বেসামাল পাকিসত্মানের ক্রিকেট!

৩ মার্চ, ২০০৯। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের কাছে লঙ্কান ক্রিকেটারদের নিয়ে বহনকারী বাসে বন্দুকধারীদের উপযপুরি গুলিবর্ষণ। নিহত ছয় পাক পুলিশ এবং দুই সাধারণ পথচারী। ভাগ্যক্রমে হত হননি কোন লংকান ক্রিকেটার।
কিন্তু মারাত্মক আহত হন ছয়জন। এমন ঘটনায় বিশ্ব ক্রিকেটে সমালোচনার ঝড় ওঠে। দাবি করা হয় সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে শাসত্মি দেয়ার। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে জাতীয় খেলোয়াড়দের উপর এমন সন্ত্রাসী আক্রমণ দ্বিতীয় বারের মতো। প্রথমবার ১৯৭২ সালে জার্মানির মিউনিখ অলিম্পিকে। মিউনিখে প্যালেস্টাইন সশস্ত্র বন্দুকধারীরা গুলি করে হত্যা করেছিল বেশ ১৩ জন ইসরাইলি এ্যাথলেটকে। মধ্যপ্রাচ্যে এই দুই দেশের মধ্যে এখনও চলছে রক্তয়ী সংঘর্ষ। ফলে এই দুই দেশের খেলাধুলাতো শিকেয় উঠেছে। ফিলিসত্মিন-ইসরাইলের সংঘর্ষ তো আজন্ম থেকেই। কিন্তু পাকিসত্মানের শত্রম্ন ঘরের মধ্যেই। লাগাতার আত্মঘাতী বোমা হামলায় যেমন বিপর্যসত্ম পাকিসত্মানের রাজনীতি তেমনি এর প্রভাব পড়ছে ক্রীড়াঙ্গনেও। লাহোরে লঙ্কান ক্রিকেটারদের ওপর হামলার পর খুব খারাপ পরিস্থিতি এখন দেশটির ক্রিকেটে। এমন ন্যাক্কারজনক হামলার পর তাদের ওপর যেন নেমে আসে অভিশাপের কালো ছায়া। একে একে বন্ধ হতে থাকে সব আলোর দরজা। নিরাপত্তার প্রশ্নে ২০১১ সালের বিশ্বকাপের সহযোগী আয়োজকের সুযোগ হারায় পাকিসত্মান। সার্বিক নিরাপত্তা সহনীয় না হওয়া পর্যনত্ম পাকিসত্মানের মাটিতে সব ধরনের আনত্মর্জাতিক ম্যাচের সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়ে । এখানে আসতে সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের আপত্তি। এরপর বিদেশের মাটিতে পাক দলের সাম্প্রতিক বাজে পারফরমেন্স যোগ করেছে সমালোচনার নতুন মাত্রা। কেউ বলছে অধিনায়ক পরিবর্তন কর। কেউ বলছে বোর্ডের চেয়ারম্যানকে সরিয়ে ফেল। আবার কেউ বলছে টি-২০ ক্রিকেটই সব শেষ করে দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতির জের ধরে পাকিসত্মানের বিুব্ধ জনতা কুশপতুল দাহ করছে পিসিবি চেয়ারম্যান ইজাজ বাটের। গত রবিবার পাকিসত্মানের নির্বাচক কমিটির চীফ ইকবাল কাশিমের পদত্যাগ এক হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি করে পাক ক্রিকেটে। সব মিলিয়ে বেসামাল অবস্থা বিরাজ করছে এখন পাকিসত্মানের ক্রিকেটে।
সামপ্রতিক সময়ে সবার নজর কেড়েছে পাকিসত্মান দলের ওয়ানডে কিংবা টেস্ট ক্রিকেটে নাজুক পারফরমেন্স। যা পাকিসত্মানের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ২০০৯ সালটা বদলে দিয়েছে পাকিসত্মান ক্রিকেটের গতিপথ। হারিয়েছে ছন্দ ও ঐতিহ্য। নিরাপত্তার কারণে পাকিসত্মানের মাটিতে বেশক'টি হোম সিরিজ বাতিল হয়ে যায়। বাতিল হয়ে যাওয়া সিরিজগুলো অনুষ্ঠিত হয় বিদেশের মাটিতে। কিন্তু সফরকারী দল হিসেবে একেবারেই এলোমেলা ছিল পাকিসত্মান। গত বছরের জুলাই-আগস্টে শ্রীলঙ্কা সফরে টেস্ট-ওয়ানডে