তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা

ড. আবুল কালাম আযাদ: চূড়ান্ত বিবেচনায় গণতন্ত্র হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যার লক্ষ্য হচ্ছে সরকারকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করা।
দুর্ভাগ্যবশত এ ব্যবস্থাকে যুগে যুগে এবং দেশে দেশে কলুষিত করা হয়েছে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র প্রণেতাদের অন্যতম James Madison লিখেছেন, “If men were angels, no government would be necessary. It angels were to govern men, neither external nor internal controls on government would be necessary. In framing a government which is to be administered by men over men, the great difficulty lies in this: you must first enable the government to control the governed; and in the next place oblige it to control itself” (মানুষ যদি ফেরেশতা হতো, কোন সরকারের প্রয়োজন হতো না। আবার ফেরেশতা যদি মানুষকে শাসন করতো তবে সরকারের উপর বাইরের বা অভ্যন্তরীণ কোন নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হতো না। মানুষকে শাসন করার জন্য মানুষের দ্বারা সরকার গঠনের সমস্যা হচ্ছে : সরকারকে একদিকে ক্ষমতাবান করতে হবে শাসিতদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। আবার সরকারের ক্ষমতাকেও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে) Madison  জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকার গঠনের সমস্যা ও সমাধানের পথ নির্ণয়ের চেষ্টা করছিলেন। দায়বদ্ধ সরকার গঠনের সমস্যা হলো- মানুষকে শাসন করবে মানুষ। আমরা জানি, শাসন করার জন্য ক্ষমতার প্রয়োজন। কিন্তু ক্ষমতা শুধু কলুষিত করে না, কুক্ষিগতও হয়। যেহেতু মানুষ ফেরেশতা নয় এবং মানুষকে যারা শাসন করে তারাও ফেরেশতা নয়, অতএব শাসন ব্যবস্থা এমন হবে যে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রয়োগের কোন স্তরেই যেন ক্ষমতা কুক্ষিগত হতে না পারে, কোন স্তরেই যেন ক্ষমতা প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণহীন না হয়। আর প্রয়োগ-বাছাই (Trial and error)-এর মাধ্যমে এরূপ ব্যবস্থা গড়ে তোলাই সচেতন নাগরিক সমাজের দায়িত্ব।
শান্তিপূর্ণ পন্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আমাদের দেশে ১৯৯৬ সাল থেকে চালু ছিল। মন্দের ভাল হিসেবে এ পদ্ধতিটি মোটামুটি কার্যকরও প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৬ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে আনার প্রয়াস পেয়েছিল বটে। কিন্তু ২০১১ সালে এসে পুরো ব্যবস্থাটাকেই গিয়ে খাওয়া হয়েছে। শাসন ব্যবস্থা এভাবে কলুষিত করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টার জন্য আমরা বিভিন্ন দল/নেতৃত্বকে দোষারোপ করতে পারি। তবে এটা মানতে হবে যে এগুলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু স্বার্থপর ক্ষমতালোভী মানুষের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রয়াসের বিরুদ্ধে সবল প্রতিরোধ গড়ে তোলাই নাগরিকদের কাজ। এ প্রতিরোধ গড়তে হবে রাস্তায় হানাহানির মাধ্যমে নয় যুক্তিতর্ক, আলোচনা ও সমালোচনার মাধ্যমে। এগুলো হচ্ছে নাগরিকদের সচেতনতার অংশ। আর কে অস্বীকার করবে যে নাগরিকের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্বাধীনতার মূল্যই হচ্ছে সচেতনতা? এরই অংশ হিসেবে আমরা অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক শাসন পদ্ধতির একটি রূপরেখা পেশ করছি, যেটা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করবে। অধিকন্তু আমাদের প্রস্তাবিত ব্যবস্থা দেশের রাজনৈতিক সরকারগুলোকে আরও বেশি পরিচ্ছন্ন ও দায়বদ্ধ করবে।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা
