আমেরিকা ॥ আর্থিক বিপর্যয় এড়াতে by এনামুল হক

মার্কিন কংগ্রেস ও হোয়াইট হাউসের মধ্যে শেষ মুহূর্তের সমঝোতায় ‘ফিসক্যাল ক্লিফ’ নামক বিপর্যয়টি আপাতত এড়ানো সম্ভব হয়েছে যা নতুন বছরের শুরু থেকেই নেমে আসার কথা।
ফিসক্যাল ক্লিফ নিয়ে একটা আতঙ্কের ভাব ছিল। কেন? ফিসক্যাল ক্লিফ জিনিসটা কি? সেটা হলো ফেডারেল সরকারের কর বৃদ্ধি ও ব্যয় হ্রাসের কতিপয় ব্যবস্থা যা ২০১৩ সালের শুরু থেকে কার্যকর হবার কথা। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের একটা সমঝোতা হয় যার ফলে করবৃদ্ধি ও ব্যয় হ্রাস আপাতত কার্যকর না করার ব্যবস্থা হয়। সিনেট ফিসক্যাল ক্লিফ এড়াতে রাজি হয়। এ সংক্রান্ত সিনেটের প্রস্তাব সময়সীমা পার হওয়ার ২ ঘণ্টা পর পাস হয়। আর প্রতিনিধি পরিষদ ২১ ঘণ্টা পর সমঝোতাটি অনুমোদন করে। তবে সমঝোতায় যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে সেগুলো পেছনের তারিখ অর্থাৎ ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।
ফিসক্যাল ক্লিফ নিয়ে আতঙ্কের কারণ কর বৃদ্ধি ও ব্যয় হ্রাসের ফলে অর্থনীতির ওপর এক বিরাট চাপ এসে পড়ত অর্থনীতিতে মারাত্মক মন্থরতা সৃষ্টি হতো এবং দেশটা আবার এক ভয়াবহ মন্থরতার দিকে ধাবিত হতো। আগের প্রণীত আইনগুলোর কারণে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ২০১৩ সালে মোটামুটি অর্ধেক কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কংগ্রেসের বাজেট অফিসের হিসাবে ঘাটতি এত বেশি হ্রাসের ফলে ২০১৩ সালেই মাঝারি মাত্রার মন্দা দেখা দিতে পারত এবং বছরের দ্বিতীয়ার্ধে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়ে মোটামুটি ৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারত। পরিশেষে আমেরিকান ট্যাক্সপেয়ার রিলিফ এ্যাক্ট ২০১২ পাস করার মধ্য দিয়ে ফিসক্যাল ক্লিফ বহুলাংশে এড়ানো সম্ভব হয়েছে।
আগের প্রণীত যেসব আইনের পরিণতিতে ফিসক্যাল ক্লিফের সৃষ্টি হয় সেগুলোতে ধরে নেয়া হয়েছিল যে, ২০১২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অর্থবছরে রাজস্ব ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং ব্যয় হ্রাস পাবে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। এসব আইনের মধ্যে ছিল ২০১০ সালের কর রেয়াত আইনের অবসান এবং ২০১১ সালের বাজেট নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে পরিকল্পিত ব্যয় হ্রাসের ব্যবস্থা। প্রথমটিতে বুশের আমলের কর হ্রাসের সুবিধাটি দু’বছর বাড়িয়ে দেয়া হয়।
প্রেসিডেন্ট ওবামা গত ২ জানুয়ারি আমেরিকান করদাতা রেয়াত আইন ২০১২ -তে স্বাক্ষর দিয়ে সেটাকে আইনে পরিণত করেন এবং ফিসক্যাল ক্লিফের কর অংশের অনেকটাই বিলোপ করেন। এতে কংগ্রেস বাজেট অফিস হিসাব করে দেখে যে, ২০১৩ অর্থবছরে রাজস্ব ৮.১৩ শতাংশ বাড়বে এবং ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে ১.১৫ শতাংশ। এই আইনের ফলে ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে ঘাটতির পরিমাণ ১৫৭০০ কোটি ডলার কমে আসবে। অথচ ফিসক্যাল ক্লিফে ঘাটতি ৪৮৭০০ কোটি ডলার হ্রাস পেত বলে হিসাব করা হয়েছিল।
