অতিনিরপেক্ষতা জনস্বার্থবিরোধী by মুনতাসীর মামুন

ক্লাসরুমে ভাল শিক্ষক গেলে ক্লাসের পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ছাত্ররা মনোযোগী হয়, বিদ্যা গ্রহণে আগ্রহী হয়। শিক্ষার মান এভাবে বৃদ্ধি পায়। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ক্লাস করতে অনেকেই যেত যদিও তিনি ছিলেন বাংলার অধ্যাপক।
আদালতের অবস্থাও তাই। দু’পক্ষের আইনজীবী যদি অভিজ্ঞ ও নিজের বিষয়ে জানেন তাহলে আদালত কক্ষের পরিস্থিতিও পাল্টে যায়। নবীন বিচারকরাও অনেক কিছু জানতে পারেন, শিক্ষণীয় অনেক কিছু থাকে বিভিন্ন নজির স্থাপনে। আমি নিম্নআদালত থেকে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন শুনানিতে গেছি। নিম্নআদালতের অবস্থা হতাশাজনক। উচ্চ আদালতের অবস্থাও এমন কিছু উজ্জ্বল নয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি শুনানিতে গিয়ে আমার এসব কথা ফের মনে হলো। প্রসিকিউশন নিয়ে আমাদের অভিযোগ ছিল। আইনমন্ত্রী আগে তঁঁাঁর সুরাহা করেননি বা করতে চাননি। স্কাইপি ঘটনায় অনেকে হতাশ। যে নিরাপত্তা নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম সেগুলো সঠিক প্রমাণিত। এখন অনেকটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা। প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী কিসের ওপর ভিত্তি করে এত মন্তব্য করেন জানি না। প্রধানমন্ত্রীর হয়ত, হয়ত একটি ধারণা দেশের যাবতীয় বিষয়ে। এমনকি জনগণের মনের বিষয়ে তার খুব ভাল ধারণা আছে। অভিজ্ঞতায় বলব, ভাল ধারণা থাকতে পারে, অনেক বিষয়ে তাঁকে যে জানানো হয় না সেটি তাঁর ধারণার বাইরে। জেদ করে সব কিছু কার্যকর করা যায় না। কেউ পারেনি যদি না মানুষ সঙ্গে থাকে।
স্কাইপি ঘটনা জামায়াত-বিএনপি ষড়যন্ত্রের প্রথম সাফল্য। মীর কাশেম আলীর ২৫ মিলিয়ন ডলারের লবিস্ট নিয়োগ, বিএনপি-জামায়াতের দেশের ভেতর পুলিশের ওপর হামলা, ভাংচুর, পাকিস্তান-সৌদি-তুরস্ক লবির চেষ্টা কোন কিছুই সাফল্য এনে দেয়নি যা দিয়েছে স্কাইপি ঘটনা। এর জন্য কত টাকা খরচ করতে হয়েছে জানি না। তবে ঘটনাটি প্রথমে সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাগজে যা ছাপা হয়েছে [তা জাল না জুয়াচুরি জানি না] তাতে একটি বিষয় স্পষ্টÑ প্রসিকিউশনে ঝামেলা হচ্ছে। মামলা চলছে বটে, কিন্তু শ্লথগতিতে। প্রসিকিউশনে নেতৃত্ব নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব হচ্ছে। এসব কিছুর, যদি অঘটন ঘটে, তবে বলাবাহুল্য আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর দায়দায়িত্ব পড়বে এবং সেক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়কে তার অবিমৃষ্যকারিতার ফল ভোগ করতে হবে। কেউ তাদের পাশে দাঁড়াবে না।
