ঢাকা শহরের যানজট প্রয়োজন মহাপরিকল্পনা- সুভাষ সিংহ রায়

গত বছরের অক্টোবর মাসে মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুরে গিয়েছিলাম শিাবিষয়ক কয়েকটি সেমিনারে অংশ গ্রহণ করতে। এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে গাড়ির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল সেখান থেকে হোটেলে যেতে এক ঘণ্টার মতো লাগবে।
কারণ অফিস সময়ে যানজট হয়। অর্থাৎ পৃথিবীর সর্বত্র যানজট হয়। কিন্তু সব দেশেই একটি সহনীয় মাত্রা আছে কিন্তু আমাদের দেশে যানজট সহ্যের বাইরে। আশির দশকের দিকেও ঢাকাকে বলা হতো 'তিলোত্তমা নগরী।' এখনকার ঢাকা খুবই বিরক্তিকর এবং অসহ্য। বিদগ্ধ পাঠক মাত্রই জানেন কবিগুরম্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট দুইবার ঢাকায় এসেছিলেন। প্রথমবার ১৮৯৮ সালে আর দ্বিতীয়বার ১৯২৬ সালে। দ্বিতীয়বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সেই সময়কার প্রভোস্ট অধ্যাপক আর সি মজুমদারের আমন্ত্রণে জগন্নাথ হলে এসেছিলেন। যেদিন তিনি পুরনো ঢাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রমনা এলাকায় এলেন তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বিশিষ্ট লেখক গোপাল চন্দ্র রায় তাঁর 'ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন এইভাবে। "রমেশবাবু বলেন, কবি প্রথমদিন রমনায় আমার বাসার কাছে এস গাড়ি থেকে নামবার সময় বললেন_যেখান থেকে এলাম ও জায়গাটা ঢাকা, আর তোমার এখানটা ফাঁকা।" (পৃষ্ঠা নং ৬৭ ) তারপরও ৭০ দশকে ঢাকা শহরের যে অবস্থা ছিল তা পুরনো দিনের রাজ্জাক-কবরীর প্রথম দিককার সিনেমা দেখলে বোঝা যায় কি সুন্দর ছিল আমাদের এই ঢাকা শহর। কবি গুরম্ন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'ইতিহাস তো যাত্রার পালা গান করা নয় যে, ষোলো বছরের ছোকরাকে পাকা গোঁফদাড়ি পরিয়ে দিলেই সেই মুহূর্তে নারদমুনি করে তোলা যেতে পারে ।'
যারা ঢাকা শহরে বসবাস করছেন তারা খুব ভাল করেই জানেন কি অবস্থা এই নগরীর। প্রতিদিন যেন হু হু করে বাড়ছে এই শহরের জণসংখ্যা। এই শহরে এলেই কত মানুষ থাকেন সেটা বলা মুশকিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন উন্নয়ন পরিকল্পনার (ডিএমডিপি) প্রাক্কলন অনুসারে ২০১১ সালে ঢাকা জনসংখ্যা এক কোটি ৪২ লাখ আট হাজার। প্রতিদিন এই মহানগরে নতুন করে মানুষ আসছে দুই হাজার ১৩৬ জন। অথচ সড়ক পরিবহন কতর্ৃপরে (বিআরটিএ) হিসাব অনুয়ায়ী ২০০৮ সালের জুন থেকে ২০০৯ সালের জুন পর্যনত্ম ৩৭ হাজার ৭০৫টি নতুন গাড়ি যুক্ত হয়েছে। এই সবই হচ্ছে আমাদের জন্য ভীষণ খারাপ সংবাদ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটিয়েও দ্রম্নত কোন সমাধান সম্ভব নয়। ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটিয়ে সমস্যার অনেকটা সমাধান সম্ভব। