এই রায় বন্দুকের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রণোদনা by মুনতাসীর মামুন

আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! ১৯৭৯ সাল থেকে লেখক গবেষক এবং অনেক রাজনীতিবিদ বলে আসছিলেন যে কথা সে কথা অবশেষে আদালত স্বীকার করল ২ জানুয়ারি ২০১০ সালে। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে_ দু'বার স্বীকার করল।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগীয় ইতিহাসে যাঁর নাম বার বার ফিরে আসবে, আইনের ছাত্রদের যার রায় অধ্যয়ন করতে হবে এবং আইনজীবীদের জনস্বার্থের মামলায় যাঁর রায়ের রেফারেন্স বারবার টানতে হবে সেই বিচারপতি খায়রুল হক। [দ্বৈত বেঞ্চের আরেক বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির] ২৯ আগস্ট ২০০৫ সালে, ২৫ বছর পর এক রায়ে পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। অবশ্য, আদালতেরও বা দোষ দিই কীভাবে? সিভিল সমাজের প্রতিভূ রাজনীতিবিদরাই তো সমঝোতা করে বসেছিলেন আগে। হবে, বিরোধী দলগুলো (অর্থাৎ জিয়া, এরশাদ, বেগম জিয়ার আমলে] সামরিক শাসনকে বর্বর শাসনের সঙ্গে তুলনা করেছেন বটে, কিন্তু কুখ্যাত পঞ্চম সংশোধনীর কথা এড়িয়ে গেছেন। পঞ্চম সংশোধনী করেছিলেন মতা দখলকারী জিয়াউর রহমান। এই সংশোধনী বলে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সেনারা যে সব খুন জখম অপকীর্তি করেছিল সব বৈধ করে সংবিধানে অন্তভর্ুক্ত করা হয়। এটি যে অবৈধ তা বলার অপো রাখে না। এবং এর ওপর ভিত্তি করে তিন দশক নীতিবিগর্হিত শাসন চালানো হয়েছে বাংলাদেশে। সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করার জন্য ২৭ বছর আগে করা এক রিট মামলার রায়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের বেঞ্চ এক রায়ে প্রথম এই সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেন। যা আগে উল্লেখ করেছি। যে দেশে এখন কোন শাসন নেই, যে দেশে রাষ্ট্র মানেই পীড়ন যন্ত্র, যে দেশে সরকার মানেই গ্রেনেড ও বোমা সে দেশে হঠাৎ নৈতিকতার প েরায়। স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সবাই। আশ্চর্য বিচারপতিদের সাহস। তাঁরা যেন এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন আমাদের সবার প্রতি। বাংলাদেশ, সব সম্ভবের দেশ বলেই বোধহয় এটা সম্ভব হলো।
সামরিক আইন ও জঙ্গলের আইনে কোন পার্থক্য নেই, এ কথা সিভিল সমাজ পাকিস্তান আমল থেকেই উচ্চারণ করেছে। সিভিল সমাজ রার নৈতিক দায়িত্ব আদালতের। কিন্তু আদালত সাধারণত এসব থেকে দূরে থেকেছে। কখনও এর বিরুদ্ধে আদালতে আশ্রয় নিতে গেলে আদালত সেনাদের প নিয়েছে নৈতিকতাহীনভাবে। সিভিল সমাজের বিরুদ্ধে এ জঘন্য কাজটি শুরু করেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মুনীর। আইয়ুব খান বন্দুকের জোরে মতা দখল করলে আদালতে রিট হয় এর বিরুদ্ধে। তখন তিনি এক তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে সামরিক শাসনের প েরায় দেন। এ কারণে পরে তাঁকে মন্ত্রী করা হয়। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলা হয়। পরবতর্ীকালে নিজের আত্মজীবনীতে এ সম্পর্কে লিখেছেন খানিকটা অনুতপ্ত হয়ে। বাধ্য হয়েছিলেন লিখতে, যদিও সামরিক শাসনকে বিপ্লব বলে তিনি আখ্যায়িত করেছিলেন। লিখেছিলেন তিনি "ই রণশমফর্লধমভর্ দর্ট দট্র ্রলডডণণঢণঢ ধ্র ট ীণথটফধ্রণঢ ধফফণথটফর্ধহ, ওধভডণ ভম উমভর্্রর্ধর্লধমভ ধ্র ভিমষভর্ ম ডমর্ভটধভ ট যরমশধ্রধমভ তমর র্ধ্র মষভ মলণর্রদরমষ ঠহ শধমফণভডণ, ট রণশমফর্লধমভ ধভ র্ধ ধভডণর্যধমভ টভঢ ডমভডণর্যধমভ ধ্র টভ টশমষণঢধফফণথটফর্ধহ, টভঢর্ দণ ্রর্ধলর্টধমভ ধফফণথটফর্ধহ, টভঢর্ দণ ্রর্ধলর্টধমভ রণ্রলর্ফধভথর্ দণরণ তরমব ধভ ঠণহমভঢর্ দণ ডমভথভধ্রটভডণ মত ফটষ টভঢ ফটষ ডমলর্র, ঋসধর্্রধভথ টর্লদমরর্ধধণ্র, বটহ ণর্ধদণর শটডর্টণ মর টডডণর্যর্ দণ ডদটভথণ,র্ দণরণ ঠণধভথ ভম বধঢঢফণ ডমলর্রণ তমরর্ দণব, ইত্যাদি।
সে ধারা বাংলাদেশেও অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশের বিচারকদের মুরোদ ছিল না প্রতিবাদ করার। সামরিক আইন নিয়ে এক মামলায় এক সময়ের বিচারপতি, পরে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহম্মেদ ও বিচারপতি রুহুল আমিন এক রায়ে সামরিক আইনকে বৈধতা দিয়েছিলেন। তাঁদের দোষ নেই। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আইয়ুব আমলে ছিলেন সরকারী আমলা। [সিএসপি], সামরিক হোক, অসামরিক হোক, বৈধ হোক, অবৈধ হোক তাদের ট্রাডিশন ছিল শাসকের আদেশ অমান্য করা, এক বিচারপতি সামরিক আইন বৈধ করে রায় দিয়েছেন তারা তা অনুসরণ করেছেন। বিবেকটিবেকের বালাই ছিল না।
২০০৫ সালে বিচারপতিদ্বয় সে রায়কেও নস্যাত করে দিয়েছিলেন। যে রায়ের নির্যাস ছিল_
১. সাংবিধানিক পন্থা ছাড়া মতা গ্রহণ রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল, ২. কোন অসাংবিধানিক কার্যকলাপ কখনই পরবতর্ীকালে বৈধতা দেয়া যায় না, ৩. দেশে যদি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করার পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয় তবুও সাংবিধানিক পন্থায় তা করতে হবে, ৪. সংসদ, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, প্রতিরাসহ সবকিছু সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ ও সংবিধানের কাছে ঋণী' (ভোরের কাগজ ৩০.৮.০৫)।
এ রায় প্রবল অভিঘাতের সৃষ্টি করেছে সমাজে, রাষ্ট্রে। বেগম জিয়া পত্রিকা অনুসারে নাকি আশ্চর্য হয়ে বলেছিলেন, এসব কী হচ্ছে। কারণ তাদের সাজানো আদালতের এ রকম রায় যা তাদের আসন টলিয়ে দিতে পারে, এ কেমন কথা? তখনই মধ্যরাতে আইনজীবী বাহিনীকে পাঠানো হলো বিচারকের বাসায়। তাঁকে ঘুম থেকে উঠিয়ে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করানো হলো। ইনকিলাবের সম্পাদকের বিরুদ্ধে একবার গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হলে মধ্যরাতে এ রকমভাবে জামিন নেয়া হয়েছিল। পরদিন থেকে মিথ্যার মেশিন চালু হলো। বিখ্যাত অসত্য ভাষক মওদুদ আহমদ বললেন, জিয়াউর রহমান সামরিক শাসন জারি করেননি, করেছেন বিচারপতি সায়েম। কথা হচ্ছে, পঞ্চম সংশোধনী নিয়ে তিনি বলছেন কী! পঞ্চম সংশোধনী কি ভৌতিক কোন ব্যাপার? টিএইচ খান নামে এককজন আইনজীবী বলেছিলেন, দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে এ রায়।
