৫ম সংশোধনী বাতিলের ভেতর দিয়ে বাংলা ভাষা আবার সাংবিধানিক প্রাধান্য পেল ফেব্রুয়ারিতে- স্বদেশ রায়

১৯৭২ সালের সংবিধানের বা মূল সংবিধানের ১৫৩ (৩) এর শর্তে বলা ছিল, ' তবে শর্ত থাকে যে, বাংলা ও ইংরেজী পাঠের ভেতর বিরোধের েেত্র বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে'। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে সংবিধানের এই অংশ বদল করেন।
বদল করে তিনি বাংলার বদলে ইংরেজীকে প্রাধান্য দেবার বিষয়টি সংবিধানের অংশ করেন। ৫ম সংশোধনীতে এটা সংবিধানের অংশ করে সেখানে বলা হয়, 'সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজী পাঠের মধ্যে কোন বিরোধ, বৈপরীত্য, অসংগতি বা অসামঞ্জস্যতার েেত্র যতদূর তাহা উক্ত ফরমান সমূহদ্বারা সংবিধানের কোন পাঠ কিংবা উভয় পাঠের কোন সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন অথবা বিলোপ সাধন সম্পর্কিত হয়, ইংরেজী পাঠ প্রাধান্য পাইবে।' ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে এভাবে সংবিধানে ও রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার প্রাধান্য খর্ব করা হয়। এভাবেই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর এভাবে জিয়াউর রহমান বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় স্তরে নামিয়ে আনেন। বাংলা ভাষার এই নিম্ন অবস্থানকে তিনি সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেন। বিষয়টি যদি আমরা সাধারণভাবে দেখি তাহলে মনে হয়, এটা আর এমনকি, বাংলার জায়গায় ইংরেজী প্রাধান্য পাবে এটুকুই তো! কোন কোন লেখক ও গবেষক বলেছেন, জিয়াউর রহমানের সারাজীবন কেটেছে পাকিস্তানে। তিনি উর্দু ও ইংরেজীতে স্বাচ্ছন্দ ছিলেন বলে এ কাজ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি বাঙালী সংস্কৃতি বৈরী বলে এ কাজ করেছিলেন। এসব গবেষক ও লেখকের বক্তব্য আংশিক সত্য। জিয়াউর রহমান মোটেই বাংলায় স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন না। তিনি বাংলা শুদ্ধভাবে বলতেও পারতেন না। বাঙালী সংস্কৃতি বৈরীও তিনি ছিলেন। তার পরেও বিষয়টি মোটেই কেবল ব্যক্তি জিয়াউর রহমানের রুচির ও শিার বিষয় নয়। তিনি বাংলা জানতেন না, বাঙালী সংস্কৃতি বৈরী ছিলেন বলে এ কাজ করা তার প েসহজ হয়েছে। তার কোন বিবেক তাকে বাধা দেয়নি। এমনকি তাকে বাধা দেয়নি কোন ইতিহাস বা ঐতিহ্য। তারপ েসহজ হয়েছে, একটি জাতির ত্রিশ ল শহীদ, সাড়ে চার ল সম্ভ্রমহারা মা-বোনের এবং দীর্ঘ বাইশ বছরের মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এ কাজ করা। কারণ, সংবিধানে যখনই বাংলার প্রাধান্যকে অস্বীকার করা হয়েছে, তখনই অস্বীকার করা হয়েছে আমাদের জাতি-রাষ্ট্রকে। আমাদের বাইশ বছরের মুক্তিসংগ্রামকে। এই দীর্ঘ সংগ্রামের সকল শহীদকে।