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের কাছে যে পরিসংখ্যান আছে তা কতটুকু সঠিক। আবার এটাও বলা কঠিন, এই মহানগরীতে দিনে কত লোক থাকে আর রাতে কত লোকের অবস্থান। দিনে রাতে পার্থক্য তো আছে। বিশ্বের সব রাজধানী শহরে সেটা আছে। কলকাতায় দিনে যত মানুষ অফিস আদালত করেন তার একটা বড় অংশ কলকাতার বাইরে চলে যান। যারা কলকাতাকে চেনেন তারা ভাল জানেন দিনে কলকাতার এক রকম রাতের কলকাতা আরেক রকম। কলকাতার আশপাশের জেলা শহর থেকে প্রচুর মানুষ কলকাতায় আসেন। অফিস পাড়ায় দিনের বেলায় গেলে এই জাতীয় মানুষের আধিক্য ল্য করা যায়। বিশেষ করে ইন্টারসিটি ট্রেন ব্যবস্থা ওখানে শক্তিশালী থাকাতে দুই ঘণ্টা-তিন ঘণ্টার যাতায়াত ওখানকার মানুষের যেন নিত্যদিনের অভ্যাস। আমাদের দেশে গাজীপুর থেকে ঢাকায় ট্রেনে আসা যাওয়া করতে মানুষ খুব একটা আগ্রহী না। কেননা অপোকৃত বেশি সময় লাগে। তুরাগ নামের যে এক্সপ্রেস ট্রেন চালু হয়েছে তাতে কতটা দুর্ভোগ কমবে সেটা দেখার বিষয়। এই কথা ঠিক ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে যে রেল লাইন গেছে সেটাও ঢাকা শহরে যানজটের জন্য অনেকাংশ দায়ী। কমলাপুর থেকে ক্যান্টনমেন্ট কিংবা এয়ারপোর্ট পর্যনত্ম রেললাইন ঢাকা শহরে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি করে। এই রেললাইন যদি শহরের বাইরে দিয়ে রামপুরার পেছন দিক দিয়ে এয়ারপোর্ট কিংবা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পর্যনত্ম সংযুক্ত করে দেয়া যেত তাহলে যানজটের বেশ কিছুটা লাঘব হতো। এই পরিকল্পনার জন্য খুব বেশি মেধাবী লোকের প্রয়োজন নেই কিংবা খুব বেশি টাকার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
আমাদের বিজ্ঞজনেরা মাঝে মাঝে বিশেষভাবে অজ্ঞ হয়ে যান। মাত্র এক বছরের সরকারের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু আশা করছি। চার দশকের যানজট যেন আলাদিনের চেরাগ দিয়ে ঠিক করে ফেলতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে আমরা চার ভাগে ভাগ করতে পারি । এক. ট্রাফিক এডুকেশন, দুই. ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং, তিন . ট্রাফিক এনভায়রনমেন্ট, চার. ট্যাফিক এনফোরসমেন্ট। আমরা জানি ঢাকার যানজট একটি বহুমাত্রিক সমস্যা। উপরিউক্ত চারটি উপায়ে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। নানাবিধ কারণে তা ঢাকায় বাসত্মবায়ন করা যাচ্ছে না। ঢাকার রাসত্মা আছে মোট জায়গার ৭.৫ শতাংশ। অথচ এই জাতীয় নগরীতে মোট জায়গার ৩০ শতাংশ জায়গায় রাসত্মায় থাকা দরকার। আবার অন্যদিকে এভাবে বলা যায় ঢাকা শহরে যে পরিমাণ বড় রাসত্মা আছে তা অনেক েেত্র লন্ডন শহরেও নেই। এখানে গুরম্নত্বপূর্ণ হচ্ছে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। যারা ইদানীং কলকাতায় গিয়েছেন তারা নিশ্চয় অবাক হয়েছেন সেখানকার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট দেখে। ভাবতে অবাক লাগে কলকাতায় দুর্গা পুজোর সময়ে যে পরিমাণ মানুষ দিনে রাতে রাসত্মায় থাকে তা পৃথিবীর কোন শহরে এত লোক রাসত্মায় থাকে না। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার সম্পাদক দুর্গা পুজোর অষ্টমীর দিনে কলকাতায় গিয়েছিলেন। সাধারণত এয়ারপোর্ট থেকে কলকাতার নিউমার্কেট যেতে ৫০ মিনিট লাগে। সেদিনও এই সম্পাদক একেবারে পাকা ৫০ মিনিটে এয়ারপোর্টে পেঁৗছে গেছেন। কোথাও কোন সিগনালে ২ মিনিটের বেশি দাঁড়াতে হয়নি। আমাদের দেশের ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে যারা আছেন তাঁরা কলকাতার ট্রাফিক বিভাগ থেকে শিা নিতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা সমগ্র ভারতের সব শহরে ট্রাফিক এডুকেশন দারম্নণভাবে ল্য করা যায়। ঢাকা শহরে তো পথচারীদের জন্য কোন পথ নেই; পথে পথে হাউজিং ব্যবসায়ীদের মালামাল ছড়ানো। এখানে ইট, বালি, পাথর, লোহা সমসত্ম মালামাল থাকে সরকারী রাসত্মায়। ট্রাফিক এনভায়রনমেন্ট এবং ট্যাফিক এনফোরসমেন্টের কোন ব্যবস্থা এত নাজুক তা নিয়ে কারোর যেন মাথা ব্যথা নেই। আপনি এখন কলকাতা শহরে ১৫ বছরের আগেকার কোন গাড়ি রাসত্মায় এখন পাবেন না। আমাদের শহরে ৩০ বছরের পুরনো গাড়িও পাওয়া যাবে। আমাদের ঢাকা শহরের টাক্সি ক্যাবগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। ৮০০ সিসি মারম্নতি গাড়ি টাক্সি ব্যবহার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য অনুমতি দেয়া হয়। এই গাড়ির নির্মাতা কোম্পানি বোধহয় এরকম করে কখনই ভাবতে পারেননি। এখানেও সেই হাওয়ার ভবনের দুর্নীতি। আসলে এটা সব সম্ভবের দেশ। প্রতিদিন শত শত গাড়ির চাকা খুলে এদিক ওদিকে ছুটাছুটি করে না এটাই আমাদের ভাগ্য। এই কালো টাক্সিক্যাবগুলো যে যানজটের আরেকটা কারণে তা সবাই জানেন। কেননা টাক্সিক্যাবের চালকরা কোন রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। বিগত দিনগুলোতে ঢাকা নিয়ে কম পরিকল্পনা আমরা করিনি। কিন্তু সব পরিকল্পনা আমাদের মজ্জাগত স্বভাবের মতো ঢাকা পড়ে গেছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রাজধানীর যানজট নিরসনে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পরবর্তী জামায়াত-বিএনপি জোট সরকার তা বাসত্মবায়ন করেনি। কারণ একটাই_এই পরিকল্পনা যেহেতু আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেছিল। ফাইওভারের ডিজাইন পরির্তন করে অহেতুক জটিলতা ও সময়পেণ করেছে। মনোরেলের পরিকল্পনা বিগত আওয়ামী লীগ করে গিয়েছিল। কিন্তু সেটার দিকে বিএনপি সরকার এগিয়ে দেখেনি। এবার জাতীয় টেলিভিশনে স্কুল বির্তক প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থাই সব প্রকার যানজট নিরসন করতে পারে। এখানে স্কুল পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীরা দারম্নণ সব পরিকল্পনার কথা বলেছে। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা এগুলো শুনলে উপকৃত হবেন। এমনকি সামান্য একজন শ্রমজীবী মানুষ এসব নিয়ে ভাবেন। একবার এক রিকশাওয়ালা ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, এই যে দুঃসহ যানজট_কিভাবে রা পাওয়া যায়? উত্তর ছিল বেশ মজার। 