স্কাইপির সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে স্বভাবিকভাবে আসামি পক্ষ আরও ফায়দা লুটতে চেয়েছে। বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করে সেই সুযোগটা বৃদ্ধি করেছেন। তারা রি-ট্রায়াল বা পুনর্বিচার চেয়েছে। বিএনপির মওদুদ আহমদ এই দাবি করেছেন। তাঁদের আরেক স্তম্ভ খন্দকার মাহবুব হোসেন হাইকোর্ট থেকেও নিজামুল হকের পদত্যাগ চেয়েছেন। এই নিয়ে আসামি পক্ষ ভোম্বা সাইজের নথিপত্র দিয়ে আবেদন করে। তারা যে কোনভাবে আর আট মাস বিচার প্রক্রিয়া ও রায় প্রদান স্থগিত রাখতে চায় বা শ্লথ করতে চায়। তাদের ধারণা, আগামী নির্বাচনে তারা জয়লাভ করবে। এবং তারপর ট্রাইব্যুনাল বাতিল করবে। এবং তখন তাদের ‘অপমান’ করার জন্য ট্রাইব্যুনালের উদ্যোক্তা ও জড়িতদের বিচার করবে।
গোলাম আযম, সাঈদীর মামলার পুনর্বিচারের শুনানিতে গিয়েছিলাম যুক্তিতর্ক শুনতে। নতুন কিছু জানা যায় কি না সে বিষয়েও আগ্রহ ছিল। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সরকারের পক্ষাবলম্বন করবেন। অন্যপক্ষে ব্যারিস্টার রাজ্জাকসহ বাকি আইনজীবীরা। আসামি পক্ষের মূল যুক্তি ছিল, বিচারক বাইরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন; সেই ‘বিশেষজ্ঞ’ যেভাবে বলেছেন সেভাবে নিজামুল হক কাজ করেছেন, তিনি প্রসিকিউশনের সঙ্গে আলাদা আলাপ করেছেন। সুতরাং নির্দেশিত হয়ে তিনি কাজ করছেন। প্রমাণ হিসেবে তারা স্কাইপির কথোপকথন ও ই-মেইলের ভোম্বা প্রমাণপত্র দাখিল করে। এ্যাটর্নি জেনারেল এই প্রথম ট্রাইব্যুনালে এলেন কি না জানি না। আগে এলেও হয়ত সামান্য সময়ের জন্য এসেছেন। এবার এলেন দীর্ঘ শুনানিতে। সরকারপক্ষ সমর্থনের জন্য তিনি আসতে পারেন; কিন্তু এটি একদিকে তুলে ধরে প্রসিকিউশনের দুর্বলতা।
ব্যারিস্টার রাজ্জাকের যুক্তি আমি এখানে শুনিনি, তবে উচ্চ আদালতে তার যুক্তি আমি শুনেছি এবং আমার মনে হয়েছে জোরালভাবে এবং খুব শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে তিনি যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন। এবার শুনলাম মাহবুবে আলমের যুক্তি। এবং তখন আমার মনে হলো, প্রসিকিউশনে যদি তাঁর মতো আইনজীবী থাকতেন তাহলে এই বিচারের মান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারতেন না, আইনের ব্যাখ্যার নতুন দিক উন্মোচিত হতো এবং আদালতের শুনানি উপভোগ্য হতো। কারণ আসামি পক্ষও তখন বাধ্য হয়ে সমমাপের আইনজীবী দিত। অবশ্য দিচ্ছেও। তাদের পক্ষে অনিয়মিত খন্দকার মাহবুব, রাজ্জাক, মওদুদ আসেন। বাদীপক্ষে ওই মাপের কেউ আসেন না। এতে আমাদের কর্তাদের মনের দারিদ্র্য, সঙ্কীর্ণ চিন্তা, অদূরদর্শিতা, অজ্ঞতা এবং উপযুক্ত পরামর্শ না নেয়ার প্রবণতা [যার ভিত্তি ঠুনকো দম্ভ] প্রকাশিত হয়েছে মাত্র।
আসামি পক্ষের আইনজীবীরা আবেগ, নাটক করে অনেক কথা বললেন, একই কথা বার বার বলতে লাগলেন একঘেয়ে সুরে। বিচারকরাও মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন। তখন বুঝলাম, আইনজীবী বা বিচারক হওয়ার উচ্চাশা পোষণ না করে ভালই করেছি। আজেবাজে যুক্তিতর্ক শোনায় বিচারকদের অসীম ধৈর্য আমাকে শুধু বিস্মিত নয়, চমৎকৃত করেছে। আসামিদের মূল একটি বক্তব্য প্রায় দিন তিনেক শুনানি হয়েছে। মাঝে একদিন ব্যারিস্টার রাজ্জাক কিছু নজির দেখিয়ে যুক্তি স্থাপন করেছিলেন। মাহবুবে আলম মাত্র ঘণ্টা দুয়েক বললেন। আমার মনে হয়, শুধু আমি নই আসামিপক্ষও চমৎকৃত হয়েছিল। তিনি আসামিপক্ষের যুক্তিগুলো তো নস্যাত করলেনই বরং আসামিপক্ষ কী অন্যায় করেছে সেটিও তুলে ধরলেন। তখনই মনে হলো, আইনজীবী ও বিচারকের দক্ষতা নির্ধারণ করে আদালতের মান।
