‘লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে চাই’ by সুজা উদ্দিন

ছোটবেলায় ক্রিকেট নিয়ে যার সাধনা। কখনও ভাবেননি বড় ফুটবলার হবেন। গোলের নায়ক হয়ে মাঠের মধ্যমণিতে পরিণত হবেন। চট্টগ্রামের সেই ছোট ছেলেটি দেশের সেরা ও ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের অপরিহার্য ফুটবলার।
বিশেষ পরিচয় স্ট্রাইকার। খেলছেন জাতীয় দলেও। ‘বিশেষ পরিচয়’ এ কারণে বলা, ফুটবলপ্রেমীরা স্ট্রাইকারদের বেশি চিনে থাকে গোল করে দলের জয়ে ভূমিকা রাখার জন্য। যদিও গোলের জন্য অবদান থাকে পুরো দলের। কয়েক দিন আগেও তিনি ছিলেন খলনায়ক। নির্ভরযোগ্য স্ট্রাইকার হয়েও জাতীয় দলকে গোল উপহার দিতে পারেননি, বরং তার ভুলে গোল হজম করতে হয়েছে। তবে লীগে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানের বিপক্ষে জোড়া গোল করে তরুণ স্ট্রাইকার সাখাওয়াত হোসেন রনি (ফুটবল অঙ্গনে পরিচিত সাখাওয়াত রনি নামে) নিজেকে নিয়ে গেছেন অনেক উচ্চতায়। যে সৌভাগ্য সবার জোটে না। কাজী জসীমউদ্দীন জোসী আকাশি-হলুদদের বিপক্ষে নেমেই জ্বলে উঠতেন। অসাধারণ গোল করে সাদাকালোদের বিজয় কেতন ওড়াতেন। তিনি দলে না থাকলে আবাহনী ফুটবলাররা একটু খুশিই হতেন, তাদের ঘাম একটু কম ঝরবে ভেবে! সেই থেকে তিনি মোহামেডানের জোসী নামেই পরিচিতি পান। এমন অনেক সাবেক তারকা ফুটবলার আছেন, যাদের এক নামে চিনত দেশের মানুষ। ফুটবলের সে ক্রেজ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। এখন মানুষের মনে দাগ কাটার মতো খেলা দেখাতে পারেন না ফুটবলাররা। এক ম্যাচে ফর্ম ভাল তো পরের ম্যাচে খারাপ। এক বছর এক ক্লাবে তো পরের বছর অন্যটিতে। অর্থের ছড়াছড়ি যত বেড়েছে, আন্তরিকতা ততই উধাও হয়েছে। ক্লাবের প্রতি ভালবাসার টান আগের মতো নেই। উজাড় করে দেয়ার মানসিকতার তো প্রশ্নই ওঠে না! তবে সাময়িকভাবে সমর্থকদের মনে আসন গড়তে পারেন কেউ কেউ। সে মধুর কাজটিই করেছেন ২৩ বছর বয়সী। দশ বছর আগেও যে কাজটি করলে তাকে নিয়ে আলোচনায় চায়ের কাপে ঝড় উঠত। চারদিকে মাতামাতি শুরু হয়ে যেত। পরের মৌসুমে ক্লাবগুলোর মধ্যে টানাটানি বাধত তাকে দলে ভেড়ানো নিয়ে।
চলতি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে কয়েক জন ফুটবলারের উত্থান-পতন হয়েছে। কঠোর পরিশ্রম করে ফিরে আসার তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছেন উদীয়মান এ স্ট্রাইকার। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার শিলক গ্রামের মোঃ ইয়াছিন ও দৌলানা বেগমের দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে ছোট রনি। ভাই সাজ্জাদ হোসেন ইঞ্জিনিয়ার, বোন শামীমা নাসরিন রুমা বিবাহিত। বাবা ও চাচা রফিকসহ বংশের অনেকেই ফুটবল খেললেও কেউ পেশাদার হতে পারেনি। সে বংশের ছেলেটি পাড়া-গাঁয়ে ক্রিকেট খেলে দুরন্ত সময় পার করতেন। হঠাৎ ট্র্যাক পরিবর্তন হয়ে আজ তারকা ফুটবলার হওয়ার পথে। রনি নিজের মুখেই জানান সে কাহিনী, ‘ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলতাম। বর্ষকালে মাঝে মাঝে ফুটবল। ভালই খেলতাম। ২০০৪ সালে ফান করে উন্মুক্ত ট্রায়ালে অংশ নিয়ে উপজেলা দলে সুযোগ পাই। সে বছর আন্তঃউপজেলা ফুটবলে তিন ম্যাচে ৫ গোল করেছিলাম। আমাদের উপজেলা রানার্সআপ হয়েছিল। ওটাই আমার প্রথম ফুটবল খেলা। দ্বিতীয় বিভাগেও খেলেছি রাঙ্গুনিয়ার হয়ে।’ ‘নিজের জেলা না নেয়ায় অনুর্ধ-১৬ জেএফএ কাপে ফেনীর হয়ে খেলেছি। আমার হ্যাটট্রিকে ওই ভেন্যুতে চট্টগ্রামকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই। এরপর দ্বিতীয় বিভাগের দল কদমতলা থেকে ফকিরেরপুল, চট্টগ্রাম আবাহনী। এখন দেশের নামকরা ক্লাব আবাহনীতে খেলছি তিন বছর ধরে। এটা বড়া পাওয়া।’ নিজের উঠে আসার কথা এভাবেই তুলে ধরেন তিনি। দোলন ভাইয়ের মাধ্যমে ডাক পান ঢাকার দ্বিতীয় বিভাগের দল কদমতলায়। শুরু হলো ঢাকার ফুটবলে যাত্রা। সে সময় সঙ্গ পেয়েছিলেন অনুর্ধ-১৭ থেকে উঠে আসা এখন দেশসেরা স্ট্রাইকার মিঠুন, উইঙ্গার জাহিদ, আরাফাত রনির। আরমান আজিজের পরামর্শে লুফে নেন ফকিরেরপুলে পরের বছর খেলার সুযোগ। তখন নামডাক ছড়ানো মিডফিল্ডার আরমান তার আগে খেলেছেন এ ক্লাবে। এখন তার সঙ্গেই খেলার সৌভাগ্য ঘটেছে রনির। ফকিরেরপুলে দ্ইু বছর খেলার পর রনি চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে ২০০৮ সালে দ্বিতীয় ও ২০০৯ সালে তৃতীয় বাংলাদেশ লীগে খেলে নজরে পড়েন। পরের দুই আসরসহ এ বছর খেলছেন ঢাকা আবাহনীতে। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির হয়ে প্রথম বছরেই করেন ৬ গোল। অবশ্য পরের ২০১১-১২ মৌসুম সাইড বেঞ্চে থেকেই পার হয়ে যায়। কয়েকটি ম্যাচে বদলি হিসেবে নেমে সাকল্যে গোল করেছেন ৩টি। ইরানী কোচ আলী আকবর পোরমুসলিমি কেন খেলাননি কারণটি তার এখনও অজানা।
সাফল্য ব্যর্থতার সব গল্পই আছে রনির জীবনে। কথনও জ্বলে ওঠেন, আবার নিভে যান। ক্লাবের পক্ষে গোল পেলেও বয়সভিত্তিক এবং জাতীয় মূল দলের হয়ে এখন পর্যন্ত গোলের দেখা পাননি এ স্ট্রাইকার। ২০১০ সাল থেকে তার জাতীয় দলে ক্যারিয়ার শুরু। তরুণ ফুটবলার হিসেবে আবাহনীতে চমক দেখিয়ে কোচ রুবচিচের দৃষ্টিতে আসেন। সে বছর মিয়ানমারে চ্যালেঞ্জ কাপে দলে ছিলেন। বদলি হিসেবে দুই ম্যাচ খেলেছিলেন। গোল পাননি। তবে জায়গা পাননি পরের বছর দিল্লী সাফ ফুটবলে। গত বছর নেপালে অনুর্ধ-২২ দলের হয়ে সাফাল পোখাড়া কাপ ও চার জাতি শ্রীলঙ্কায় মহিন্দ রাজা পাকসে আন্তর্জাতিক আসরেও ছিলেন নিষ্প্রভ। গত ফেডারেশন কাপ ও চলতি লীগে নতুন করে চিনিয়ে নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণ করেছেন। লীগে দলের ১২ গোলের একাই করেছেন ৪টি। সর্বশেষ দুই ম্যাচে সেরা একাদশের খেলোয়াড় হয়ে মাঠে নেমে বাজিমাত করেন। মোহামেডান ও বিজেএমসির বিপক্ষে দুটি করে গোল করেন। আগের ৫ ম্যাচে সেরা একাদশে ছিলেন না। বদলি হিসেবে নেমে অল্প সময়ে মেলে ধরতে পারেননি নিজেকে। তা না হলে গোল আরও বাড়তে পারত অভিমত তার। এখনও সবার চেয়ে এগিয়ে থাকার স্বপ্ন দেখেন রনি, ‘আরও যেন ভাল করতে পারি সেজন্য চেষ্টা করছি। লীগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে চাই।’ কোচ ও সিনিয়ররা তাকে অনেক সাহায্য করায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান দেশের সম্ভাবনাময় তারকা। একদিক থেকে ভাগ্যবান রনি। বিশ্বের মধ্যে তার পছন্দের খেলোয়াড় লিওনেল মেসি হলেও দেশে তার আদর্শ ফুটবলারের জায়গা দখল করে আছেন অভিজ্ঞ স্ট্রাইকার আলফাজ আহমেদ। রোমাঞ্চের ব্যাপার মাঠ কাঁপানো আলফাজের সঙ্গে আকাশি-হলুদ জার্সি পরে এক সঙ্গে খেলেছেন একটি মৌসুম। সাখাওয়াত রনি নিজেই দিচ্ছেন রোমাঞ্চকর সে বর্ণনা, ‘যখন থেকে ফুটবল খেলা দেখি ও খেলি ফুটবলস্টার আলফাজ ভাইয়ের অনেক কথা শুনেছি। টিভিতে খেলা দেখেছি। তার খেলা আমি খুব পছন্দ করতাম। যখন আবাহনীতে তার সঙ্গে খেলেছি, নিজেকে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি, আসলে বাস্তব কি না। তার ফিনিশিং আমার বেশি ভাল লাগে। চেষ্টা করি তার মতো খেলতে।’ ‘এবারের লীগ খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে। তাই আগে থেকে বলা যাচ্ছে না কে চ্যাম্পিয়ন হবে। নিজের তুঙ্গে থাকা নৈপুণ্য ধরে রখে দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে চাই’ রনির প্রত্যয়। তার বড় আক্ষেপ জাতীয় দলের হয়ে গোল না পাওয়া। সামনে সুযোগ পেলে দেশের সেরা ফুটবলার হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ম্যাচেও গোলের জন্য উন্মুখ সাখাওয়াত রনি। এজন্য সবার দোয়া কামনা করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.