'স্যার, আইন পাল্টান। আমরা যারা রিকশাওয়ালা তারা ট্রাফিক সিগনাল না নামলে ট্রাফিক আমাদের দুই চার লাঠির বাড়ি মারেন। আর আপনারা না মানলে ট্রাফিক আপনাদের পাঁচশ' এক হাজার টাকা জরিমানা করেন। আমাদের লাঠির বাড়ি খেতে খেতে আমাদের এসব আর গায়ে লাগে না। আর আপনাদের কাছে পাঁচশ' এক হাজার টাকা কিছুই না। তাই এই আইনটা পাল্টায় দেন। রিকশাওয়ালাকে জরিমানা করেন আর আপনাদের লাঠির বাড়ি মারম্নক তাহলে দেখবেন যানজট কমে যাবে। রিকশাওয়ালা ভদ্রলোক যা ভেবেছেন তার মধ্যে অবশ্যই যুক্তি আছে। আমরা জানি ঢাকার যানজট একটি বহুমাত্রিক সমস্যা। ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার আরেকটি ত্রম্নটি হচ্ছে এখানে আইনের মান্যতা বলে কিছু নেই। পৃথিবীর এই একটি মাত্র শহর যেখানে আইন না মানাটায় যেন একটি আইন। পাশের দেশ ভারতের কলকাতার শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা দেখলে অবাক হতে হয়। কলকাতা শহরের প্রতিটি চার রাসত্মার মোড়ে শব্দযন্ত্রে ক্রমাগত আইনের মান্যতার কথা বলা হয়। কলকাতার ট্রাফিক বিভাগের এই কথামালায় পথচারী পারাপারের সর্তকতাবিষয়ক পরামর্শ থাকে। এবং মানুষের মন ছুঁয়ে যাওয়া কথা থাকে সেখানে। যেমন, সাবধানে রাসত্মা পার হোন; সবুজ বাতি দেখে তারপর চলুন। বাসায় আপনার পরিজনরা আপনার অপোই আছেন। আমাদের ঢাকা শহরে কালেভদ্রে নামকাওয়াসত্মে ট্রাফিক সপ্তাহ পালিত হয়। আমরা কি পারি না রাসত্মার মোড়ে মোড়ে উদ্বুদ্ধকরণ সম্বলিত প্রচারণা চালাতে। এর জন্য শুধু আনত্মরিকতায় যথেষ্ট। এবং আমাদের সেটারই দারম্নণ অভাব। পত্রিকায় চটকদার সমস্যার কথা লেখা হয় কিন্তু সমাধানের কথা লেখেন কয়জন? আওয়ামী লীগ দেশ স্বাধীনের পর সব মিলে আট বছর সরকারের দায়িত্বে ছিল। অনেক সমালোচকদের প্রিয় নেতা কিংবা নেত্রী দীর্ঘকাল ৰমতায় ছিলেন। তখন তাঁরা কি করেছিলেন? তারপরও বলব, যানজট অসহনীয় পর্যায়ে। মানুষ দ্রম্নত মুক্তি চায়। কিন্তু সমস্যা বহুমাত্রিক; সমাধান করতে হবে দ্রম্নত। কিন্তু সবাইকে তো ভাবতে হবে সেটাও কি ১২ মাসে সম্ভব? ঢাকার যানজটের অন্যতম একটি কারণ সমন্বয়হীনতা। বিভিন্ন সংস্থা ভিন্ন ভিন্ন পথে কার্যক্রম চালায়। যেমন, সিটি কর্পোরেশন রাসত্মা ও ওভারপাস তৈরি করে। ট্রাফিক পুলিশকে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে দেখা গেলেও সিগনাল বাতি নিয়ন্ত্রণ করে সিটি কর্পোরেশন। এটাও একটা বড় ধরনের বাধা। এখানে রাসত্মা উন্নয়নে কাজ করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং রাজধানী উন্নয়ন কতর্ৃপ। ফাইওভারের দায়িত্ব পালন করে সেতু বিভাগ । তাই তো নানা মুনির নানা মত। তাছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা ঢাকা শহরের যানজটের অন্যতম একটি প্রধান কারণ। এবং ঘাঁপটি মেরে থাকা বিগত জোট সরকারের আমলের দুর্নীতবাজ ও দলবাজ আমলারা নানাভাবে উন্নয়নকে বাধাগ্রসত্ম করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে দ্রম্নত কঠিন সিদ্ধানত্ম নিতে হবে। যানজটের মতো ভয়াবহ সমস্যা নিরসনে একটি বিশাল মহাকর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। এক বছরের কাজ ৬ মাসে শেষ করার যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশেস্নষক
ংাঁধংংরহমযড়@মসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.