কিন্তু গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে হেইডি মুর বলেছেন, ফিসক্যাল ক্লিস সংক্রান্ত সমঝোতা এবং পরবর্তী পর্যায়ে আইন পাসের মধ্য দিয়ে কর বৃদ্ধি বন্ধ করা হয়নি, ঘাটতি কমানো হয়নি; ব্যয় হ্রাস ও পরিহার করা হয়নি। এটা কোন সমঝোতাই নয়। এর জন্য কাউকে বাহবা দিতে যাওয়া মানে কোন অগ্নিসংযোগকারীকে তারই লাগানো আগুন নিভিয়ে ফেলার জন্য পুরস্কৃত করা।
নিবন্ধে বলা হয়, কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার লক্ষ্য যদিও বুশ যুগের কর হ্রাসের মেয়াদ বছরে সাড়ে ৪ লাখ ডলার কি তারও বেশি উপার্জনকারীর ক্ষেত্রে বর্ধিত করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে রক্ষা করা, তথাপি এটাকে কর হ্রাস বলার উপায় নেই। বস্তুতপক্ষে সকল আমেরিকানকে ১ জানুয়ারি থেকে তাদের বেতনের চেকের মাধ্যমে বর্ধিত কর দিতে হবে। কারণ কংগ্রেস বেতন কর হ্রাস তুলে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা বেতন কর ২০১০ সালে ৬.২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪.২ শতাংশ করেছিলেন। এখন সেটা নেই। এখন এই কর বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে বছরে ৫০ হাজার ডলার আয় করে এমন আমেরিকানের পকেট থেকে বছরে ১ হাজার ডলার চলে যাবে।
ফিসক্যাল ক্লিফের মধ্যে যে অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় লুকিয়ে ছিল কংগ্রেসের সমঝোতায় তা পরিহার করা হয়নি; বরং এর মাধ্যমে মার্চ মাসে আরও বড় ক্লিফের তথা পর্বতের জন্ম দেয়া হয়েছে। কারণ আমূল ব্যয় হ্রাসের ব্যবস্থাকে দু’মাসের জন্য অব্যহতি দেয়া হয়েছে।
এই সমঝোতার ফলে মার্কিন সরকারের ঘাটতি প্রকৃতপক্ষে বাড়বে। অংশত এর কারণ হলো কর হ্রাস এখন ধনীদের অনেকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। প্রেসিডেন্ট যখন বছরে আড়াই লাখ ডলার বা তার বেশি আয়ের লোকদের কর বৃদ্ধির আওতায় আনতে চেয়েছিলেন ওরা ছিল মোট আমেরিকান করদাতার প্রায় ২ শতাংশ। এখন আগের কর হ্রাস তুলে দিয়ে তা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে সেসব আমেরিকানের জন্য, যাদের বার্ষিক আয় সাড়ে চার লাখ ডলার কি তারও বেশি। এদের সংখ্যা মার্কিন করদাতাদের ১ শতাংশেরও কম। তার মানে কর খাত থেকে ঘাটতি হ্রাসে কম অর্থ পাওয়া যাবে এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচীগুলোর ব্যয় অধিক পরিমাণে হ্রাস করে ঘাটতি কমানো হবে।
তবে কংগ্রেসের এ সমঝোতাকে ব্যর্থ বলা যাবে না; কারণ এতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলো একান্তই প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় কথা, এতে লাখ লাখ আমেরিকানের বেকার ভাতার মেয়াদ কমপক্ষে আরও এক বছর বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং কংগ্রেস সদস্যদের বেতন আপনা থেকে ৯০ কোটি ডলার বৃদ্ধির অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ বাতিল করা হয়েছে।
গবেষণা ও উন্নয়নের কাজে এবং ছাত্র ঋণের ক্ষেত্রে সুদ হ্রাস সম্প্রসারিত করা হয়েছে। সর্বোপরি বলা যায়, কিছু কিছু শুভঙ্করের ফাঁকি থাকা সত্ত্বেও ফিসক্যাল ক্লিফের বিপর্যয় এড়াতে ওবামা প্রশাসনের গৃহীত ব্যবস্থা আমেরিকানদের খানিকটা স্বস্তি এনে দিয়েছে।
সূত্র : গার্ডিয়ান/ওয়াশিংটন পোস্ট

No comments

Powered by Blogger.