯৭৬ সালে জেং জিয়াও পিং সমর্থকদের হাতে পার্টি ও রাষ্ট্রীয় পদ থেকে উৎখাত হয় ‘চার কুচক্রী’ নামে আলোচিত তখনকার চার ক্ষমতাধর ব্যক্তি যাদের মধ্যে মাওপন্থী জিয়াং কিং ছিলেন।
গত বছর একইভাবে ধিক্কৃত হয়ে পার্টি থেকে উৎখাত হয়েছেন মাও অনুগত হিসেবে পরিচিত বো জিলাই। বো জিলাই ছিলেন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চংকিং কমিটির সেক্রেটারি এবং পার্টি পলিটব্যুরো সদস্য। পাঁচ বছর এই দায়িত্ব পালনকালে তিনি সংঘটিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে, কল্যাণমূলক কর্মসূচীর পেছনে ব্যয়বৃদ্ধির করে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি একটানা দুই অঙ্কের ঘরে ধরে রেখে এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লেবের সেই লাল সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের আন্দোলন চালিয়ে চীনা রাজনীতিতে স্বতস্ত্র স্বাক্ষর রেখেছিলেন। এবারের পার্টি কংগ্রেসে স্ট্যান্ডিং কমিটিতে তার আসন প্রায় পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে ওয়াং লি জুনের ঘটনার পর তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের কেলেঙ্কারি অভিযোগ ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত তাকে পার্টি থেকে বের করে দেয়া হয়। এখন তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। বো জিলাইয়ের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। শোনা যায়, তিনি পুরনো ধারার রাজনীতির অনুসারী বলেই নব্য পুঁজিবাদের প্রবক্তাদের হাতে তাকে এভাবে পর্যুদস্ত হতে হয়েছে।
বো কি দুর্নীতিবাজ ছিলেন? তাঁর পরিবার কি অকল্পনীয় ধনী ছিল? সাধারণ মানুষের তা জানা নেই। তারা এসব প্রশ্ন শুনে সø্যাগ করার ভঙ্গি করে। তবে এটাও তো ঠিক যে, চীনের সবচেয়ে ধনবান কিছু লোক হলো পার্টি নেতাদের সন্তান-সন্তুতি।
অবশ্য বো জিলাইয়ের ঘটনাটি এককভাবে ১৯৭৬ সালের সাথে এখনকার চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে তুলনা করার মতো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা নয়। এ বছর হবে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উত্তরণ সম্পন্ন করতে চীনের সামর্থ্য কতটুকু আছে তারই বাস্তব পরীক্ষা। চীন কি তার অর্থনৈতিক অপচয় কমিয়ে আরও উদ্ভাবনীমূলক অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হতে পারবে? চীন কি আইনের শাসনের দিকে যাবে, নাকি সেখান থেকে সরে আসবে? চীন কি আরও ন্যায়ভিত্তিক ও সুষ্ঠু সমাজের দিকে এগিয়ে যাবে নাকি স্বৈরাচারের আশ্রয় নেবে এবং এলিট শ্রেণীর অবারিত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করবে? এ প্রশ্নগুলোই বড় হয়ে দেখা দেবে ২০১৩ সালে।
নয়া নেতৃবৃন্দের কাঁধে উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু সমস্যা চলে এসেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ও নাটকীয় সমস্যা হলো তিব্বত। ২০০৯ সাল থেকে সেখানে আত্মাহুতির সংখ্যা ৯২-এ পৌঁছেছে। তিব্বত প্রশ্নে চীনকে নিতে হবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। নয়া নেতৃত্বের সামনে সেটা হবে মস্ত চ্যালেঞ্জ।
দুর্নীতি প্রশ্নে নয়া নেতা শি জিনপিংকে প্রমাণ দিতে হবে যে তার দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রতিশ্রুতি স্রেফ বাত কা বাত নয় যেমনটি দিয়েছিলেন তাঁর পূর্বসূরিরা। যেমন বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও হুঁশিয়ারি দিয়েছেলেন যে, ক্ষমতাসীনদের পরিবার-পরিজনদের বিত্তশালী হওয়া চলবে না। অথচ পত্রিকার খবর অনুযায়ী ওয়েনের আমলে তারই পরিবার ২৭০ কোটি ডলারের সম্পদ করেছে আর শি জিনপিংয়ের পরিবার বানিয়ে নিয়েছে বেশ কয়েক শ’ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ।
২০১১ সালে ওয়েন জিয়াবাও বলেছিলেন যে, স্বাধীনতা ছাড়া প্রকৃত গণতন্ত্র হয় না, আবার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তা ছাড়া প্রকৃত স্বাধীনতা হয় না। কিন্তু তিনি ১০ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে প্রকৃত স্বাধীনতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বাস্তবে তেমন কিছুই করেননি। প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওও ক্রমবর্ধমান অসম সামাজিক ব্যবস্থার পুনর্ভারসাম্যবিধান করে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই ঘোষণা ঘোষণাই থেকে গেছে।
শি জিনপিং কি তার চেয়ে ভাল কিছু করতে পারবেন? প্রাথমিক লক্ষণগুলো উদারপন্থীদের কাছে আশাব্যঞ্জক মনে হয়নি। ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং আইনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের অবসানের আহ্বান জানিয়ে ৭১ জন বুদ্ধিজীবী গত মাসে আবেদন জানিয়েছিলেন। তাতে কোন সাড়া মিলেনি। বরং আইনের ব্যাপারে সেই পুরনো গীতই গাওয়া হচ্ছে। শি জিনপিং এ যাবত যত ভাষণ দিয়েছেন তাতে আরও শক্তিশালী চীন গড়ে তোলার জাতীয়তাবাদী স্বপ্ন এবং একদলীয় ব্যবস্থা বজায় রাখার ওপরই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
চীনের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের প্রথম পর্যায় শেষ হয়েছে। শুরু হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে অনেক সমস্যা দেখা দেয়ার আশঙ্কা আছে। চীনের বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে বিনিয়োগের যে গুটিকয়েক ক্ষেত্র আছে তা হলো রিয়েল এস্টেট। এ সম্পত্তির বাজার এতই উত্তপ্ত যে, যে কোন সময়ে ফেটে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে গোটা চীনের দুর্বল অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং সঞ্চয়কারী ও বিনিয়োগকারী উভয়ের জন্য এর পরিণতি হবে অতি মারাত্মক। শি জিনপিংয়ের নয়া নেতৃত্ব এসব চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবেল করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
চলমান ডেস্ক

No comments

Powered by Blogger.