বিদায় ২০১২

ড. মাহফুজ পারভেজ: সব পত্রিকাতে চলে যাওয়া বছরকে ‘বিদায়’ জানানো হয়। বছরের শেষে আবাহন করা হয় নতুনকে।
কিন্তু সময়কে কি স্মৃতি থেকে ‘বিদায়’ জানানো যায়? ইতিহাস থেকে কি মুছে ফেলা যায়? অতীতের যে বছরগুলোকে ক্রমে ক্রমে ‘বিদায়’ জানিয়ে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, সেসব বছর তো রয়ে গেছে মহাকালের স্মৃতিগর্ভে! এসবকে ‘বিদায়’ জানাবো কি করে? ‘বিদায়’ বললেই ২০১২ চলে যাবে না; থেকে যাবে আনন্দের বা কষ্টের স্মৃতিতে। বিশ্বজিতের মাতা ও পরিবারের কাছ থেকে কি ‘বিদায়’ নেমে ২০১২? ইলিয়াস আলী এবং আরও বহু পরিবারের যারা নিখোঁজ হয়েছেন, তারা ২০১২ সালকে ভুলবে কি করে? রাজনৈতিক সন্ত্রাসে, পথের দুর্ঘটনায়, পোশাক কারখানার আগুনে এবং অন্যবিধ নানা বিপাকে যাদের জীবন গিয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা এবং তাদের স্বজনরা ২০১২ সালকে মনে রাখবেই। বাংলাদেশের রাজনীতি গণতন্ত্রের পথে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার দুঃসহ স্মৃতিতে মনে রাখবে এ বছরকে। গ্রামীণ ব্যাংকের সহস্র সদস্য কিছুতেই ভুলতে পারবে না সালটিকে। পদ্মা সেতুর আশায় অপেক্ষমাণ দক্ষিণ বাংলার মানুষ; শেয়ার বাজারে বিপর্যস্ত বিনিয়োগকারী; বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতিরত শিক্ষার্থী এবং আরও বহু মানুষ একবিংশ শতাব্দীর পথে ২০১২ সালের দিনগুলোতে নানা বিপদের ধাক্কায় থমকে দাঁড়ানোর কথা বিস্মৃত হবে না। যেভাবে এগুনোর কথা ছিল ২০১২ সালে সেটা হয়নি- এ অপ্রাপ্তি ও হতাশার যন্ত্রণাদগ্ধ কথাও তো ভুলতে পারবে না অনেকেই। অবশ্যই প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কষ্টি পাথরে ২০১২ সালকে দেখবে মানুষ। যদিও বাধ্য হবে ‘বিদায়’ জানাতে তথাপি সেই ‘বিদায়’ সবার জন্য সমান আনন্দের হবে না। প্রকৃতির অগ্রগতির নিয়মে ২০১৩ সালকে আমন্ত্রণ জানানোর সময় অনেকেই গোপন অশ্রুতে ভাসাবে ২০১২ সালকে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন চলেছে ৫০ বছরকে স্পর্শ করতে। ১৯৭১ সাল থেকে প্রতিটি বছর এক-একটি সিঁড়ি হয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে চলেছে অর্ধ-শতাব্দীর প্রান্তে। এ চলার পথে প্রতিটি বছর তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির খাতা খুলে দিচ্ছে মানুষের সামনে। আমরা আমাদের পাওয়া না-পাওয়ার মাঝখান দিয়ে হিসাব কষতে কষতে এবার ফেলে যাচ্ছি ২০১২ সালকে। কিন্তু যে আশাবাদের মাধ্যমে সালটি অতিক্রম করার কথা ছিল, সেটা সরকার, বিরোধী দল তথা সকলে মিলেমিশে ঠিকভাবে পেরিয়ে যেতে পেরেছি কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে থেকে যাবে। শুধু নতুন বছর ২০১৩ সালের আগমনের সময়ই নয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসেও ২০১২ সাল নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত হতে থাকবে। এ রকম একটি বছরকে মূল্যায়নের আলোয় না রেখে পারা যাবে না। কেবল ‘বিদায়’ জানানোর প্রথাগত আচরণই ২০১২ সালের প্রতি আমাদের একমাত্র কর্তব্য হওয়া উচিত নয়; বরং পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের মাধ্যমে ভুলগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রেরণাও নিতে হবে বিদায়ী ২০১২ সাল থেকে। অতীতের প্রকৃত শিক্ষায় প্রজ্জ্বলিত আত্ম-উপলব্ধিতে ২০১৩ সালকে স্বাগত জানানো গেলেই মহাকালের অতল থেকে অলক্ষ্যে ২০১২ সাল শত যন্ত্রণা ও বেদনাতেও উদ্ভাসিত হয়ে থাকবে।


No comments

Powered by Blogger.