মাহবুবে আলম যখন যুক্তি উপস্থাপন করছিলেন তখনই বোঝা গেল ব্রিফ আদ্যোপান্ত পড়ে এসেছেন তিনি। আগে এ আদালতে এলে আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক দেখে তা মনে হতো না। তিনি আসামিপক্ষের মূল যুক্তির বিপক্ষে দুটি কথা বললেন। অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিধিতেই আছে, বিচারপতি দেশে-বিদেশে যে কোন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন। শুধু তাই নয়, এ আদালতেই বিচারপতিকে বার বার বলেছেন, আইনটি নতুন; সুতরাং এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য সব পক্ষের সঙ্গেই প্রয়োজনে আলোচনা করতে হবে। আমার মনে আছে, আমি যখন গোলাম আযমের মামলায় সাক্ষ্য দিতে যাই, তখনও তিনি খোলা আদালতে একই মন্তব্য করেছিলেন। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও বাধ্য হয়ে বলেছিলাম, যে প্রক্রিয়ায় আদালত চলছে তা ফৌজদারী আদালতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, আন্তর্জাতিক আদালতের আইনের সঙ্গে নয়। এখানে জনান্তিকে বলে রাখি, আইনটি যথেষ্ট ছিল। বিচারকদের এত বিধি তৈরি যথার্থ হয়নি। তখন বিচারপতি নিজামূুল হক বলেছিলেন, ‘ট্রায়াল এ্যান্ড এরর’ পদ্ধতিতেই আমরা এগোচ্ছি। তখন সবাই বিষয়টি এপ্রিসিয়েট করেছেন। এখন আসামিপক্ষ উল্টো কথা বলছে। আসলে বিচারপতি হকের সারল্য তাঁর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জামায়াত কী জিনিস সে বিষয়ে তাঁর সম্যক কোন ধারণা নেই।
এ্যাটর্নি জেনারেল বললেন, সুতরাং বিচারপতি যদি কোন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেও থাকেন সেটি আইনের অন্তর্গত। এক্ষেত্রে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের নজিরগুলো যে অপ্রাসঙ্গিক তাও তুলে ধরেন। তাছাড়া যে চার্জশীট নিয়ে তাঁরা আপত্তি তুলছে সেটিও তো যথার্থ নয়। আসামিপক্ষের দাবি ছিল চার্জশীট বাইরে থেকে লিখে দেয়া হয়েছে। এ সময় বিচারপতি ফজলে কবির বলেন, চার্জশীটের খসড়া তো তাঁর নিজের লেখা। আসলে মূল আইনে চার্জশীট নিয়ে এত ঝামেলা নেই। মাহবুবে আলম হেসে বললেন, আসামিপক্ষের ধারণা এত বিশাল নথি কে পড়বে। কিন্তু আমি পড়েছি। মিলটা কোথায় বলুন? তারপর প্রায় আধাঘণ্টা অমিলগুলো তুলে ধরলেন। তারপর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন যা আমরা আইনজীবী না হয়েও গত তিন বছর বলে আসছি। মাহবুবে আলম বললেন, টিক্কা খানের সঙ্গে আলোচনারত গোলাম আযমের একটি ছবিই এই আইন অনুযায়ী তাকে অভিযুক্ত করার জন্য যথেষ্ট। শুধু তাই নয়, তদন্ত কর্মকর্তারা ১৯৭১ সালে গোলাম আযমের বিভিন্ন কার্যাবলী ও বক্তব্যের যে ডকুমেন্টেশন ও ইনডেক্স করে দিয়েছে তাতে তো এত সাক্ষীসাবুদ আর শুনানির দরকার পড়ে না। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের কোন পক্ষ এই আইনের মূল স্পিরিটটা নিতে চায়নি। বাদী ও আসামিপক্ষের ফৌজদারী আদালতের মনোভাব ও বিচারকদের অতিনিরপেক্ষতা দেখানোর প্রবণতা বিচার প্রক্রিয়া শ্লথ করেছে। এ প্রসঙ্গে শাহরিয়ার কবিরের একটি মন্তব্যের উল্লেখ করছি। কোন এক টকশোতে তিনি এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়াস করিম ছিলেন। আমি টকশোতে খুব একটা যাই না এবং দ্রুত ঘুমিয়ে পাড়ি দেখে তা দেখাও হয় না। কয়েকজন বললেন, ড. পিয়াস করিম খুবই স্মার্র্ট এবং ঝকঝকে বুদ্ধিজীবী। তাঁর মতো এত সুন্দর করে জামায়াতের পক্ষে জামায়াতীরাও বলতে পারবে না। তা ওই দিনের টকশোতে এই স্কাইপি নিয়েই বোধহয় কথা হচ্ছিল। শাহরিয়ার এক পর্যায়ে বলেছিলেন যে চুরি করে, চোরাই মাল রাখে, বিক্রি করে এবং কেনে সবাই অপরাধী। এটা কমনসেন্সের ব্যাপার। এটি আমার কাজের বুয়াও জানে; তার জন্য ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হতে হয় না।
এ্যাটর্নি জেনারেল আরেকটি যুক্তি দিয়েছিলেন। সাইবার ক্রাইম দেশী ও বিদেশী আইনে অপরাধ। স্কাইপি পয়সার বিনিময়ে চুরি করা হয়েছে হয় ঢাকা না হয় ব্রাসেলস থেকে। সেটি আদালতে পেশ করা তো অপরাধ।
এই বিষয়টি নিয়েও আমরা লেখালেখি করেছি। দৈনিক আমার দেশে কয়েক দিন ধরে স্কাইপির কথোপকথন প্রকাশিত হয়েছে। এটি অপরাধ। এই অপরাধের জন্য সরকার কোন ব্যবস্থা নেয়নি। সাংবাদিকরা প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে দাবি তোলেন। পরামর্শ দেন, কিন্তু সংবাদপত্রের এই সাংবাদিকরা সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে টু শব্দটিও করেননি। অর্থাৎ তঁাঁরা নিরপেক্ষ তো ননই, বরং নিজেদের অপরাধ এড়িয়ে যেতে চান। আর সরকারে, সাংবাদিকদের মাঝে মাহমুদুর রহমানের নিশ্চয় অনেক লোক আছে। যেমন মীর কাশেমের মানি লন্ডারিংয়ের ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক বা দুদক- সবাই নিশ্চুপ। যিনি ২৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে পারেন বিদেশে তিনি ১ মিলিয়ন হয়ত ঢাকায়ও খরচ করেছেন। শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কালোদের কিনতে খরচ কম লাগে।
এ্যাটর্নি জেনারেল যা বলেছেন এবং যেভাবে বলেছেন তা পুরো আদালত নিশ্চুপে শুনেছে। আর আমার মতো প্রান্তিক মানুষের চোখেও ধরা পড়েছে, প্রসিকিউশনের ঘাটতি। ওই পর্যায়ে যুক্তিকর্ত করা তাদের পক্ষে দুরূহ। আর পড়াশোনা তো আরও কষ্টকর।
সুতরাং স্কাইপি হামলায় সরকারের বিচলিত হওয়ার কিছু ছিল না; তবুও হয়েছে যেহেতু তাদের এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা কম, সমন্বয়ও নেই। আর তাদের হয়ত ধারণা, অন্যের পরামর্শ গ্রহণ করলে যদি নিজের কৃতিত্ব হ্রাস পায়!