বিএনপি-জামায়াত জোটের তখন শেষ দিক। সারা দেশে অস্থিরতা। দেশবাসী চাচ্ছে, কবে আপদ বিদায় হবে। তখন, তারা কৌশল নিয়েছিল এ রায় স্থগিত করার। তখন যাঁরা বিচারক ছিলেন। [যাঁরা এখন বিচারক পরিচয় দিলে নাজেহাল হবেন] তাঁদের পরিপ্রেেিত আমরা ধরে নিয়েছিলাম, রায় স্থগিত হবে, হয়েছিলও। আর আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, স্থগিতকরণের অর্থ হিমঘরে প্রেরণ, তবে, মানুষজন যারা সিভিল সমাজের প েতারা যে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। মনে আছে, সে সময় টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতিবেদকরা জানিয়েছিলেন।
মানুষ আশা করছে রায়ের মূল নির্যাস গ্রহণ করা হবে। অনেকে তখন বলেছিলেন, যাক আদালত জেগে উঠছে, কুম্ভকর্ণের ঘুমের পর। আমরা চেয়েছিলাম আদালত যেন জেগে থাকে। আবার যেন ঘুমিয়ে না পড়ে। তত্ত্বাবধায়ক আমলে ঝিমোচ্ছিল সে, জনশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জেগে থাকছে। জনশাসনে আমাদের দেশে জুডিশিয়ারি সজীব থাকে। অপশাসনে ঝিমিয়ে যায়, এর কারণ, বিচারকরাও সাধারণ মানুষ, মহামানব নন। তত্ত্বাবধায়ক আমলে মেজররা বসে থাকত বিচারালয়ে। মাথার ওপর ট্রিগার ধরে থাকলে কে না ভীত হয়। যে হয় না, সে ইতিহাসে থাকে। যেমনটি হননি খায়রুল হক।
জনশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আদালত আবার সজীব হয়ে উঠেছে। সেই বিচারপতি খায়রুল হক ও বিচারপতি মমতাজউদ্দিনের বেঞ্চ জনস্বার্থে অনেকদিন মাইলফলক রায় দিয়েছেন। ২০০৫ সালে প্রথিতযশা স্পষ্টভাষী ব্যারিস্টার রফিকুল হক বলেছিলেন, যে দু'জন রায় দিয়েছেন তাঁদের কপালে দুঃখ আছে। বাস্তবও ছিল তাই। কিন্তু বিচারক দু'জন অত্যন্ত ধার্মিক। আল্লাহ্ মেহেরবান। এই রায় দেয়ার পর তাঁরা বেঁচেছিলেন। এবং বিচারপতি খায়রুল হক এখন আপীল বিভাগে উন্নীত হয়েছেন। রাখে আল্লাহ্ মারে কে! এখানে একটি কথা বলি, গত ১০০ বছরে আদালতে অনেক বিচারক এসেছেন, গেছেন, বিচারপতি মাহবুব মুর্শেদ ছাড়া আর কেউ স্মরিত হন না। এরশাদ আমল থেকে অধিকাংশ প্রধান বিচারপতিকে অপমাণিত হয়ে বিদায় নিতে হয়েছে। বিচারপতিরা কেন তা মনে রাখেন না।
জনশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে, সাধারণ থেকে দাবি উঠেছিল জোটের কথা আপীল প্রত্যাহার করা হোক। সরকার করেছিল। বিএনপি ও জামায়াত এর বিরুদ্ধে নিয়মিত আপীল শুনানির দাবি করে। আদালত তাদের দাবি অস্বীকার করেনি। আপীল শুনানির পর গতকাল তা নাকচ হয়ে গেছে।
