জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে পাইপলাইন স্থাপন স্থগিতের নির্দেশ- কেন বেআইনী নয়_ ৪ সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে জানাতে বলেছে আদালত

শাহীন রহমান জাতীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানার ভেতর দিয়ে ড্রেজিং পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ ৪ সপ্তাহের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে এ দুটি স্থানের ভেতর দিয়ে পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ কেন বেআইনী হবে না তা জানতে চেয়েছে আদালত।
এজন্য সরকারকে দু'সপ্তাহের সময় দেয়া হয়েছে। বেসরকারী সংগঠন হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ'র একটি রিট আবেদনের পেৰিতে মঙ্গলবার আদালত এ নির্দেশ দেয়। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতর দিয়ে ড্রেজিং পাইপ লাইন স্থাপন করা হলে উদ্যানের ব্যাপক ৰতি হবে। এই পাইপ স্থাপনের কারণে কয়েক হাজার গাছ কাটা পড়বে। যেগুলো এখন বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ হিসেবে স্বীকৃত। একবার এসব বিরল প্রজাতির গাছ কাটা পড়লে তা একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এছাড়া পাইপ স্থাপনের ফলে আরও কয়েক হাজার উদ্ভিদের শেকড় কাটা পড়বে যা পর্যায়ক্রমে মৃতু্যর মুখে পতিত হবে। আবার বাঁশের খুঁটির সাহায্যে উঁচু করে পাইপ লাইন টানা হলে গাছপালার অনেক ৰতি হবে। গাছ কাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক গাছের ডালপালা ছাঁটতে হবে। কারণ প্রতিটি ড্রেজিং পাইপ ২০ ফুটের বেশি লম্বা। সেখানে গাছপালার ঘনত্ব এত বেশি যে গাছ না কেটে ২০ ফুট লম্বা পাইপ সরাসরি স্থাপনের কোন সুযোগ নেই। এর পাশাপাশি বিলুপ্তপ্রায় বিরল প্রজাতির পশুপাখি অভয়ারণ্য রয়েছে এ উদ্যানে। যারা প্রতিনিয়ত তাদের বংশ বিসত্মার করছে। প্রায় সব গাছের ডালে রয়েছে এসব পাখির বাসা। জানা গেছে, পাখির বংশ বিসত্মার নষ্ট হবে বিধায় উদ্যানে কর্তপৰের পৰ থেকে গাছের ডালপালা ছাঁটা নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু উঁচু করে পাইপ লাইন নেয়া হলেও গাছ কাটার পাশাপাশি গাছের ডালপালা ছাঁটতে হবে। অথচ প্রায় সব গাছের ডালপালায় রয়েছে পাখির বাসা। এছাড়া পাইপ লাইন বসানোর জন্য উদ্যানের তিনটি অংশের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে হাইজিং প্রকল্পের জন্য সরকার কেন জাতীয় উদ্যানকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তাছাড়া ট্রাকের মাধ্যমে বালু এনে রূপনগর হাউজিং প্রকল্পের কাজ করা সম্ভব। এর জন্য উদ্যান ব্যবহার করার কোন প্রয়োজন পড়ে না।
সম্প্রতি সরকার মাসুদ কনস্ট্রাকশন নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে হাউজিং প্রকল্পের মাটি ভরাটের জন্য পাইপ লাইন স্থাপনের অনুমতি দেয়। (যদিও আদালত ৪ সপ্তাহের জন্য এ কাজের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে) এর জন্য প্রতিদিনের ভাড়া বাবদ প্রতিষ্ঠানটি সরকারকে সাড়ে সাত হাজার টাকা প্রদান করবে। গাছপালা বা উদ্যানের ৰতিপূরণ হিসেবে ১০ লাখ টাকার চুক্তি করা হয়েছে। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এ উদ্যানে রয়েছে বিরল প্রজাতির কিছু উদ্ভিদ যা মাদার গাছ হিসেবে পরিচিত। এসব উদ্ভিদের স্বাভাবিক বংশ বিসত্মার সম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কোনের মাধ্যমে এসব প্রজাতির কিছু কিছু বংশ বিসত্মার করা সম্ভব হয়েছে। যেসব প্রজাতির বংশ বিসত্মার করা এখনও সম্ভব হয়নি সেসব প্রজাতি নিয়েও চলছে গবেষণা। এক শ' বছরে একবার ফুল দিয়ে মারা যায় এমন প্রজাতির কিছু উদ্ভিদ রয়েছে যেগুলো পাইপ লাইন টানা হলে ৰতি হতে পারে। একবার এসব প্রজাতির ৰতি হলে তা একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এসব প্রজাতির একটি গাছের ৰতি হলে কোটি টাকা দিয়েও ৰতিপূরণ করা যাবে না।