পরিচ্ছন্ন, দায়বদ্ধ ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সরকার ব্যবস্থার প্রথম সোপান হচ্ছে উচ্চ পরিষদ ও নিম্নপরিষদ বিশিষ্ট দ্বিকক্ষ আইনসভা। অন্যকথায়, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের দুটি কক্ষ থাকবে। উচ্চ কক্ষের নাম হবে সিনেট ও নিম্নকক্ষের নাম হবে প্রতিনিধি পরিষদ।
উচ্চকক্ষ বা সিনেট
উচ্চ কক্ষ বা সিনেটের সদস্যগণ সিনেটর হিসেবে পরিচিত হবেন। সিনেটের সদস্য সংখ্যা হবে ১০০ জন। তারা নির্বাচিত হবেন ব্যক্তিগতভাবে সর্বোচ্চ ৫ বছরের জন্য। কিন্তু সিনেটের সব সদস্য একসঙ্গে নির্বাচন করবেন না। সিনেটের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আড়াই বৎসর পর পর। প্রতিবারে অর্ধেক অর্থাৎ ৫০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন। তবে এই সিনেটরগণ কেউ ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচন করবেন না। সিনেটের সদস্য পদের জন্য নির্বাচন হবে দলীয়ভাবে। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজ নিজ দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে। সিনেট নির্বাচনে প্রদত্ত সর্বমোট ভোটে প্রত্যেক দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে রাজনৈতিক দলগুলো সিনেটে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করবে যারা সিনেটর হিসেবে পরিচিত হবেন এবং পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত আইন প্রণয়ন ও অন্যান্য কার্যাবলী সম্পাদন করবেন। বাংলাদেশের আইনসভায় উচ্চ কক্ষ বা সিনেট হবে একটি Perpetual body যা কখনও মেয়াদোত্তীর্ণ হবে না। সিনেটের কার্যাবলী আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে নির্ধারণ করা যেতে পারে। সিনেটররা প্রত্যেকে অনধিক পাঁচটি উপজেলার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিরীক্ষণ করবেন। যখন আইন সভার নিম্নকক্ষ বা প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনের সময় উপস্থিত হবে, তখন সিনেটের সদস্যগণের মধ্য থেকে দলীয় সদস্য সংখ্যার অনুপাতে ৯ বা ১১ জন প্রতিনিধি নিয়ে এদের মধ্যে থেকে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত করে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হবে যারা নিরপেক্ষতার শপথ নিবেন এবং নিম্ন পরিষদের ও সিনেটের অর্ধেক সদস্যের নির্বাচন সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা দিবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে ৯০ দিন।
নিম্নকক্ষ বা প্রতিনিধি পরিষদ
বাংলাদেশের আইন সভার নিম্নকক্ষের নাম হবে প্রতিনিধি পরিষদ (House of Representative)। প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যসংখ্যা বর্তমান জাতীয় সংসদের মতো ৩০০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যেতে পারে। তবে রাষ্ট্রীয় খরচের কথা চিন্তা করে জাতীয় সংসদে বর্তমানে প্রচলিত মহিলা প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা বাদ দিয়ে সিনেটে মহিলাদের ২৫ বা ৫০ শতাংশের প্রতিনিধিত্বের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে। নিম্ন পরিষদের সদস্যগণ সর্বোচ্চ ৫ বৎসরের জন্য নির্বাচিত হবেন। একটি নির্বাচিত নিম্ন পরিষদের অধিবেশন শুরুর প্রথম দিন থেকে আরেকটি নির্বাচিত নিম্ন পরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর। তবে প্রতিটি নিম্ন পরিষদের মেয়াদকাল পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার তিনমাস আগে রাষ্ট্রপতি নিম্ন পরিষদ ভেঙ্গে (dissolve) দেবেন এবং সিনেট থেকে পূর্বে বর্ণিত নিয়মে সদস্য নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবেন। এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন নিম্ন পরিষদের জন্য এবং সিনেটের অর্ধেক সদস্যের জন্য নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবেন। নিম্ন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোট রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে দেশের সরকার গঠন করবে এবং সরকারের কার্যাবলীর জন্য নিম্ন পরিষদের কাছে একক এবং সমষ্টিগতভাবে দায়ী থাকবে।