সিভিল শাসনবিরোধী এ রকম ধারা সংবিধানে থাকতে পারে না_ এ কথা কি বাদীপরে আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ ও টিএইচ খান জানেন না। বিলণ জানেন। কিন্তু, তাঁরা একটি দল করেন যার ভিত্তি পঞ্চম সংশোধনী, সুতরাং তাঁরা এর বিরোধিতা করবেন এবং আশা নেই যেন আগেই এমন সব মন্তব্য করেছেন যাতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এ বক্তব্য তুলে ধরা যাবে, বিচারকরা সরকারের নির্দেশে আপীল আবেদন নাকচ করেছেন। তবে, আওয়ামী লীগ যদি মওদুদকে মন্ত্রী করত তাহলে মওদুদ পঞ্চম সংশোধনীর প েবলতেন। তবে, রেকর্ডের খাতিরে তাদের বক্তব্যগুলো উদ্ধৃত করা প্রয়োজন। ২০০৫ সালেও এই দু'দল একই ধরনের কাথাবার্তা বলেছিলেন, যা আগে উল্লেখ করেছি। বিএনপি-জামায়াত যে সামরিক শাসকদের প েএ সব বিবৃতি তার প্রমাণ।
শুনানিতে টিএইচ খান আদালতকে বলেন, পার্লামেন্টের কর্মকাণ্ড হাইকোর্টের জন্য বিচার্য বিষয় হতে পারে না। সংসদকে হাইকোর্ট কোন নির্দেশ দিতে পারে না। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে হাইকোর্টকে এ মতা দেয়নি। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের ২টি পার্ট। একটি মৌলিক অধিকারের প্রয়োগ, আরেকটি জুডিশিয়াল রিভিউ। তিনি বলেন, আমার যুক্তি হলো পার্লামেন্টকে নির্দেশ দেয়ার মতা হাইকোর্ট দেয়নি। সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদের কিছু আইনকে অবৈধ করার এখতিয়ার হাইকোর্টের নেই। খোন্দকার মোশতাক খারাপ কাজ করেছে, পার্লামেন্ট তাঁকে বৈধতা দিয়েছে। খোন্দকার মোশতাক সরকার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিত করেছিল ২১ নং আইন দ্বারা।
টিএইচ খান আদালতকে আরও বলেন, সুপ্রীমকোর্টের একজন জাজের মতার সংজ্ঞা ১০১ অনুচ্ছেদে বলা আছে_ যেহেতু সংবিধান বিষয়ে পঞ্চম সংশোধনী রায়ে বলা হয়েছে, যে কারণেই সংবিধান আদালতকে যে মতা দিয়েছে তার বাইরে যাবার সুযোগ নেই। যেহেতু চতুর্থ তফসিল সংবিধানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতএব এর কারণে মার্শাল ল'-এর মাধ্যমে কৃত কাজ কোন আইন-আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ শুনানি শেষে সাংবাদিকদের বলেন, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল। একদল কায়েম করা হয়েছিল। ৪টি পত্রিকা রেখে সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এর থেকে বের হয়ে আসার জন্যই পঞ্চম সংশোধনী করা হলো। গণতন্ত্র থাকলে পঞ্চম সংশোধনীর প্রয়োজন হতো না। তিনি বলেন, দু'সামরিক সরকারের সময় জড়িত ছিলাম। অনেক কিছুই জানি, যা অনেকেই জানেন না। গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার জন্যই কাজ করেছি; সামরিক আইনের জন্য নয়। এ সময় আইনজীবীরা শেম শেম বলে উঠলে মওদুদ আহমদ বলেন, এ সময় আমি বলি চতুর্থ সংশোধনী করার সময় শেম শেম করার কথা কি মনে ছিল। তিনি বলেন, মুন সিনেমা হল নিয়ে ১৯৭৬ সালে রিট হয়। জমি ফেরত দেয়ার জন্য রায় হয়েছে। বর্তমান সরকার ইচ্ছা করলেই জমি ফেরত দিতে পারে। কিন্তু সরকার মামলায় কিছু সুবিধা পাচ্ছে। [জনকণ্ঠ ২২-১-১০]