এরপর দেখি, খন্দকার মাহবুব বার কাউন্সিলের নেতা হিসেবে হাইকোর্টের জজ পদে থেকেও নিজামুল হকের পদত্যাগ চান। কারণ নৈতিকতা। তা খন্দকার মাহবুবের নৈতিকতা কতটুকু? ১৯৭৩ সালে রাজাকারদের বিরুদ্ধে তিনি কোর্টে দাঁড়িয়েছেন। আর এখন দাঁড়াচ্ছেন রাজাকার-আলবদরদের পক্ষে। আসলে আমাদের মধ্যে খবিশদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে স্যুট-কোট পরা লোকদের মধ্যে। যার নৈতিকতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই তিনি দাবি তোলেন বিচারকের পদত্যাগের।
এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ১৯৭৩ সালের দালাল আইনে যাদের বিচার হয়েছিল তিনি তখন প্রসিকিউটর ছিলেন। দালাল আইনে বিচারে প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করে তিনিই আজ কিভাবে আসামিপক্ষ হয়ে শুনানি করতে আসেন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এ্যাটর্নি জেনারেল।
মাহবুবে আলম বলেন, দালাল আইনে যাদের বিচার হয়েছিল তারা ’৭১-এ অপরাধ করেছিল ব্যক্তিগতভাবে। আর এখন যাদের বিচার করা হচ্ছে তারা অপরাধ করেছে দলের নেতা হিসেবে। ক্ষমার বিষয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেনের উক্তির প্রতিউত্তরে মাহবুবে আলম বলেন, তিনি কি বলতে চান চোরের অপরাধ ক্ষমা করা হয়েছে তাই বলে কি ডাকাতির অপরাধের বিচার হবে না। জনকণ্ঠ ১-১-১৩
ট্রাইব্যুনাল আসামি পক্ষের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। কিন্তু এ প্রশ্ন তো মানুষ করতে পারে, পুনর্বিচারের আইন যেখানে নেই সেখানে শুনানি কেন হবে? চোরাই মাল আদালতে পেশ করলে তা অপরাধ হবে না কেন? এবং যারা এ কাজটি করেছে তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না? চোরাই ই-মেইল ও স্কাইপি আদালতে পেশের অনুমতি ও শুনানি সাইবার ক্রাইমকে প্রশ্রয় দেয়া হলো কি না? এই যে মূল্যবান সময়টুকুর অপচয় হলো এর দায়দায়িত্ব নেবে কে? ট্রাইব্যুনাল-২ সময়ক্ষেপণের জন্য কাদের মোল্লাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে একটি ভাল নজির স্থাপন করেছে।
এত ঘটনার পরও ট্রাইব্যুনালের অবকাঠামোগত উন্নয়নে, যে কাঠামো তিন বছর আমাদের চিৎকারের পর এবং বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আমলে অনুমোদিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর তাঁর সচিবালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল শোনা গেছে ২৭ দিন এবং তারপর অর্থসচিব আটকে রেখেছেন। একই পরিণাম হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে। জনপ্রশাসনের কোন কর্মকর্তা জনবল কেটে দিয়েছেন। এখানে জনবল যে মিনিমাম, কাটার উপায়ও নেই এ কথা তাদের বোঝানো দুষ্কর। দুঃখও হয় শেখ হাসিনার জন্য, এমন