কোন রক্ত, বর্ণ, ধর্ম বা গোত্র আমাদের জাতি-রাষ্ট্রের ভিত্তি নয়। আমাদের জাতি-রাষ্ট্রের ভিত্তি ভাষা। শত্রুও আমাদের এই ভিত্তিকে ভালভাবে চেনে। তাই পাকিস্তান নামক একটি অস্বাভাবিক রাষ্ট্র সৃষ্টি হবার পরে আমাদের ভাষাকে ধ্বংস করতেই তারা প্রথম চেয়েছিল। তাই শিতি, অশিতি কোন বাঙালীর বুঝতে কোন কষ্ট হয়নি, পাকিস্তানীরা আমাদের ভাষাকে ধ্বংস করার ভেতর দিয়ে আমাদের চিরতরে ধ্বংস করতে চাচ্ছে। বাঙালী তাই ১৯৪৮ সাল থেকে তার ভাষা রার জন্য রাজপথে নেমে আসে। ভাষার জন্য বুক পেতে দেয়। এবং ১৯৫২তে যেদিন বুক গুলিতে বিদীর্ণ হয় সেদিনই স্থির হয়ে যায়, জাতি রাষ্ট্র ছাড়া এই ভাষাকে রা করা যাবে না। সেদিন থেকেই তাই শুরু হয় আমাদের 'জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম'। তাই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ২২ বছরের সংগ্রাম। ২২ বছরের এই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ভাষাভিত্তিক এ জাতি তার ভাষাভিত্তিক জাতিগত পরিচয় ও জাতি রাষ্ট্রের স্থান বিশ্ব বুকে স্থাপন করে। তাই ১৯৪৮ বা ১৯৫২ থেকে আমাদের এই মুক্তিসংগ্রাম নয়, বিশ্ববুকে জাতি হিসেবে, একটি জাতি-রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে আমরা যতদিন টিকে থাকব তারও ভিত্তি এই ভাষা। বাংলা ভাষা না থাকলে বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশ থাকবে না।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ছিল মূলত বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশকে ধ্বংস করার চেষ্টা। পাকিস্তান আমলে যে কাজ শুরু হয়েছিল, ১৯৭১ এ গণহত্যার মাধ্যমে পাকিস্তানীরা যা করতে চেয়েছিল তারই একটি ধারাবাহিকতা। ১৯৭১ সালে তারা পরাজিত হয় বটে কিন্তু থেমে থাকেনি। ভিন্নপথে তারা আবার বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশকে ধ্বংস করার কাজে নামে। জাতি ও দেশকে ধ্বংস করার জন্য তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা প্রথমে জাতির জনক ও জাতির অন্যতম স্থপতিদের হত্যা করে। এরপরেই তারা হত্যা করার কাজে নামে সংবিধানকে। শত্রু সব সময়ই ভালভাবে জানে তার প্রতিপরে শক্তি কোথায়। দেশ ও জাতি ধ্বংসকারী এই সামরিক ও বেসামরিক গোষ্ঠীও তাই জানত বাঙালীর মূল প্রাণশক্তি তার ভাষা। আর এ ভাষার অস্তিত্ব রা কবজ হিসেবে অর্জিত হয়েছে জাতির সংবিধান। তাই প্রথমেই তারা উদ্যোগ নেয়, এই সংবিধান থেকে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রা কবজ ধ্বংস করার। আমাদের সংবিধানের প্রথমভাগের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, ' প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা'। জিয়াউর রহমান বা দেশ ও জাতি ধ্বংসকারী ওই গোষ্ঠী রাতের অন্ধকারে জাতির জনককে হত্যা করলেও তারা সরাসরি সংবিধান থেকে ওই ধারা বাদ দিতে সাহসী হয়নি। তাই তারা কৌশলে বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করার কাজে নামে। অর্থাৎ সংবিধানের ১৫৩-এর শর্ত পরিবর্তন করে বাংলার বদলে ইংরেজীর প্রাধান্যর স্বীকৃতি দিয়ে মূলত সংবিধানে বাংলাকে দ্বিতীয় সারিতে নামিয়ে আনে। সূচনা করে বাংলা ভাষার মৃতু্য এবং এর ফল কেমন দাঁড়ায় তা বাংলা একাডেমীর একটি গবেষণা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, 'রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হেরফের ভাষা ব্যবহারের েেত্র জনগণের মানসিকতায় যে