মওদুদ আহমদ এর আগে বলেছিলেন_

পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে সংবিধানের ধারাবাহিকতা বাধাগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিলের আগে ও পরের সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড অবৈধ হয়ে যাবে। এতে দেশে ভয়াবহ নৈরাজ্য ও অরাজকতার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মওদুদ আহমদ বলেন, পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশালী শাসনের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখন ঐ সংশোধনী বাতিল হলে আবার একদলীয় শাসনের সুযোগ সৃষ্টি হবে, মৌলিক অধিকার ুণ্ন হবে, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ব্যাহত হতে পারে। তিনি বলেন, কোনভাবেই সংবিধানের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হতে দেয়া যাবে না। সুপ্রীমকোর্টের রায়ের দোহাই দিয়ে সরকার একদলীয় শাসনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তিনি বলেন, সরকার এখন ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মতায় রয়েছে। তারা ইচ্ছা করলেই সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে। [ ইত্তেফাক ৬-৫-২০০৯]
আইনের খুঁটিনাটি আমরা বুঝি না, কিন্তু তারা যে যুক্তিগুলো দিয়েছেন সেগুলো কতটা যুক্তিযুক্ত। পঞ্চম সংশোধনীই তো নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে রাজ্যে। একজন আইনজীবী এখন আইনের শাসনের বদলে বন্দুকের শাসনের প েথাকেন, তা হলে আইনজীবীদের আর নৈতিকতা কী থাকে। চতুর্থ সংশোধনীর প েকখনও আমরা বলিনি, কিন্তু মওদুদ তো আজীবন মতায়। বঙ্গবন্ধু আমলে তিনি চতুর্থ সংশোধনীর বিরোধিতা করেছেন তাহলে জিয়া-এরশাদ-খালেদা আমলে আইনমন্ত্রী থাকাকালীন এই সংশোধনী কেন বাতিল করলেন না। এখনও তো তারা এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যেতে পারেন। হাইকোর্ট তো আগেও সংবিধান সংশ্লিষ্ট মামলা গ্রহণ করেছে, রায়ও দিয়েছে, তা হলে এখন অসুবিধাটা কোথায় ? সরকার ইচ্ছে করলে সংসদে এই সংশোধনী বাতিল করতে পারত, করেনি কারণ মামলাটি আদালতে চলছিল। মওদুদরা আর কতদিন খুনীদের প েসাফাই গাইবেন। দু' বছরেও শিা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর খুনকেও তারা পরোভাবে এবং মতায় থাকলে প্রত্যভাবে খুনীদের সহায়তা করেছেন। সুইডেনের ঝিন্টুর ফাঁসির আদেশ কি মওদুদ বাতিল করাননি। আশ্চর্য, গত দু' বছরেও তাদের শিা হয়নি। সামরিক আইন ভাল হলে জেনারেল মইনের শাসনের বিষয়ে তারা এত প্তি কেন ? এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া জরুরী। সামরিক শাসনের সঙ্গে থাকতে পারলে বা বুটলিকার হলে ভাল, না হলে খারাপ এত লজিক না। তবে বিএনপীয়দের কাছ থেকে লজিক আশা না করা ভাল। বিএনপি-জামায়াত যে রায়ের বিরোধিতা করছে তার একটি কারণ আছে। তাদের ভিত্তি এই সংশোধনী, এই সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়া নিজেকে বৈধ করতে চেয়েছেন, আবার তিনি এ রায়ের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্জীবিত করেছেন। ২০০৫ সালের রায় ঘোষণা করেছে সে সত্য যে বিএনপির স্রষ্টা জিয়াউর রহমানের মতা দখল অবৈধ। জামায়াত ও পাকিমনাদের নিজস্বার্থে যে পুনর্বাসিত করেছিলেন তা অবৈধ। রাষ্ট্রের যে কাঠামো বন্দুকের সাহায্যে বদল করেছিলেন তা অবৈধ, জামায়াত অবৈধ এরশাদ ও তার সামরিক সাঙ্গোপাঙ্গরা যারা এক দশক লুটপাট করেছে, তারা অবৈধ। অর্থাৎ সম্পূর্ণ অবৈধ পন্থায় ২৫ বছরে এ রকম অবৈধ একটা জোটের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে সরকার জিয়াকে যে মহাপুরুষ হিসেবে স্থাপন করতে চেয়েছে তা অবৈধ। আদালতের বিচারকরা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। সুতরাং বেগম জিয়া যদি বলে থাকেন, কী হচ্ছে তা হলে এ পরিপ্রেেিতই বলেছেন। আর ভীত না হলে মধ্যরাতে আপীল হতো না। এ রায়ে ভীত গত ২৫ বছরের বেনিফিশিয়ারিরা যেখানে রাজনীতিবিদ, আইনবিদ, বিভিন্ন পেশার মানুষ, ব্যবসায়ী সবাই অন্তভর্ুক্ত। সিভিল শাসনের প েহলে মধ্যরাতে এ্যাটর্নি জেনারেল আপীল করার বদলে পদত্যাগ করতেন।
অবৈধ রাজনীতির পুরোটাই মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। সাধারণ উদাহরণ দিই। বিএনপি নিজেদের গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী মনে করে। গণতন্ত্র ও সিভিল শাসনে বিশ্বাস করলে এবং বন্দুকের নলের ওপর নির্ভরশীল না হলে তারা আপীল করে কেন ? রায় তো সামরিক আইনের বিরুদ্ধে, সংবিধানের শুদ্ধতা রায়। ধরা যাক জামায়াত বা ইসলামী ঐক্যজোট ইত্যাদির কথা। তাদের দলের মূল ল্য শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা, নারী নেতৃত্বের অবলোপন। এটি বিশ্বাস করে দেখেই তারা ঐসব দল করে। অথচ এরা আল্লার নামে শপথ করে যে সংবিধান রার দায়িত্ব নিয়েছেন সে সংবিধানে শরিয়া আইনের কোন স্থান নেই, নারী-পুরুষে আছে সাম্য। ভণ্ডামিটা কী পর্যায়ে গেছে তা অনুমেয়। এবং যারা এদের সমর্থন করছে তারা জেনেশুনেই এই ভণ্ডামি সমর্থন করছে। বাংলাদেশ কীভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এটি এর একটি উদাহরণ। কয়েকদিন আগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একটি যুক্তিপূর্ণ যুক্তির কথা তুলে ধরেছেন এক বক্তৃতায়। তিনি বলেছিলেন, যে সংবিধান বাংলাদেশের ভিত্তি, যে সংবিধান জনগণের মতার ওপর ভিত্তি করে রচিত_ ঐ সংবিধান বিশ্বাস করলে জনগণের মতাই সবের্াচ্চ। সেটা স্বীকার করতে হবে। আসলেই তো। বন্দুকের শক্তি/মতা ও জনগণের শক্তি/মতা একসঙ্গে থাকতে পারে না। বিচারপতি মুনীরের মতো রেনিগেডও তাই স্বীকার করেছেন। এ ধরনের রেনিগেডরা আরও বলেন, সামরিক আইন সবার ওপরের আইন। যেন ঈশ্বরের আর কী !
