নিহত জঙ্গী রশিদুল পুলিশের ওপর হামলায় নেতৃত্ব দেয়

 দিনদুপুরে নৃশংসভাবে জঙ্গীদের হাতে খুন হওয়া জঙ্গী রশিদুল ইসলামও ছিল দুর্ধর্ষ জঙ্গী। পুলিশের ওপর হামলা করে পুলিশের শটগান ও ওয়্যারলেস সেট লুটে নেয়ার নেতৃত্বও দিয়েছিল জঙ্গী রশিদুল।
রশিদুল খুনের ঘটনায় ৩ জনকে আসামি করে রশিদুলের স্ত্রী আলিফ নূর বাদী হয়ে রাজধানীর উত্তরা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৪ জনকে আট করেছে। এদিকে জঙ্গী রশিদুল খুনের ঘটনায় রশিদুলের ৪ সহযোগীকে আটকের পর চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। আটককৃতদের মধ্যে জামাল জিজ্ঞাসাবাদ শেষে একজন পুলিশের কাছে জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছে। তাকে থানা হাজতে আটকে রাখতে পুলিশকে অনুরোধ করে। জামালের এমন প্রসত্মাবে অবাক পুলিশ। আটককৃতরা সাধারণত পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য নানা তদ্বির করে। এৰেত্রে ঠিক তার উল্টো। আটককৃত জামালের দাবি আমি থানা হাজতেই থাকব। আমার জীবন নিরাপদ নয়। আমাকেও যে কোন সময় জঙ্গীরা হত্যা করতে পারে। এমন আজব প্রসত্মাবে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের টনক নড়ে। নড়েচড়ে বসে পুলিশ। পুলিশ অনেকটাই নিশ্চিত জামালের সঙ্গে জঙ্গী কানেকশন রয়েছে। তাদের সঙ্গে জেএমবির যোগাযোগ রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জয়পুরহাট জেলার ৰেতলাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল হক জনকণ্ঠকে জানান, রশিদুল ইসলাম দুর্ধর্ষ জঙ্গী ছিল। পুলিশকেও সে পরোয়া করত না। তার সামনে দু'-একজন পুলিশও যেতে সাহস করত না। ২০০৩ সালের ১৫ আগস্ট রাতে ৰেতলালের একটি বাড়িতে জঙ্গীদের গোপন বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে জয়পুরহাট জেলার জঙ্গীরা একত্রিত হয়েছিল। বৈঠকে নিহত রশিদুল উপস্থিত ছিল। রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিপুল পরিমাণ পুলিশ ওই বাড়িতে অভিযান চালায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে জঙ্গীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পরে পুলিশের সঙ্গে জঙ্গীদের দীর্ঘৰণ বন্দুকযুদ্ধ হয়। এ সময় জঙ্গীরা পুলিশের শটগান ও ওয়্যারলেস সেট লুটে নেয়। বন্দুকযুদ্ধে বেশ কয়েক জন পুলিশ আহত হন। দীর্ঘৰণ বন্দুকযুদ্ধ শেষে পুলিশ গভীর রাতে রশিদুল ইসলামসহ বেশ কয়েক জন জঙ্গীকে গ্রেফতার করে। এ ব্যাপারে তৎকালীন ৰেতলাল থানার এসআই শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে ৩৪ জঙ্গীর বিরম্নদ্ধে মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে তদনত্মে বৈঠকে উপস্থিত ৬১ জঙ্গীর নাম জানতে পারে পুলিশ। এ মামলায় রশিদুল ৬ মাস জেলহাজতে ছিল। এরপর সে জামিনে ছাড়া পেয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। এ মামলায় রশিদুলের ২০ বছরের সাজা হয়। মামলাটি বর্তমানে সিআইডি পুনর্তদনত্ম করছে। পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম জানান, তাঁর কাছে রশিদুলের বিরম্নদ্ধে ৩টি মামলার ওয়ারেন্ট এসেছে। ওয়ারেন্ট মোতাবেক রশিদুল সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় ঠাকুরগাঁওয়ে দায়েরকৃত একটি মামলার আসামি। সর্বশেষ ২০০৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানায় রশিদুলের বিরম্নদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। যার জিআর ওয়ারেন্ট নং-৩৬৫/২০০৮। রশিদুলের পরিবারের সদস্যরা ধর্মভীরম্ন। রশিদুলের পিতা আব্দুর নূর একজন সরকারী চাকরিজীবী। এসি ল্যান্ট বিভাগে সে এখনও কর্মরত রয়েছে। সরকারী চাকরির সুবাদে রশিদুল গাইবান্ধা জেলার গবিন্দগঞ্জ থানার একটি মাদ্রাসায় পড়শোনা করেছে। মাদ্রাসায় পড়াশোনাকালীন সময়ে রশিদুল জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হয়। রশিদুলের দু'বোন বিবাহিত। রশিদুলের মা গৃহিণী। তবে পরিবারের সদস্যরা জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পুলিশ জানায়, শিবগঞ্জ থানায় মামলা দায়েরের পর থেকেই রশিদুল জেএমবির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তবে ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যনত্ম রশিদুলের সঙ্গে জেএমবির যোগাযোগ ছিল। মূলত সে প্রায় ৬ বছর যাবত পলাতক। ফেরার জীবন সে মসজিদে মসজিদে কাটিয়েছে। রশিদুল হয়ত নিজেও জানত তাকে হত্যা করবে জঙ্গীরা। এ জন্য প্রাণে বাঁচতেই সে মসজিদে মসজিদে রাত কাটাত। নিজের অবস্থান গোপন রাখতে সে কোন সময় বাসা ভাড়া করে বসবাস করেনি। বড় মেয়ে সায়মাকে রশিদুল গ্রামের বাড়িতে তার মায়ের কাছে রেখে ছোট মেয়ে সুমাইয়া ও স্ত্রী আলিফ নূরকে নিয়ে মাত্র দেড় মাস আগে ঢাকায় আসে। ঢাকার উত্তরখান থানাধীন চাঁনপাড়া আব্দুর রহমানের বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস শুরম্ন করেন। সে বেসরকারী দারম্নস ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরা ক্যাম্পাসে ইসলামিক শিৰা বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র ছিল। পাশাপাশি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার নাগর ইউনিয়নের করাইহাটি মসজিদে ইমামতি করত। মসজিদে ইমামতি করার সময় জেএমবি সম্পর্কিত নানা তথ্য প্রকাশ পেত তার বয়ানে। রশিদুলের স্ত্রী আলিফ নূর জানায়, জেএমবি তার স্বামীকে আবার জেএমবিতে ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। প্রায় এক বছর যাবত তার স্বামীর সঙ্গে জেএমবির তেমন কোন যোগাযোগ ছিল না। জেএমবিতে ফিরতে রাজি না হওয়ায় জেএমবির সদস্যদের হাতে তার স্বামী খুন হয়। রশিদুলের স্ত্রী আল আমীন, আকাশ ও নাদিম নামে ৩ জনকে আসামি করে উত্তরা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা জোনের ডিসি নিশারম্নল আরিফ জানান, ২ দিন আগে আল আমীন নামে এক যুবক রশিদুলকে মসজিদে খুঁজতে আসার বিষয়টি সত্য। এদিকে পুলিশ রশিদুলের সহযোগী জামাল ও মোকাম্মেলসহ তিন সহোদর ও মিজান নামে ৪ জনকে আটক করেছে। আটককৃতরা রশিদুলের সঙ্গে একই বাড়িতে বসবাস করে আসছিল। তাদের সঙ্গে জেএমবির যোগাযোগ রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জামালের বাড়ি ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর থানায়। জামাল জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে, ২০০১ সালে সে ও রশিদুল এক সঙ্গে জেএমবিতে যোগদান করেছিল। ২০০৩ সাল পর্যনত্ম জামাল জেএমবির সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করেছে। বিষয়টি পরিবারে জানাজানি হয়ে গেলে পরিবার থেকে জামালকে তার পিতা-মাতা বের করে দেয়। পরে গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে জামালকে তার পরিবার আবার গ্রহণ করে। এরপর থেকে জামাল জেএমবির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। জামালের দাবি সে পুলিশ হেফাজতের বাইরে নিরাপদ নয়। তাকেও যে কোন সময় জঙ্গীরা খুন করতে পারে। এজন্য তাকে পুলিশ কাস্টডিতে রাখতে পুলিশকে জামাল অনুরোধ করেছে।
প্রসঙ্গত সোমবার সকাল ৯টায় রাজধানীর উত্তরা রাজউক কলেজের পাশের মাঠে রশিদুলকে ছুরিকাঘাত করে নির্মমভাবে খুন করা হয়।
গোয়েন্দা সূত্র বলেছে, ঢাকায় গোপনে জঙ্গীরা তৎপর রয়েছে। জঙ্গীরা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। জঙ্গীদের বড় ধরনের কোন টার্গেটও থাকতে পারে। এ জন্য জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা জঙ্গীদের আবার দলে ডাকা হতে পারে। যারা ডাকে সাড়া দিচ্ছে না তাদের হত্যা করা হতে পারে। জঙ্গী সংগঠন সম্পর্কে অনেক তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে জঙ্গীরা এমন সিদ্ধানত্ম নিতে পারে। রশিদুলকে হত্যার মধ্য দিয়ে ভয়ে যাতে দলছুট জঙ্গীরা আবার দলে ভিড়ে সে হিসেবেও জঙ্গী রশিদুলকে হত্যা করতে পারে জঙ্গীরা। এটি দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া জঙ্গীদের দলে ফিরিয়ে আনার নয়া কৌশল হতে পারে জঙ্গীদের।

No comments

Powered by Blogger.