সব লোকদের দিয়ে কাজ করাতে হয় যারা গাধা ও গরুর পার্থক্যও বোঝে না। প্রসিকিউশনে নাকি নতুন যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে দুজন বিএনপিপন্থী এবং একজন ব্যারিস্টার মওদুদের জুনিয়র। এতে অনেকেই ক্ষুব্ধ। স্কাইপির ঘটনার পর এটিকে স্যাবোটাজ মনে করেন অনেকে। নিরাপত্তা ব্যবস্থারও পদ বাদ দেয়া হয়েছে স্কাইপি এবং তুরস্কের ঘটনার পরও। ট্রাইব্যুনালের তিন বছর পরও যদি অবকাঠামো উন্নয়নের অবস্থা এমন হয় তখন মন্ত্রী থেকে কর্মকর্তার সদিচ্ছা সম্পর্কে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। জামায়াত যে পরিমাণ টাকা বিলাচ্ছে বলে শুনছি সে কারণেও যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়া বার বার থেমে যাচ্ছে কি না কে জানে! আরও আছে, যদি রায় সরকারের পক্ষে যায় তাহলে অপর পক্ষ সুপ্রীমকোর্টে যাবে। এই প্রসিকিউশন দিয়ে আর যাই হোক সুপ্রীমকোর্টে লড়া যাবে না। এবং বিচারের রায় যদি না হয় এবং হওয়ার পর তা যদি কার্যকর না হয় তাহলে কোন কর্মকর্তার বা মন্ত্রীর কিছু হবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা অনেক কিছু হারাবেন। এর মধ্যে একটি হলো মানুষের বিশ্বাস। তাঁর ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে। পিতা হারানোর মতোই শোকাবহ ঘটনা হবে এটি।
এত কিছু বলার পরও আমরা তাঁর কর্মক্ষমতা ও ট্রাইব্যুনালের ওপর বিশ্বাস হারাতে চাই না। চিহ্নিত প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে পারলে এখনই আবার সবার মনোবল চাঙ্গা হয়ে উঠবে। স্কাইপিতে নাকি বিচারক হক বলেছিলেন, সরকার রায়ের জন্য পাগল হইয়া গেছে। তিনি সামান্য ভুল করেছিলেন। জামায়াত-বিএনপি ছাড়া সারাদেশের মানুষই রায় শোনার জন্য পাগল হয়ে গেছে। তাদের আর্তির কারণেই মন্ত্রীদের রায়ের বিষয়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিতে হচ্ছে যা তাদের দেয়া উচিত নয়।
আসামিপক্ষের বিচার শ্লথ করার প্রক্রিয়া এবং তাতে প্রশ্রয় দেয়ায় মানুষ খুব ক্ষুব্ধ। বিচারপতি নিজামুল হক যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে কাজ করলেও আসামিপক্ষকে এত বেশি সুযোগ দিয়েছেন, যে কারণে সময়ের অনেক অপচয় হয়েছে। বিদ্যমান আইনেও আসামিপক্ষকে অনেক সুবিধা দেয়া হয়েছে যা এ ধরনের আন্তর্জাতিক কোন আইনে নেই। নিরপেক্ষতা ভাল। কিন্তু অতিনিরপেক্ষতা জনস্বার্থবিরোধী। এ দেশের মানুষ ক্ষেপলে কী করবে তা কেউ বলতে পারে না। এ কথা আমাদের জন্য যেমন, তেমনই প্রধানমন্ত্রী থেকে বিচারক সবার জন্যই প্রযোজ্য। নুরেমবার্গ বিচারে বিচারকরা ৯ মাসে ২৪ জনের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন এটি যেন আমরা মনে রাখি।

No comments

Powered by Blogger.