আমরা যারা সিভিল সমাজে বিশ্বাসী, সেকু্যলারিজমে বিশ্বাসী তারাও কি এ কথা কখনও বলেছি, যে সংবিধান নিয়ে আমরা উদ্বেলিত সে সংবিধানে তিনটি ঘোষণা আছে যার একটি জনগণের, বাকি দু'টি উর্দিঅলাদের। এক সংবিধানে পরস্পরবিরোধী দু'টি বিষয় সহঅবস্থান করতে পারে না। করলে বুঝতে হবে কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। আর সেই গণ্ডগোল যদি সংবিধানে থাকে তাহলে সব সময় দেশে গণ্ডগোল থাকবেই। জিয়া ও এরশাদ আমলের অবৈধ নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করে ও সংসদে গিয়ে সব রাজনৈতিক দল এই জগাখিচুড়িকে অনুমোদন করেছে। সোজা বাংলায় সমঝোতা করেছে। এবং এ কারণেই দেশের আজ এ অবস্থা। সে হিসেবে আমরা সবাই সেই বিশেষ স্বার্থের অংশীদার। সুতরাং বিচারকদ্বয়ের রায় আমাদের প্রতিও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ শুধু নয়, এক ধরনের চড়ও বটে। বিচারকদ্বয় যে প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়েছেন আমাদের সবার দিকে তা হলো, আমরা কি সমঝোতা করে নষ্ট গণতন্ত্রের খেলা খেলব, নাকি জনগণের শক্তির কাছে ফিরে যাব? যেতে চাইলে '৭২-এর সংবিধান চাইতে হবে। আপীল বিভাগের রায় সে রায় সুগম করেছে। মূল কথা হলো যা অবৈধ, নৈতিকভাবে অবৈধ, আদালত তাকেই অবৈধ বলেছে। বিচারপতি খায়রুল হকের রায়েও অনেক সমঝোতার বিষয় আছে তা সত্ত্বেও আমরা স্বাগত জানিয়েছি। আপীল বিভাগের রায়ের পর তা কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের। তবে বিএনপি-জামায়াত নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করবে এবং সেটা স্বাভাবিক। কারণ পঞ্চম সংশোধনীর ফলে বিশাল এক স্বার্থভোগী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে, এর সঙ্গে আছে জঙ্গীবাদ, নতুন এক প্রজন্মের সৃষ্টি হয়েছে যাদের বড় অংশ এই গোষ্ঠীর সমর্থক। অনেকে বলতে পারেন কেন সম্ভব নয়? সম্ভব হতে পারে যদি যারা সিভিল সমাজের প েতারা একজোট হয়ে বলেন, যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। সেই জোর কি সিভিল সমাজ দেখাতে পারবে বা তার নেতৃত্ব ? সে বিশ্বাস আমাদের খুব একটা নেই।
সরকার সিভিল সমাজকে নিয়ে এগুলে অসম্ভব বলে কিছু নেই। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, আওয়ামী লীগ মতায় গেলে মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের ওপর আস্থাশীল হয়ে ওঠে, সিভিল সমাজের ওপর নয়। পঞ্চম সংশোধনীকে উপল করে যে দু'জন বিচারক রায় দিয়েছেন তাঁরা অন্য অনেক বিচারকের মতো গতানুগতিক রায় দিতে পারতেন, তারপর হারিয়ে যেতে পারতেন অনেকের ভিড়ে। তাদের কপালে দুঃখ আছে কিনা জানি না। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আইনের ইতিহাসে তারা উঠে এলেন সাহসিকতার জন্য, আইনের শাসনের পথের দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য, আদালতের মর্যাদা রার জন্য। হয়ত তাদের কপালে দুঃখ আছে কিন্তু জানবেন অগণিত মানুষের ভালবাসা তাদের পাথেয় হয়ে থাকবে দুঃখের দিনে। এই ভালবাসা সবাই পায় না। এবং দণি এশিয়ার মানুষ যারা সামরিক আইনের যাঁতাকলে পিষ্ট তাদের প্রণোদনা যোগাবে এই রায়। এই রায় প্রণোদনা যোগাবে দণি এশিয়ার মানুষকে বন্দুকের বিরুদ্ধে, নষ্ট শাসন, অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। এই রায় কার্যকর হোক না হোক তাতে কিছু আসে-যায় না। কারণ আমরা জানব বিএনপি বা জাতীয় পার্টির যারা স্রষ্টা তারা অবৈধ, ১৯৭৫ থেকে ২০০০ পর্যন্ত তারা যা করেছে তা অবৈধ। এ কলঙ্ক মওদুদদের প েমোছা যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.