সিরিজে দু'টোতেই হারে স্বাগতিকদের কাছে। এরপর দণি আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সুপার ফফ ইউনুস খানরা। তবে এবছর পাকিসত্মানের সফলতা একমাত্র টি-২০ ক্রিকেটে। জুনে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত টি-২০ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার খেতাব অর্জন করে তারা। এরপর থেকেই ভরাডুবি। নবেম্বরে আবুধাবিতে নিউজিল্যান্ডের বিপ েওয়ানডে সিরিজে হার। এরপর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজে ড্র । গত বছরে জয়- পরাজয়ের পরিসংখ্যানে একেবারে ছন্দহীন ইমরান খানের উত্তরসূরীরা। গতবছর পাকিসত্মান ২০ ওয়ানডের মধ্যে জিতেছে মাত্র ৭টিতে। হার ১৩। টেস্টে আরো করম্নণ অবস্থা। ৯ টেস্টে জয় মাত্র ১টিতে । ড্র ৪টি , হার ৪টি। টি-২০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে এ ফরমেটে ১১ ম্যাচে ৯টি জয়, ২টি হার। আবুধাবিতে নিউজিল্যান্ডের বিপ েওয়ানডে সিরিজ খোয়ানেরা পরই ক্রমাগত নাজুক পরিস্থিতি পাক দলের নিত্য সঙ্গী। অধিনায়ক ইউনুস খারাপ পারফরমেন্সের কারণে স্বেচ্ছায় বিশ্রামে চলে যাওয়ায় শুন্যতা সৃষ্টি হয় দলে। এই শূন্যতা পূরণ করেন অভিজ্ঞ মোহাম্মদ ইউসুফ। তার নেতৃত্বে দল নিউজিল্যান্ড সফর করে। এরপরে সাবেক অধিনায়ক ইউনুস দলে ফিরতে অমতা প্রকাশ করলে অস্ট্রেলিয়া সফরেও অধিনায়ক হিসাবে টিকে থাকেন ইউসুফ। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া সফরে পাক দলের সার্বিক নৈপুণ্য প্রশ্নের মুখে পড়ে। ২৬ ডিসেম্বর থেকে শুরম্ন হওয়া তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয় সফরকারীরা। অথচ ২ ম্যাচে তাদের জয়ের সম্ভাবনা ছিল প্রায় ৮০ ভাগ। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের দায়িত্বহীনতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। ফলে জোর সমালোচনার ঝড় ওঠে। ওয়ানডে সিরিজে ভালো করার জন্য একজন ব্যাটসম্যান হিসাবে দলে ফিরিয়ে আনা হয় সাবেক অধিনায়ক ইউনুস খানকে। কিন্তু তবুও আগের চেহারাতেই পাকিসত্মান। পাঁচ ম্যাচের সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৫-০ তে 'শুভ্রধৌত' হয় পাকিসত্মান। ফলে পাক ক্রিকেট বোর্ডের যুগোপযোগী সিদ্ধানত্ম আর সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বিভিন্ন একাডেমির উঠতি ক্রিকেটার আর হতাশায় নিমজ্জিত পাক দর্শকরা ইজাজ বাটের কুশপুতল দাহ করে লাহোরের রাজপথে। সেস্নাগান দিতে থাকে 'বিদায় হও ইজাজ'। পাকিসত্মানের ক্রিকেটকে আবারও আলোর দিকে নিয়ে যাবার জন্য বিৰুব্ধ জনতা অনুরোধ জানায় দেশটির প্রেসিডেন্ট আসিফ আল জারদারির কাছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় পিসিবির চেয়ারম্যানের পদ থেকে বাটকে সরালেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। কিছুদিন আগে বাট সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যদি প্রেসিডেন্ট তা চান তাহলে তিনি বিদায় নিতে প্রস্তুত। হয়তো দেখা যেতে পারে অচিরেই পিসিবির