পরিবর্তন ঘটায় তাহার একটি বিশ্লেষণাত্মক পরিচিতি পাওয়া যায় বিভিন্ন জেলা সার্কিট হাউসের ভিজিটরস বুক পরীার মাধ্যমে। ল্য করা যায় যে, ১৯৭২ হতে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত অতিথিগণ ওই সকল রেজিস্ট্রারে বাংলা ভাষায় নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট হইতে প্রায় সকল ভিজিটরস বুকের তথ্য পূরণে ইংরেজী ভাষা আপনাআপনি চালু হইয়া যায়।' এরপরে ধীরে ধীরে কী অবস্থা দাঁড়িয়েছে সেটা দেশের মানুষ জানে। কারণ দেশের সংবিধানে যে ভাষার প্রাধান্য বা সর্বোচ্চ ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি নেই বাস্তবে তার অবস্থা যে দুয়োরানীর সন্তান হবে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু এর পাশাপাশি একটি অমোঘ সত্য আছে পৃথিবীতে। এ সত্য হলো সত্যিকার কোন জাতিকে কোন ভাষাকে কখনই ধ্বংস করা যায় না। তাকে সাময়িক চেপে রাখা যায়। তার অনেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে বনসাই করার চেষ্টা করা যায়। কিন্তু ছাই চাপা আগুনের মতো বা সাময়িক হ্যাঙ হওয়া সফটওয়ারের মতো এক সময়ে সে আবার আপন মূর্তিতে ফিরে আসে। ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি যেমন বাংলাভাষা শত্রু মুক্ত হবার পথ খুলে দিয়েছিল ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আবার বাংলাভাষা শত্রুমুক্ত হবার পথ খুঁজে পেল।
২ ফেব্রুয়ারি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছে। এর ফলে দেশের সংবিধান আবার ১৯৭২ এর সংবিধানে ফিরে যেতে বাধ্য। দেশের সংবিধান থেকে ৫ম সংশোধনী বাতিল হলে আবার সংবিধানের ১৫৩ এর শর্ত ফিরে আসবে। অর্থাৎ আবার সংবিধানে লেখা ধাকবে, সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজী পাঠের ভিতর কোন বিরোধ হলে বাংলা প্রাধান্য পাবে। জিয়াউর রহমান সুচতুর পথে বাংলাদেশে বাংলা ভাষার যে প্রাধান্য নষ্ট করেছিলেন সেখান থেকে ফিরে আসবে বাংলা ভাষা। ইতিহাসের কী অমোঘ নিয়ম বাংলার এই বিজয় ফিরে এলো ভাষা শহীদের মাস ফেব্রুয়ারি মাসে। বাংলা ভাষার এই বিজয় ঘটেছে ৫ম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে। তাই ৫ম সংশোধনী বাতিলের এই রায় শুধু ঐতিহাসিক রায় নয়, এটা আমাদের অস্তিত্বের পরে রায়। কারণ এই রায়ের ফলে বাংলা ভাষা টিকে থাকার পথ পেল। আর বাংলা ভাষা টিকে থাকলে বাঙালী জাতি টিকে থাকবে। বাঙালী জাতি টিকে থাকার পরেই নির্ভর করে বাঙালী জাতি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। দেশের সর্বোচ্চ আদালত ৫ম সংশোধনী বাতিল করে মূলত দেশের অস্তিত্ব রা করল। তাই হাইকোর্ট থেকে সুপ্রীমকোর্ট অবধি যে বিচারকগণ এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করলেন তারা যেমন বরণীয় বিচারক হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাবেন তেমনি স্থান পাবেন জাতির মুক্তিকামী বীর সন্তান হিসেবেও । আর এর যারা বিরোধিতা করেছিলেন তারা তাদের পরিচিতি এবারও একাত্তরের মতোই হবে_ তারা ২০১০-এর রাজাকার।
্রষটঢণ্রদরমহআথবটধফ.ডমব

No comments

Powered by Blogger.