এছাড়া প্রতিদিন প্রায় কয়েক হাজার মানুষ নগরের যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পেতে চলে আসে এ উদ্যানে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ ও ছাত্রছাত্রীরা তাদের গবেষণা পরিচালনা করছেন এ উদ্যানের মাধ্যমে। অথচ পাইপ লাইন টানার অনুমতি দেয়া হলে মানুষের চলাচলের রাসত্মা ও ফুটপাথ ভেঙ্গে ফেলতে হবে।
বন বিভাগে কয়েক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, জাতীয় উদ্যান দেশের প্রজাতি সংরৰণ গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। কোনের মাধ্যমে অনেক নিশ্চিহ্ন প্রজাতির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। বাইরের কোন লোক এখন পর্যনত্ম উদ্যানের কোন গাছপালার ৰতি করেনি। কিনত্মু ড্রেজিং পাইপ লাইন স্থাপনের অনুমতি দেয়া হলে বাইরের লোকের উদ্যানের ভেতরে অবাধ প্রবেশের সুযোগ হবে। এসব বাইরের লোক উদ্যানের ভেতরে ঢুকে অনেক প্রজাতি নষ্ট করে ফেলতে পারে।
গাছপালার প্রজাতি সংরৰণের জন্য মিরপুরে ২০৮ একর জমির ওপরে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় উদ্যান। দেশী বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ সংগ্রহ, সংরৰণ ও জীনপুল তৈরির উদ্দেশ্যে এ উদ্যানকে ৫৭টি সেকশনে ভাগ করা হয়েছে। উদ্যানে ১১৭টি উদ্ভিদ পরিবার ভুক্ত ৯৫২ প্রজাতির গাছপালা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৫৬ প্রজাতির ৩৫ হাজার বৃৰ, ৩১০ প্রজাতির ১০ হাজার গুল্ম, ৩৮৬ প্রজাতির ১২ হাজার বিরম্নত ও লতা জাতীয় গাছ রয়েছে। সেকশন অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির আলাদা বাগান রয়েছে। এসব বাগানের মধ্যে রয়েছে গোলাপ বাগান, পাইন বাগান, ফলগাছের বাগান, বাঁশ বাগান, পাম গাছের বাগান, মৌসুমী বাগান, ঔষধি গাছের বাগান, পদ্ম পুকর, শাপলা পুকুর, ক্যাকটাস হাউস, অর্কিড হাইস ও ইন্ডোর গাছের জন্য নেট হাউস রয়েছে। জাতীয় উদ্যানে রয়েছে নানা প্রজাতির পাখি ও জীবজন্তুর অভয়ারণ্য, যেগুলো বিলুপ্তপ্রায়। এর মধ্যে রয়েছে তিলা ঘুঘু, সবুজ বর্ণের ঘুঘু, দোয়েল, শালিক, কাঠ ঠোকরা, হাড়িচাচা, কানাকুকা, পেঁচা, মুনিয়া, টুনটুনি, হলদে পাখি, মাছরাঙা প্রভৃতি। এগুলো গাছের ডালে বাসা বেঁধে বংশ বিসত্মার করছে। জীবজন্তুর মধ্যে রয়েছে শিয়াল, কাঠবিড়ালী, বন রম্নই, গুঁই সাপ, বেজি, ইঁদুর বিভিন্ন প্রজাতির গিরগিটি, কচ্ছপ, সাপ, এবং বিরল প্রজাতির ব্যাঙ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আবুল হাসান বলেন, উদ্যানের ভেতর দিয়ে ড্রেজিং লাইন টানা হলে গাছপালা বিরল প্রজাতির গাছপালার ৰতি হবে যা কোটি টাকা দিয়েও পূরণ করা সম্ভব নয়। একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মমতাজ বেগম বলেন, সরকার নিজেই যেখানে গাছপালা ও পরিবেশ রৰায় উদ্যোগ নিয়েছে সেখানে জাতীয় উদ্যানের ৰতি হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.