চেয়ারম্যানের পদে নতুন কেউ আসীন হয়েছেন। সমালোচনার মুখে বাট এখনও পদত্যাগ না করলেও নির্বাচকমন্ডলীর চীফ ইকবাল কাশিম সরে দাঁড়িয়েছেন তার পদ থেকে। তিনি জানিয়েছেন, 'আমাদের লৰ্য থাকে খেলোয়াড়রা ভাল খেলে দেশের সুনাম বয়ে আনবে। কিন্তু না খেলতে পারলে আমাদের কি করার আছে?' অনেকটা অভিমানেই তিনি সরে দাঁড়ান। পিসিবি আর নির্বাচকমন্ডলীর মতো সমস্যা আছে মাঠেও। সিনিয়র-জুনিয়র ক্রিকেটারদের মধ্যে সবসময় একটা বৈরি সম্পর্ক বজায় থাকে। তাছাড়া কোচ ইনত্মিখাব আলমের সঙ্গে খুব ভালো সময় যাচ্ছে না ইউসুফের। যদিও অধিনায়ক হিসাবে বেশিদিন থাকছেন না তিনি। অস্ট্রেলিয়া সফরের পরই পিসিবি ঘোষণা করবে নতুন অধিনায়কের নাম। শোনা যায় দুজনের মধ্যে সম্পর্কে তিক্ততার কারণে অস্ট্রেলিয়া সফরের ৫ম ওয়ানডে ম্যাচে ইউসুফের বদলে দলের নেতৃত্বের দায়িত্ব পান শহীদ আফ্রিদি। অধিনায়ক পরিবর্তন করেও সফরের শেষ ওয়ানডে ম্যাচে হার এড়াতে পারেনি পাকিসত্মান। উল্টো বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগে দুই ম্যাচের জন্য সাসপেন্ড হন আফ্রিদি। অস্ট্রেলিয়া সফরে নানা সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন পাক ক্রিকেটাররা। দ্বিতীয় টেস্টে খারাপ পারফরমেন্সের কারণে দল থেকে বাদ পড়েন উইকেটরৰক ব্যাটসম্যান কামরান আকমল। এর প্রতিবাদে না খেলার সিদ্ধানত্ম জানিয়ে কোড অব কন্ডাক্ট লঙ্ঘন করেন আকমলের ছোট ভাই উমর। পাক ক্রিকেট বোর্ড তাদের শাসত্মি হবে বলে ঘোষণা দিলেও তা বাসত্মবে দেখা যায়নি। ফলে দোষ করেও শাসত্মি না পাওয়া ক্রিকেটাররা ভবিষ্যতে ডিসিপিস্নন ভাঙ্গার জন্য আরো অনুপ্রাণিত হবে। এসব বিষয়গুলো পাক ক্রিকেট বোর্ড কঠোর হাতে দমন না করতে পারলে আরও ভয়াবহ অবস্থা অপেৰা করছে তাদের জন্য। সম্প্রতি ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট লীগ আইপিএল ভালোই লজ্জা দিয়েছে পাকিসত্মানকে। নিলামে ১১ পাকিসত্মানী ক্রিকেটার থাকলেও তাদেরকে কোন কাবই কেনেনি। এমন অপমানজনক পরিস্থিতি পাক ক্রিকেটকে আরো নাজুক অবস্থায় ফেলে দেয়। যদিও পিসিবি ঘোষণা দিয়েছে আইপিএলের কোন আসরেই আর অংশ নেবে না পাক ক্রিকেটাররা। প্রতিবাদ হিসাবে আইপিএলের চেয়ারম্যান লোলিত মোদির কুশপুতলও দাহ করে পাকিসত্মানী সমর্থকেরা। এতে কি পাকিসত্মান ক্রিকেটের উন্নয়ন সম্ভব? পাকিসত্মান ক্রিকেটকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে দরকার পাক সরকারের সরাসরি হসত্মৰেপ। নিশ্চিত করতে হবে দেশের অভ্যনত্মরীন সার্বিক নিরাপত্তা। যাতে নিশ্চিনত্ম মনে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলো পাকিসত্মানের মাটিতে খেলতে পারে। পাশাপাশি পিসিবিকেও নিতে হবে যুগোপযোগী এবং দুরদর্শী সিদ্ধানত্ম। তবেই আলোর মুখ দেখতে পারে পাকিসত্মানের ক্রিকেট। তা না হলে কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে পারে ১৯৯২ ক্রিকেট বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নরা।
_মাহমুদুন্নবী চঞ্চল

No comments

Powered by Blogger.