কেউ একই সময়ে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য হবেন না। কেউ একই নির্বাচিত পদে পরপর দু’বার নির্বাচিত হবেন না এবং সর্বোচ্চ দু’বারের বেশিও নির্বাচিত হবেন না। কোন রাজনৈতিক দল পর পর দু’বার জাতীয় নির্বাচনে মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশের কম ভোট পেলে ওই দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যাবে।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় উত্তরণ (Transition fo bi-cameral legislature):
বর্তমানে আমাদের এক কক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় সংসদ থেকে দ্বিকক্ষ জাতীয় সংসদে উত্তরণ নিম্নবর্ণিত পন্থায় হতে পারে:
বর্তমান জাতীয় সংসদের এবং সরকারের মেয়াদ পূর্তির পূর্বে সিনেটের ৫০ জন সদস্যের নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে (অবশ্যই বর্তমান সরকারের অধীনে) সিনেটের জন্য উপরে বর্ণিত নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করে। এ ৫০ জন সদস্যের মধ্যে থেকেই পূর্বে বর্ণিত পদ্ধতিতে সদস্য নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হবে যারা বর্তমান সরকারের মেয়াদ উত্তীর্ণের পর নিজেদের তত্ত্বাবধানে নতুন নিম্ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। বাংলাদেশের আইন সভার উচ্চকক্ষ বা সিনেটের সদস্যদের মেয়াদ নিম্ন পরিষদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন থেকে একই সঙ্গে শুরু হবে এবং প্রাথমিকভাবে ৫০ জন সদস্য নিয়েই সিনেটের কার্যক্রম চলতে থাকবে। আড়াই বছরের মাথায় বাকি ৫০ জন সিনেটের নির্বাচিত হবেন। তারপর থেকে সিনেট পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করবে এবং নির্ধারিত কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।
গণতন্ত্র চর্চার দিক থেকে প্রস্তাবিত এ পদ্ধতির সুফল অত্যন্ত পরিষ্কার। এ পদ্ধতিতে সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচন তত্ত্বাবধানের জন্য একটি অস্থায়ী প্রশাসন তৈরির পথ অনেকটা বিতর্কমুক্ত হবে। এর ফলে অধুনালুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের উত্থাপিত বৈধতার আপত্তিটি আর বহাল থাকবে না। কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে অহেতুক অচলাবস্থা সৃষ্টির কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণও থাকবে না। অধিকন্তু, প্রতি আড়াই বছর অন্তর সিনেটের অর্ধেক সদস্যের নির্বাচন একটি অস্থায়ী মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে- যার ফলে ক্ষমতাসীন দল আরও বেশি দায়িত্বশীল, গণমুখী ও জনমতের প্রতি সংবেদনশীল হতে বাধ্য হবে।
কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, এ প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে যতই গণতান্ত্রিক, বিতর্কমুক্ত বা রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরোধক হোক না কেন, যারা ক্ষমতায় আছেন বা যারা ক্ষমতায় যাবার স্বপ্ন দেখেন তারা কেউ এ ব্যবস্থাকে খুব ভালো চোখে দেখবেন না। তৎসত্ত্বেও সচেতন নাগরিক সমাজ, সংবাদ মাধ্যম ও সাধারণ জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে রাজনীতিকদের আত্মস্বার্থের পরিবর্তে দেশের জনগণের স্বার্থে পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ, উৎসাহী ও প্রয়োজনে বাধ্য করা। অতএব, সে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক।
abulkalamazad@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.